চুরি-ডাকাতিসহ নানা কারণে একসময় আতঙ্কের জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা। ঢাকা-ময়মনসিংহ পথে চলাচল করা ট্রেনগুলোতে ঘটত এসব চুরি-ডাকাতির ঘটনা। এ কারণে যাত্রীদের মনে ছিল ভীতি। সেই দিন এখন আর নেই। তবু নেতিবাচক পরিচিতি পেয়েছে এই জনপদ।
নিজেদের এই ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে উদ্যোগী হয়েছেন এলাকাবাসী।
গফরগাঁও নিয়ে মানুষের ভীতি কাটাতে সড়কে আঁকা হচ্ছে নান্দনিক চিত্রশালা। এটির উদ্যোগ নিয়েছেন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী রুহুল আমিন কাজল। আর এই শিল্পকর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসনের সংসদ সদস্য ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল।
গত অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে কাজটি শুরু হয়।
ইউরোপের নানা দেশে ছবি এঁকে খ্যাতি অর্জন করেছেন রুহুল আমিন কাজল। তিনি ১৯৯৪ সালে সুইডেনে কার্নিভ্যালে ট্রাফিক আর্ট (সড়কচিত্র) করে গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নামও লিখিয়েছেন। তার ‘কলোনি’ সিরিজের কাজগুলো সমাদৃত হয়েছে।
‘ডেমোক্রেজি, কিলিজিয়ন, ইভিলাইজেশন’ শিরোনাম ব্যবহার করে নতুন শব্দ তৈরি করেছেন তিনি। ‘ট্রাফিক আর্ট’ অর্থাৎ ‘চলার পথে কলার কথা’- এর মাধ্যমে নিজ জন্মভূমিতে শিল্প, নান্দনিকতা ও সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে তিনি উদ্যোগী হন।
উপজেলার এশিয়ান হাইওয়ের ঢালীবাড়ী মোড়ে সড়কের পাশে বিভিন্ন চিত্রকর্ম ফুটিয়ে তুলেছেন রুহুল আমিন কাজল। তার সহযোগী হিসেবে আছেন আরেক চিত্রশিল্পী উপজেলার গফরগাঁও ইউনিয়নের মহিরখারুয়া গ্রামের জ ই সুমন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী এবং গফরগাঁওয়ের চর এলাকার পাঁচ তরুণও সার্বক্ষণিকভাবে এ কাজে সহযোগিতা করছেন।
চিত্রকর্ম দেখতে আসা আসাদুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জামালপুর সদর থেকে গফরগাঁও বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম। পরে জানতে পারি রংতুলির আঁচড়ে সড়কে দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এসে বেশ ভালো সময় উপভোগ করেছি। মনে হচ্ছে সড়কজুড়ে জীবন্ত ছবি।’
মইনুল হাসান নামে আরেকজন বলেন, ‘এসব চিত্রকর্ম মনোমুগ্ধকর। বাচ্চারা খুবই আনন্দ পায়। সে জন্য গফরগাঁও পৌর এলাকা থেকে ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে এসেছি। প্রত্যেকটি সড়কে এমন চিত্র ফুটিয়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।’
কাজলের স্বপ্ন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে গফরগাঁও উপজেলার বিভিন্ন সড়ক ও দেয়ালজুড়ে আঁকা হবে এমন ছবি।
তিনি বলেন, ‘যারা আগে গফরগাঁও আসার সময় ট্রেনের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিতেন, তারা ছবি দেখতে খুলে দেবেন ট্রেনের জানালা। গফরগাঁও শহরে ঢুকে দেখবেন, দেয়ালে দেয়ালে শিল্পের ছোঁয়া। ক্রমশ ছবির খবর ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশের মানুষের কাছে। গফরগাঁও হয়ে উঠবে দেয়ালচিত্রের শহর।’
তিনি আরও বলেন, ‘লোকজ সুন্দর শিরোনামে গফরগাঁওয়ে সড়কে যে ছবিগুলো আঁকা হচ্ছে, সেগুলো বাতাসে জীবন্ত হয়ে দোল খাবে। মানুষের মনে ছবিগুলো ইতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলবে, এমন স্বপ্ন নিয়েই ছবি আঁকার কাজটি করা হয়েছে। এ ছাড়া গফরগাঁওয়ের নতুন নতুন প্রজন্ম জানবে, তারা ছবির জনপদের মানুষ।’
গফরগাঁওয়ের এই চিত্রকর্ম শেষ করে কাজল চলে যাবেন ডেনমার্কে। ফিরে এসে আবার শুরু করবেন দেয়ালচিত্রের কাজ। তখন মুক্তিযুদ্ধের কিছু ছবি আঁকা হবে। গফরগাঁও ছাড়া দেশের অন্য কোনো স্থানে এমন চিত্রকর্মের কাজ কেউ করতে চাইলে সহযোগিতা করবেন বলেও জানান তিনি।
চিত্রশিল্পী জ ই সুমন কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ড্রয়িং পেইন্টিংয়ে স্নাতকোত্তর করে ঢাকায় বেশ কিছুদিন কাজ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘সবাই যদি নিজ জন্মস্থান ছেড়ে বাইরে চলে যায়, তাহলে নিজ এলাকার উন্নয়নের কাজ কে করবে? এসব চিন্তা করেই নিজ এলাকাতে কাজ শুরু করেছি এবং দেশব্যাপী আমরা এই কাজ করব বলে চিন্তা করেছি।’
তিনি বলেন, 'শিশু-কিশোরদের জন্য চিত্রাঙ্কন শেখার ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে। এটা কাজলের পছন্দ হয়েছে। তিনি আমাদের সহায়তা করবেন।'
সংসদ সদস্য ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চিত্রশিল্পী রুহুল আমিন কাজল সড়কে ছবি আঁকার আগ্রহ প্রকাশ করলে পৃষ্ঠপোষকতা করার কথা জানাই। তার এমন উদ্যোগ আমার ভালো লেগেছে। প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লোকজন ভিড় করছে ওই সড়কের পাশে। আমিও দৃষ্টিনন্দন চিত্রাঙ্কন দেখে মুগ্ধ হয়েছি।’