বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পুতুল নাচ বন্ধ, দিন চলে না শিল্পীদের

  •    
  • ১৫ নভেম্বর, ২০২২ ১২:১৪

এক সময় গ্রামগঞ্জ, হাট-বাজার, স্কুল কিংবা খোলা মাঠে মঞ্চ সাজিয়ে যে পুতুল নাচের আসর জমত, এখন আর সেই দৃশ্য চোখে পড়ে না। পুতুল নাচ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর শিল্পীরা পড়েছেন বিপাকে। পুরনো পেশা আগলে রেখে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষগুলো অর্থের অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচ বন্ধ হয়ে যাওয়া উত্তরবঙ্গের একমাত্র পেশাদার পুতুল নাচের কোম্পানি কুড়িগ্রামের ‘মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটার’ শিল্পীদের চুলায় হাড়ি চড়ছে না।

এক সময় গ্রামগঞ্জ, হাট-বাজার, স্কুল কিংবা খোলা মাঠে মঞ্চ সাজিয়ে যে পুতুল নাচের আসর জমত, এখন আর সেই দৃশ্য চোখে পড়ে না। পুতুল নাচ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর শিল্পীরা পড়েছেন বিপাকে। পুরনো পেশা আগলে রেখে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষগুলো অর্থের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার সীমান্তঘেঁষা পাথরডুবি ইউনিয়নের দক্ষিণ পাথরডুবি গ্রামে ঠিকানা ‘মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটার’-এর। এটির মালিক মকবুল হোসেন, সভাপতি ভানু চন্দ্র বর্মন। সংগঠনে সরকারি তালিকাভুক্ত শিল্পী মকবুল হোসেন এবং আবুল হোসেন। মাসিক ১ হাজার ৫০০ টাকা হারে বছরে ১৮ হাজার টাকা পান তারা।

মালিক মকবুল হোসেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে প্রায় তিন বছর ধরে পড়ে আছেন। দুই স্ত্রী, পাঁচ ছেলে এবং ছয় মেয়ে নিয়ে তার সংসার। সহায় সম্পদ বলতে ২০ শতকের ভিটাবাড়ি। ছেলেরা কৃষি কাজ করে। তাই দিয়ে সংসার চলছে।

মকবুল হোসেন জানান, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কুচবিহার জেলার দিনহাটা থানার ‘মা কালি পুতুল নাচ’ সংগঠনের শ্রী মুরালী বর্মণের কাছে থেকে ৮০ হাজার টাকায় পুতুলগুলো কিনেছিলেন তিনি। এরপর ১৯৮৪ সালে সেই নাম বদলে রাখা হয় ‘মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটার’।

ভারতের কলকাতা, কুচবিহার, দিনহাটা ও শিলিগুড়ি থেকে পুতুল নাচের মাস্টার এনে প্রায় ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নেন বাংলাদেশের ৯ জন শিল্পী। শুরুতে পুতুল নাচ দেখানো হতো শুধু কুড়িগ্রামে। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নিবন্ধন পাওয়ার পর ঢাকাসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় পুতুল নাচ দেখাতে শুরু করেন তারা।

‘এক ফুল দুই মালি’, ‘কাশেম মালার প্রেম’, ‘সতী রূপভান’, ‘রামের বনবাস’, ‘দানবীর রাজা হরিশ চন্দ্র’, ‘রাবণ বধ’, ‘মহা সতী সাবিত্রী’ ‘সত্যবান’, ‘সাগরভাসা’সহ ২১টি পালা করেছে এ কোম্পানি। শিল্পকলা একাডেমি পুরষ্কারও পেয়েছে তারা। অর্থাভাবে এই থিয়েটার দল বিদেশে শো করতে পারেনি।

সময়ের সঙ্গে যাত্রাপালা বন্ধ হয়েছে। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়েছে পুতুল নাচেরও আসর। আগের মতো আর ডাক আসে না তাদের। প্রায় ২০ বছর ধরে পুতুল নাচের আসর না পাওয়ায় আয় রোজগারও নেই সংগঠনের শিল্পীদের। এখন দিনমজুরি করে সংসার চলছে তাদের। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৯ সদস্যের মধ্যে একজন মারা গেছেন, একজন অসুস্থ। বাকি ৭ জনের মধ্যে ২ জনের শিল্পী ভাতা হয়েছে।

সীমান্ত আর প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও তাদের খোঁজ-খবর রাখেন না। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছে এসব শিল্পী।

উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাড়াইটারী গ্রামের বাসিন্দা এই থিয়েটার দলের সভাপতি ভানু বর্মণ। অসুস্থ শরীর হলেও তারই আয়ে চলে স্ত্রী আর মেয়েসহ ৫ জনের সংসার। ছয় শতকের ভিটাবাড়ি ছাড়া আর কোনো অর্থ সম্পদ নেই ভানু বর্মণের।

ভানু বলেন, ‘১৯৮৪ সাল থেকে এই দলে কাজ করছি। প্রায় ২১টি পালায় সুরের তালে তালে পুরুষ-মেয়ে কণ্ঠ দেই। আগে পুতুল নাচ দেখিয়ে প্রতি শোতে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা আয় হতো। তাই দিয়ে স্বচ্ছলভাবে চলছিল সংসার। কিন্তু গত ২০-২২ বছর থেকে পুতুল নাচ বন্ধ থাকায় অভাব আর অর্ধাহারে পরিবার নিয়ে দিন কাটে। মাঝে মধ্যে হঠাৎ সরকারি কোনো অনুষ্ঠানে পুতুল নাচের খেলা দেখালে তাই দিয়ে চলে।’

পুতুল নাচের কাহিনিগুলো যিনি তৈরি করেন, সেই পালাকার আবুল হোসেন বলেন, ‘পুতুল নাচ বন্ধ হয়ে গেছে। এখন সরকারিভাবে দু-একটি অনুষ্ঠানে ডাক পড়ে। এতে করে ৩০০-৪০০ টাকা পাই। আর সারা বছর দিনমজুরি করে সংসার চলে।’

তবলা বাদক স্বপন বর্মণ বলেন, ‘প্রায় ৩০ বছর ধরে এই পুতুল নাচের সাথে জড়িত। প্রযুক্তির যুগে এসে মানুষ আর পুতুল নাচ দেখে না। ফলে শো না থাকায় আয়ও কমে গেছে। সরকারিভাবে কোনো ভাতা জোটে না। স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যানরাও কোনো খোঁজ রাখেন না। ভিজিডি, ভিজিএফসহ সরকারের অনেক সুযোগ-সুবিধা আসলেও তারা আমাদের দেয় না। এতে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে।’

এলাকার বাসিন্দা সোহেল রানা বলেন, ‘যাত্রাপালার অশ্লীলতার চাপে বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচও এখন বন্ধ। ক্ষণিকের জন্য পুতুল নাচ দেখতে পেয়ে ৩০/৩৫ বছর আগের শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়। আগে ১/২ টাকায় টিকিট কিনে পুতুল নাচ দেখতাম। ঐতিহ্যবাহী এই পুতুল নাচ টিকিয়ে রাখতে সরকারে কাছে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।’

কুড়িগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ রাশেদুজ্জামান বাবু বলেন, ‘উত্তরবঙ্গের একমাত্র লাইসেন্সপ্রাপ্ত মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটার দলের দুই জন সরকারিভাবে ভাতা পাচ্ছেন। বাকিদের পর্যায়ক্রমে আনা হবে। পুতুল নাচ টিকিয়ে রাখতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি দাতা সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসার আহবান জানাই।’

এ বিভাগের আরো খবর