শব্দের কী শক্তি! একটা মাত্র শব্দ মানুষকে সুখী করে দিতে পারে। পারে দুঃখ দিতেও। প্রেমিকা যখন ‘উম্মম’ বলে সাড়া দেয়, প্রেমিকের আকাশে জ্বলে ওঠে আলো, পুবে-পশ্চিমে। আবার যখন নৈঃশব্দের আড়ালে সে নিজেকে লুকায়, প্রেমিকের গগন থেকে মধ্যাহ্নেই ডুবে যায় সূর্য।
শব্দের কত জাদু! এই যেমন ‘দ্রাক্ষা’র সঙ্গে বাগান মেলে না। দ্রাক্ষার সঙ্গে কুঞ্জ মিলে হয়ে ওঠে ‘দ্রাক্ষাকুঞ্জ’। আবার দ্রাক্ষা না হয়ে যদি কেবল আঙুর হয়, তাহলে হতে হয় ‘আঙুরবাগান’। ‘গলিত’ শুনলেই কেমন গা গুলিয়ে ওঠে, কিন্তু কেউ ‘বিগলিত’ হলে মন খুশি হয়।
এই যে ব্রহ্মাণ্ড, যাকে নিখিল ভুবন বা প্লানেট আর্থ যা-ই বলি, এখানে প্রথম এসেছিল শব্দ, তারপর আলো। ‘কুন’ শব্দ দিয়ে জন্ম হলো দুনিয়া। কুন মানে ‘হও’, ফা ইয়াকুন মানে ‘হলো’ …be and it is.
পদার্থবিদ্যার আদিতেও সেই শব্দ, the big bang, অতঃপর বিপুল নিনাদে বহুধা বিভাজিত হলো জগতের তাবৎ উপকরণ। উপনিষদ বলছে শব্দই ব্রহ্ম, ‘অহম ব্রহ্মাস্মি’ অর্থাৎ ‘আমিই ব্রহ্ম’ … I am the supreme being.
উপনিষদের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে যেন মিলে যায় মনসুর হাল্লাজের ‘আইন্যাল হক’! ওদিকে ‘ওঁ’ ধ্বনিতে হলো পরম শিবের প্রথম প্রকাশ; আদি ধ্বনি ‘ওঙ্কার’ সব ধ্বনির মূল, আদি মন্ত্রবীজ- সেও এক মানসিক তরঙ্গ।
আমরা কিন্তু সব শব্দ শুনি না। যেসব শব্দ আমাদের কানে আসে অর্থাৎ যা আমরা শুনতে পাই, তা নিশ্চয় কোথাও ধ্বনিত হয়। নিশ্চয় কোনো একটা আঘাত বা স্পন্দন থেকে তার উদ্ভব হয়। আঘাত থেকে উদ্ভব বলে এদের নাম ‘আহত শব্দ’।
অন্যদিকে যে শব্দ আমরা শুনি না, কোনো দৃশ্যমান আঘাত থেকে যার উদ্ভব হয়নি, হয়েছে অন্তরস্থ প্রজ্ঞা থেকে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব’এর মতো, যা সাধনা করে শুনতে হয়, সেই সব শব্দের নাম ‘অনাহত শব্দ’। কোনো এক বায়ুহীন অন্তরীক্ষে পৌঁছাতে পারলেই কেবল তা শুনতে পাওয়া যায়।
কেবল তান্ত্রিক সাধনা নয়; সত্যিকার প্রেমে পড়লেও অনাহত শব্দ শোনা যায়। যে প্রেমে কোনো আবরণ নেই, যে মগ্ন মুহূর্তে জীব বা জগতের আর কিছু টের পাওয়া যায় না, তখন অনাহত শব্দেরা অন্তরে রসক্রীড়া করে। যেমন প্রেমিকার অন্তর যখন বলে ‘কই তুমি?’ প্রেমিক তা স্পষ্ট শুনতে পায়।
