লিভার শরীরের সর্ববৃহৎ অঙ্গ। আকৃতিতে যেমন বৃহৎ, প্রয়োজনীয়তার দিক থেকেও এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। শরীরকে সুখে রাখতে দরকার সুস্থ লিভার। অসুস্থ বা রোগাক্রান্ত লিভার আমাদের জীবনে বয়ে নিয়ে আসে দুঃখ-কষ্ট, এমনকি অকাল মৃত্যুও। মানব শরীরের এই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি নিয়ে আলোচনা করেছেন হেপাটোলজিস্ট এবং গ্যাস্ট্রো-অ্যান্টারোলজিস্ট বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)।
-
অন্য যেকোনো যন্ত্র বা মেশিনের মতো আমাদের দেহযন্ত্রও চলে শক্তির সাহায্যে। এই শক্তি আসে খাদ্য থেকে। আমরা যেভাবে খাবার খাই, তা থেকে সরাসরি শক্তি উৎপন্ন হতে পারে না। জটিল খাবার লিভারে প্রক্রিয়াজাত হয়ে শক্তি উৎপাদনের উপযোগী হয়ে জমা থাকে এবং প্রয়োজনমাফিক শরীরের কোষে কোষে পৌঁছে শক্তি উৎপাদন করে। তাই লিভারকে বলা হয় শরীরের ‘পাওয়ার হাউস’।
শুধু তা-ই নয়, শরীরে উৎপন্ন বিভিন্ন দূষিত পদার্থ লিভার বিশুদ্ধ করে এবং পরবর্তীকালে শরীর থেকে বের করার ব্যবস্থা করে। অনিচ্ছাকৃত বা ইচ্ছাকৃতভাবে শরীরে কোনো বিষাক্ত পদার্থ প্রবেশ করলে লিভার সেটিকে বিষমুক্ত করে। বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন জাতীয় পদার্থ তৈরি করে যা শরীরের জন্য অপরিহার্য।
-
লিভারের যত রোগগুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গটি নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারে। কিছু রোগ বংশগত, কিছু রোগ অনিয়মিত জীবন যাপনের জন্য হয়ে থাকে। কিছু রোগ স্বল্পস্থায়ী এবং পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়; কিছু রোগ দীর্ঘস্থায়ী, যা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে কেড়ে নেয় জীবন। এমনকি চিকিৎসা করা সত্ত্বেও।
হেপাটাইটিস বা লিভারে প্রদাহ বিশ্বজুড়ে লিভারের প্রধান রোগ। নানা কারণে এই প্রদাহ হতে পারে। যার অন্যতম কারণ এ, বি, সি, ডি, ই নামক হেপাটাইটিস ভাইরাস। পানি ও খাবারের মাধ্যমে সংক্রমিত হেপাটাইটিস এ ও ই ভাইরাস লিভারে একিউট হেপাটাইটিস বা স্বল্পস্থায়ী প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরোপুরি সেরে যায়।
দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহের জন্য দায়ী হেপাটাইটিস বি, সি ও ডি ভাইরাস। অনেক কারণেই লিভারের প্রদাহ হতে পারে। ভাইরাস ছাড়া ও অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান, লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়া, বিভিন্ন ড্রাগ ও কেমিক্যালস ব্যবহারের ফলে হেপাটাইটিস হয়ে থাকে। অটোইমিউন হেপাটাইটিস, উইলসন্স ডিজিজসহ বিভিন্ন অজানা কারণজনিত রোগ ও বংশগত রোগে লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
যে কারণেই প্রদাহ সৃষ্টি হউক না কেন, দীর্ঘস্থায়ী বা ক্রনিক হেপাটাইটিস বছরের পর বছর চলতে থাকলে লিভারের কোষগুলো মরে যায়। অকার্যকর ও অপ্রয়োজনীয় ফাইব্রাস টিসু সেই স্থান দখল করে জন্ম দেয় সিরোসিস নামক মারাত্মক রোগ। সিরোসিস হলে লিভারের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। আমাদের দেশে হেপাটাইটিস বি এবং সি সংক্রমণই লিভার সিরোসিসের প্রধান কারণ।
উন্নত বিশ্বে এ স্থান দখল করে আছে অতিরিক্ত মদ বা অ্যালকোহল পানজনিত হেপাটাইটিস। এ ছাড়া সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসা ফ্যাটি লিভার, লিভারের সিরোসিসের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের দেশে সিরোসিসের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে এটি দায়ী বলে ধারণা করা হচ্ছে। ডায়াবেটিস, রক্তের চর্বির উচ্চমাত্রা প্রভৃতি কারণে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মতো লিভারেও ফ্যাট জমে ফ্যাটি লিভার হয়।
এ ছাড়া ব্যাকটেরিয়া এবং প্যারাসাইট লিভারে অ্যাবসেস বা ফোঁড়া তৈরি করতে পারে। সর্বোপরি প্রাণঘাতী ক্যানসারও ভর করতে পারে লিভারে। সিরোসিস যাদের হয় তাদের এ ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
-
হেপাটাইটিস ভাইরাস ছড়ায় যেভাবেদূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে হেপাটাইটিস এ ও ই ছড়ায়। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও বড়দের জন্ডিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস ই ভাইরাস।
ঘরের বাইরে আমরা যখন থাকি, তখন খোলা খাবার, পানি, ফলের রস ইত্যাদির উৎস ও বিশুদ্ধতা যাচাই না করে খাবার অভ্যাস আছে অনেকেরই। আর এই বাজে অভ্যাসটির কারণে অনেকেই আক্রান্ত হন জন্ডিসে।
