অনেকে শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগায়। অনেকে আবার পড়াশোনা শেষ করেও মনমতো চাকরি না পেয়ে বেকার সময় পার করেন।
কিন্তু ময়মনসিংহের দুই শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করার আগেই চা বিক্রি করে পেয়েছেন সফলতা। অন্যের চাকরি না করে নিজেরাই হয়েছেন সফল উদ্যোক্তা। করেছেন অন্যের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।
আসিফুল হক আসিফ ও চয়ন দেওয়ান। দুজনই ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।
দুজনই ভালো বন্ধু। একসময় তারা টিউশনি করে পড়াশোনার খরচসহ আনুষঙ্গিক খরচ জোগাতেন। করোনার সময়ে টিউশনি না থাকায় দুজন মিলে অল্প পুঁজিতে রেস্তোরাঁ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
সে অনুযায়ী গত বছরের ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ শহরের র্যাব সদর দপ্তরের উল্টো পাশে ‘মটকা আঁচ’ নামের ব্যতিক্রমী একটি রেস্তোরাঁ খোলেন।
উদ্বোধনের কয়েক মাসের ব্যবধানে রেস্তোরাঁটি ময়মনসিংহে ব্যাপক সাড়া ফেলে। গত বছরের ১৯ জুন এই শিক্ষার্থীদের দেয়া রেস্তোরাঁ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে নিউজবাংলা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত সময় পার করছেন আসিফ, চয়নসহ অন্যরা। অনেকে ভেতরে বসার জায়গা না পেয়ে রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে মটকা চা পান করছেন।
কথা হয় উদ্যোক্তা আসিফের সঙ্গে। এক বছরে ব্যবসার উন্নতি হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে পরিচিতি কম থাকায় চা-প্রেমীরা কম আসত।
মটকা আঁচ রেস্তোরাঁর দুই উদ্যোক্তা আসিফুল হক আসিফ ও চয়ন দেওয়ান।
‘কয়েক মাসের ব্যবধানে ক্রেতা বাড়তে থাকায় আমরাও উৎসাহ পেয়েছি। এর মধ্যে গত বছরের ১৯ জুন 'ময়মনসিংহে মটকা চায়ের সুঘ্রাণ' শিরোনামে রেস্তোরাঁর আদ্যোপান্ত তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশ করে নিউজবাংলা, যা নজরে আসে নানা শ্রেণি-পেশার লোকজনের। ফলে আমাদের বিক্রি আরও বেড়ে যায়। আশানুরূপ লাভবান হই আমরা।‘
তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা শাখা বাড়িয়েছি। ত্রিশালে জাককানই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেটের পাশে বড় পরিসরে আরেকটি রেস্তোরাঁ করেছি। সেখানেও ভালো সাড়া পাচ্ছি।
‘আমাদের প্রথম রেস্তোরাঁর বিপরীত পাশে আরেকটি ঘর ভাড়া নিয়ে ডেকোরেশনের কাজ চলছে। সেটি নতুন বছরের প্রথম মাসে উদ্বোধন করা হবে।
মটকা আঁচ রেস্তোরাঁর মজাদার খাবারের স্বাদ দিচ্ছেন ক্রেতারা। ছবি: নিউজবাংলা
‘এ ছাড়া শহরের কাঁচিঝুলি পার্ক রোড এলাকায় আরেকটি শাখা খোলার প্রস্তুতি চলছে। আমাদের এই চারটি শাখা একসঙ্গে চললে নিজেরা আরও লাভবান হওয়ার পাশাপাশি অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
আসিফ বলেন, ‘আমরা বেকারত্বের বোঝা বইতে চাই না। আমরা আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। নিজেকে সফল উদ্যোক্তা মনে করি। তবে আরও অনেকদূর এগিয়ে যেতে হবে।’
আরেক উদ্যোক্তা চয়ন বলেন, ‘মটকা আঁচ রেস্তোরাঁয় মটকা চা, মটকা স্পেশাল চা, মটকা কুলফি, মটকা ফালুদা, মালাই কুলফি, রেগুলার চা, তন্দুরি চা, স্পেশাল তন্দুরি চা, চিকেন মোমো, হান্ডি মাটন ও হান্ডি চিকেন বিক্রি করা হয়।
‘মাঝেমধ্যে বিক্রি করা হয় হাঁসের মাংস, খাসির নলি ও কলিজা ভুনা। এ ছাড়া জাককানইবির মূল গেটের পাশের রেস্তোরাঁয় মটকা চা, শিক কাবাব, বারবিকিউ চিকেন, লুচি, মালাই কুলফি, চিকেন খিচুরি, মোরগ পোলাও ও চিকেন সিংগারা বিক্রি করা হচ্ছে। সবই হাঁড়ি-পাতিলে পরিবেশন করা হয়। তবে মটকা চা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে রেস্তোরাঁ। সন্ধ্যার পর থেকে লোকজন বেশি আসতে শুরু করে। এ সময় আমাদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। অনেকে ভেতরে বসার জায়গা না পেয়ে চলেও যান। আবার অনেকে বাইরের বেঞ্চে বসে মটকা চা পান করে খোশগল্পে মেতে ওঠেন।’
ফাহিম, জহিরুল, সামাদ নামের কয়েকজন বন্ধু চায়ে চুমুক দেয়ার ফাঁকে জানান, রেস্তোরাঁর ভেতরের ডেকোরেশনে কাঠ, ফোক আর্ট ও পত্রিকার কাগজ দিয়ে সাজানো। বাইরের দেয়ালে নব্বই দশকের জনপ্রিয় টিভি চরিত্র বাকের ভাইয়ের দেয়ালচিত্র ছাড়াও সুবিধাবঞ্চিত ও গ্রামীণ নারীদের জীবন তুলে ধরা হয়েছে।
মটকা আঁচ রেস্তোরাঁর দেয়ালচিত্র। ছবি: নিউজবাংলা
এটি সবাইকে আকর্ষণ করেছে। যে কেউ রেস্তোরাঁর সামনে দিয়ে একবার গেলে, বাইরের দেয়ালচিত্রের দিকে তাকাবেই। এ ছাড়া মাটির পাত্রে সব কিছু পরিবেশ করায় অন্য রকম স্বাদ পাওয়া যায়।
হাশিম নামে আনন্দ মোহন কলেজের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘মটকা চা আমার পছন্দের। সময় পেলেই এখানে চলে আসি। শীতের সন্ধ্যায় মাটির পাত্রে পরিবেশন করা হান্ডি মাটনও আমাকে টানে।’
শিক্ষার্থীদের এমন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার উল্লেখ করে ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র সহসভাপতি শংকর সাহা বলেন, ‘যেকোনো ব্যবসা সঠিক পরিকল্পনা, পরিশ্রম ও ধৈর্য সহকারে করতে হয়। তাহলে অল্প পুঁজিতে ব্যবসা করেও সফলতা পাওয়া যায়।
মটকা আঁচ রেস্তোরাঁ। ছবি: নিউজবাংলা
‘ওই শিক্ষার্থীরা কাজকে ছোট মনে করেনি। নিজেরা চা পরিবেশন করে খাওয়াতেও লজ্জা পায়নি। ফলে বেকারত্ব ঘুচিয়ে সফল উদ্যোক্তা হয়েছে। এরা একদিন সফলতার চূড়ায় পৌঁছাবে- এমনটাই প্রত্যাশা করি।’