আবার সে যখন ডাকে না মোটেই, সেই সাউন্ড অব সাইলেন্সও প্রেমিকের কানে বিষাদ বেদনা বাজায় (কৌশিক গাঙ্গুলির ‘শব্দ’ সিনেমায় এর সামান্য ইঙ্গিত আছে)।
কোনো বিশেষ সাংস্কৃতিক বা সামাজিক কারণে কিছু কিছু শব্দের প্রতি কারও অহেতুক অনুরাগ বা বিরাগ থাকতে পারে। ব্যক্তি ও সমাজ ভেদে একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ থাকতে পারে। শব্দটা শোনা, দেখা, পড়া বা ভাবামাত্রই মনে একটা নিজস্ব অর্থ বা দৃশ্য ভেসে ওঠে। আমরা সহ্য করতে পারি না। ওই নিরীহ শব্দটাই তখন যেন প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। এমন প্রথাবদ্ধ শব্দপ্রেম বা শব্দঘৃণা অহরহ দেখা যায়।
আমাদের মনে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঘটনাটি। একজন ভর্তিচ্ছু ছাত্রের টি-শার্টে ‘Fuck the System’ লেখা দেখে একজন শিক্ষক কেমন রেগে গিয়ে ছাত্রটিকে শার্ট খুলে উল্টো করে পরতে বাধ্য করেছিলেন এবং নিজের ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘এই নির্মল ক্যাম্পাসে এই ধরনের অসভ্যতা কখনও মেনে নেয়া যায় না।’
‘ফাক’ শব্দটা দেখার পর এখানে শিক্ষকটির মনে যা ভেসে উঠেছে তা তার বিবেচনায় নিশ্চয় অশ্লীল, তিনি মনে করেছেন সামান্য এই শব্দটি হয়তো তার বা তার প্রতিষ্ঠানের কৌলিন্য হরণে সক্ষম, তিনি শব্দটি ঢেকে দিয়েছেন।
অথচ ‘ফাক’ শব্দের এমন অর্থও হতে পারে যা কেবল দুটি প্রত্যঙ্গ সংশ্লিষ্ট নয়, যা ‘মানি না’, বা ‘বদলাতে চাই’ বা ‘বস্তাপচা’ ইত্যাদি নানা অর্থ বহন করতে পারে। যেমন কবি এলেন গিন্সবার্গ লিখেছিলেন, ‘America when will we end the human war? Go fuck yourself with your atom bomb’. তিনি নিশ্চয় এটম বম্ব কোথাও ‘ঢোকানো’ বোঝাননি।
‘সতী’ শব্দটি বাঙালির নিজস্ব। এটা নারীর একটা বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ধারণাকে ইঙ্গিত করে। মজার ব্যাপার, বাংলা ভাষায় এই শব্দের বিপরীতার্থক পুরুষলিঙ্গবাচক কোনো শব্দ নেই।
কেউ হয়তো বলবেন ‘সৎ’, কিন্তু তখন প্রশ্ন করাই চলে, নারী কি সৎ হতে পারেন না? যে অর্থে নারী ‘সতী’ সেই অর্থে পুরুষের জন্যে কোনো শব্দ নেই। যে অর্থে নারী ‘অসতী’ সে অর্থে একজন পুরুষ কী?