তা ছাড়া শহরে পানি সরবরাহ লাইনে ভাইরাসের সংক্রমণ হয়ে জন্ডিস ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাও নতুন কিছু নয়। তাই ফুটিয়ে পানি খাওয়া আর বেছে বুঝে খাবার খাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এতে শুধু হেপাটাইটিস এ এবং ই নয়, টাইফয়েড আর ডায়ারিয়ার মতো আরো অনেক পানিবাহিত রোগ থেকে বাঁচা যাবে।
রক্ত ও ব্যক্তিগত অনৈতিক আচরণের মাধ্যমে ছড়ায় হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস। দূষিত রক্ত গ্রহণ বা দূষিত সিরিজ ব্যবহারের মাধ্যমে অনেকেই নিজের অজান্তে রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। একই শেভিং রেজার, ব্লেড কিংবা খুর ব্যবহারের মাধ্যমে এ দুটি ভাইরাস ছড়াতে পারে।
হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত মায়ের সন্তানের জন্মের পরপর বি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগ। তবে মায়ের দুধের মাধ্যমে বি ভাইরাস ছড়ায় না। সামাজিক মেলামেশা যেমন হ্যান্ডশেখ বা কোলাকোলি এবং রোগীর ব্যবহার্য সামগ্রী যেমন গ্লাস জামা-কাপড় ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায় না।
-
হেপাটাইটিসের যত লক্ষণএকিউট হেপাটাইটিসে ক্ষুধামন্দা, শরীর ব্যাথা, বমির ভাব কিংবা বমি এবং কিছু দিনের মধ্যে প্রস্রাবের রং ও চোখ হলুদ বর্ণ ধারন করে। এ সময় শরীরে চুলকানি দেখা দিতে পারে। জন্ডিস ক্রমে বেড়ে গিয়ে ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
ক্রনিক হেপাটাইটিস বা সিরোসিসের প্রাথমিক পর্যায়ে বেশির ভাগ রোগীর উপসর্গ থাকে না বললেই চলে। কেউ কেউ দুর্বলতা, অবসন্নতা বা ক্ষুধামন্দা অনুভব করতে পারে। হেপাটাইটিস বি ও সি অনেকাংশই নিরাময়যোগ্য রোগ হলেও অ্যাডভ্যান্সড লিভার সিরোসিস অথবা লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত রোগী প্রায়ই কোনো শারীরিক অসুবিধা অনুভব করে না। এসব রোগীদের পেটে পানি জমে পেট ফুলে যেতে পারে, রক্ত বমি বা কালো পায়খানা কিংবা অজ্ঞান হয়ে জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। এ সময় শরীর শুকিয়ে যায়।
আমাদের দেশে অনেকে বিদেশে যাওয়ার আগে রক্ত পরীক্ষার সময়, কিংবা রক্ত দিতে গিয়ে বা ভ্যাকসিন দিতে গিয়ে হেপাটাইটিস বি ইনফেকশনের কথা প্রথম জানতে পারেন। এ কারণে আমাদের সবারই উচিত একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর রক্ত পরীক্ষা করা।
-
লিভারের রোগ হলে কী করবেনলিভারের রোগীর কোনো উপসর্গ দেখা দিলে বা সন্দেহ হলে অথবা শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত হলে দেরি না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হয় লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ।
তিনি রোগীর রোগ নির্ণয় করে এর কারণ, রোগের জন্য সৃষ্ট জটিলতা এবং রোগের বর্তমান অবস্থা জেনে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও উপদেশ দিবেন। হেপাটাইটিস এ ও ই জনিত রোগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভালো হয়ে যায়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জটিলতাও দেখা দিতে পারে। যেমন- জীবনসংহারী একিউট হেপাটিক ফেইলিউর নামক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই জন্ডিসকে কখনো অবহেলা করবেন না।
ক্রনিক হেপাটাইটিসের জন্য দায়ী হেপাটাইটিস বি ও সি-এর বিরুদ্ধে কার্যকর ওষুধগুলোর সবই এখন আমাদের দেশে পাওয়া যায়। তাই এ ক্ষেত্রেও হতাশ না হয়ে লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
-
লিভার রোগ প্রতিরোধে করণীয়হেপাটাইটিস বি এর টিকা নিন
ঝুঁকিপূর্ণ আচারণ যেমন- অনিরাপদ যৌনতা, একই সুঁই বা সিরিঞ্জের বহুজনের ব্যবহার পরিহার করুন।
নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন ও ডিজপজেবল সুঁই ব্যবহার করুন। একই ব্লেড, রেজার, ব্রাশ; ক্ষুর বহুজনে ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না ।
শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন।
শাকসবজি ও ফলমূল বেশি করে খান আর চর্বিযুক্ত খাবার কম খান।
মদ্যপান ও অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্য পরিহার করুন।
বিশুদ্ধ পানি ও খাবার গ্রহণ করুন।
ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
পরিষ্কার-পরিছন্ন থাকুন।
-
শেষ কথামানুষের দেহে লিভার মাত্র একটিই থাকে এবং জীবন ধারনের জন্য এটি অত্যন্ত অপরিহার্য। তাই লিভারের অসুস্থতার ফলাফল ক্ষেত্রবিশেষে হতে পারে ব্যাপক ও ভয়াবহ। তবে লিভারের রোগ মানেই সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া নয়। ঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ নিরাময় এবং অনিরাময়যোগ্য জটিলতা মুক্ত মোটামুটি স্বাভাবিকভাবে জীবন নির্বাহ করা যায়।
-
লেখক : ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন প্রধান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়