‘বেশ্যা’ বলতে আমরা শাব্দিকভাবে ‘অর্থের বা অন্যবিধ প্রাপ্তির বিনিময়ে যৌনসংগমে সম্মত’ নারী বুঝলেও সাংস্কৃতিক বা ঐতিহাসিকভাবে যা বুঝি তার সঙ্গে অপমান, ঘৃণা, তাচ্ছিল্য জড়িয়ে আছে।
তাই শব্দ ব্যবহারে বিদ্বজ্জনেরা সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। কারণ শব্দ কেবল বাক্যস্থ পদ নয়, একটি বার্তা, একটি শক্তি এবং কখনও শব্দ একটি অটোসাজেশনও।
শব্দের একাধিক অর্থ, ব্যাপ্তি ও ব্যঞ্জনা থাকে। শাব্দিক অর্থের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অর্থ বা প্রেক্ষাপটও শব্দের সঙ্গে যুক্ত থাকে। ভিন্ন ইতিহাস ও সংস্কৃতির দুজন মানুষ একই শব্দের দুই রকম অর্থ বুঝতে পারেন। আবার কোনো কোনো শব্দ একেবারেই একটি ভাষাভাষী গোষ্ঠীর নিজস্ব ধারণা ছাড়া আর কিছু বহন করে না- যেমন অভিমান, যেমন ভাত, যেমন নদী।
ভাতের সঙ্গে বাঙালির আত্মার সম্পর্ক। যে ‘স্বামী’কে দেবতা বলা হতো, সেই স্বামীকে ‘ভাতার’ও বলা হতো। ভাত দিত, তাই সে ভাতার। ‘ভাত দেয়ার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই’ বলে মুখ ঝামটা দিয়েছেন নারীরা। অভিমান করে কেউ কেউ এখনও স্বামীদের বলেন, ‘তোমার ভাত আর খাবো না।’ মানে তোমাকে ছেড়ে চলে যাব।
এক ফসলি জমি ছিল। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ছিল প্রচণ্ড অভাব। দিনের পর দিন ভাত থাকত না। ভাতের হাঁড়িতে কেবল কাঁঠাল সেদ্ধ খেতে দেখেছি। ভিখারিদের ভাত চাওয়ার সাহস ছিল না। ক্ষীণ কণ্ঠে ‘একটু ফ্যান দ্যাও গো’ বলে দুয়ারে দাঁড়াত। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’ বা হুমায়ূন আহমেদের ‘মধ্যাহ্ন’তে এই ভাত-ফ্যান-দুঃখ-বেদনার গল্প আছে। সত্যি গল্প।
সেই দেশে কৃষিতে অনেক উন্নতি হয়েছে। কৃষিবিদরা ইরি, বিরি ধান আবিষ্কার করেছেন আর কৃষক মাটির গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে সেই ধান চাষ করেছেন। এবং সেই ভরসায় এ দেশের রাজনৈতিক নেতারা কম দামে ভাত খাওয়াবেন বলে ভোট নিয়েছেন।
তাই ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে, আমাদের কাছে বলগ ওঠা ভাতের হাঁড়ির গুড়গুড় শব্দ মালহারের চেয়েও মধুর, ভাপ ওঠা গরম ভাতের গন্ধ শ্যানেল পারফিউমের চেয়েও সুগন্ধি।
থালাভরা শিউলিফুল ভাতের সঙ্গে সামান্য তরকারি আর একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাবার ব্যবস্থা করে দিলেই যে বাঙালিকে অনায়াসে শাসন করা যায়। তাই বাঙালির কাছে ‘ভাত’ একটা মাটিগন্ধি হৃদয়ঘটিত ব্যাপার, ‘রাইস’ এর সঙ্গে এর বিন্দুমাত্র মিল নেই। অভিমান, নদী ইত্যাদি আমাদের এমন অনেক নিজস্ব শব্দেরও নিজস্ব অর্থ আছে যা অন্য কারও সঙ্গে মিলবে না।
ভাষাকে উন্নত করা যায়। ভাষায় প্রতিদিন যোগ-বিয়োগ ঘটে। নতুন শব্দ যুক্ত হয়, পুরোনো শব্দ হারিয়ে যায়। যেমন ‘মহকুমা’ হারিয়ে গেছে।
এই নিরন্তর পরিবর্তনের যাত্রাপথে আমাদের দায়িত্ব হলো, কারও জন্য অবমাননাকর ও বৈষম্যসৃষ্টিকারী শব্দ (যেমন বেশ্যা, মহিলা, মুচি, মেথর ইত্যাদি) পরিহার করা। আর যে শব্দের সঙ্গে আমাদের নিজস্ব ইতিহাস আর মায়ার বাঁধন আছে, তা বেশি ব্যবহার করা। তবে এ-ও সত্যি সময়ের পরিবর্তনে প্রয়োগের স্থান সংকুচিত হয়ে এলে আমাদের ইচ্ছা থাকলেও এ ধরনের অনেক শব্দ হারিয়ে যাবে।
লেখক: মানবাধিকারকর্মী