বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বাহারি এই কেকের পেছনের গল্পটি শুনুন

  •    
  • ১২ নভেম্বর, ২০২২ ১৮:৩৪

যে কক্ষে ডেকোরেশনের কাজ চলে সেখানে ফুড কালার, কোকো পাউডার থাকলেও একটি বাক্সে দেখা গেল মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ইন্ডাস্ট্রিয়াল কালার। এই রং মিশিয়েই বালতিতে নানা রঙের ক্রিম তৈরি করছেন কারখানার কর্মীরা।

জন্মদিন, বিয়েবার্ষিকীর মতো দিনগুলো কেক কেটে উদ্‌যাপন শহুরে জীবনে এখন খুব সাধারণ ঘটনা। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কেক দেদার বিক্রি হয় এসব উপলক্ষ ঘিরে। পরিচিত ব্র্যান্ড ছাড়াও পাড়া-মহল্লায় রয়েছে অনেক দোকান, সেখানেও পাওয়া যাচ্ছে বাহারি নানান কেক।

সুপরিচিত পেস্ট্রিশপে মান ভেদে প্রতি পাউন্ড ৫০০ থেকে ১০০০ টাকায় কেক বিক্রি হয়। পাড়ার বেকারি ও দোকানে এসব কেক মেলে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পাউন্ড হিসেবে। অপেক্ষাকৃত কম দামের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষই এসব কেকের প্রধান ক্রেতা।

এত কম দামে কেক কীভাবে তৈরি হচ্ছে তা অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা। এই অনুসন্ধানে রাজধানীর একটি কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে ভড়কে যাওয়ার মতো পরিবেশ। ভয়ংকর অস্বাস্থ্যকর, নোংরা পরিবেশের মাঝে ক্ষতিকর উপকরণ ও রং দিয়ে তৈরি হচ্ছে এসব কেক।

মর্নিং ফুড কারখানায় বানানো কেক

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার এলাকার হাসেম খান রোডের একটি দোতলা ভবন। সামনের অংশ মার্কেট আর পেছনে দিকটি ভাড়া দেয়া হয়েছে বিভিন্ন কারখানা হিসেবে।

এই ভবনের দোতলায় রয়েছে মর্নিং ফুড কারখানা

গেট দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই দেখা যায় শত শত কেকের বাক্স। নানান আকৃতির বাক্সগুলোর ডিজাইন মনকাড়া। পাশেই তিনটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে চলছে মর্নিং ফুড নামের কেক তৈরির কারখানা।

কারখানার কর্মীদের দম ফেলার ফুরসত নেই। কেউ কেকের ডেকোরেশন করছেন, কেউ ক্রিম তৈরি করছেন, আবার কেউ ব্যস্ত প্যাকিং নিয়ে। বিভিন্ন রঙের কেক দেখলেই জিভে পানি এসে যায়।

তবে চারদিকে অবিশ্বাস্য নোংরা ও দুর্গন্ধময় পরিবেশ। কারখানার তিনটি কক্ষই নোংরা ও স্যাঁতসেঁতে। কেকের খামির তৈরির জায়গাটির পাশেই আবর্জনার স্তূপ। পুরো কারখানা চষে বেড়াচ্ছে তেলাপোকা, মাছি ও পিঁপড়া।

ভেতরের দিকের একটি কক্ষ কেক তৈরির মূল জায়গা। সেখানে আছে একটি গ্যাস ওভেন, চুলা ও খামির তৈরির মেশিন। মাটিতে একটির ওপর আরেকটি করে অনেকগুলো ট্রেতে রাখা আছে তৈরি করা কেক। এগুলোর ওপর হামলে পড়ছে মাছি। খামির তৈরির মেশিনের সঙ্গে রাখা ডাস্টবিনে ডিমের খোসাসহ অন্য আবর্জনা উপচে পড়ছে।

এর পাশেই একটি পাত্রে দেখা গেল ‘চকলেট ক্রিম’। ডালডার সঙ্গে রং মিশিয়ে কয়েক দিন আগে তৈরি করা হয়েছে এই কথিত চকলেট ক্রিম। ওই কক্ষেই ডালডার মজুত ও বালতি ভর্তি লাল, হলুদ, সবুজ নানা রঙের বিভিন্ন ক্রিমও রয়েছে। এগুলো দিয়ে ময়দার তৈরি কেকের ওপর বাহারি নকশা করা হয়।

যে কক্ষে ডেকোরেশনের কাজ চলে সেখানে ফুড কালার, কোকো পাউডার থাকলেও একটি বাক্সে দেখা গেল মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ইন্ডাস্ট্রিয়াল কালার। এই রং মিশিয়েই বালতিতে নানা রঙের ক্রিম তৈরি করছেন কারখানার কর্মীরা।

পেছনের এই ভয়ংকর ধাপগুলো পেরিয়ে সুসজ্জিত কেকগুলো জায়গা পাচ্ছে আকর্ষণীয় বাক্সে।

এসব কেক সংরক্ষণের রেফ্রিজারেটরের দরজা খুলতেই আরও আতঙ্ক জাগে। কেকগুলোর সঙ্গেই রাখা হয়েছে কাঁচা মাছ-মাংস ও মসলা।

কারখানাটির মালিক কে সে বিষয়ে কর্মীদের কেউ কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। এমনকি নিজের নামও জানাননি কোনো কর্মচারী।

তারা জানান, ছয় মাস ধরে চলছে এই কারখানা। প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ পিস কেক সরবরাহ করা হয় আশপাশের বিভিন্ন দোকানে। রায়েরবাজার ও বেড়িবাঁধ এলাকার বিভিন্ন কনফেশনারি ও বেকারি দোকানিরাই তাদের প্রধান ক্রেতা। কারখানা থেকে প্রতি পাউন্ড কেক ১০০ টাকা করে বিক্রি হয়। আর সেগুলো বেকারি ও কনফেকশনারিতে বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পাউন্ড হিসাবে।

কেক তৈরির প্রক্রিয়া জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারখানার এক কর্মী নিউজবাংলাকে জানান, ময়দার সঙ্গে চিনি, ডিম ও তেল মিশিয়ে খামির তেরি করে ওভেনের মাধ্যমে মূল কেক তৈরি করা হয়। এরপর সেগুলো নানা আকৃতিতে কেটে তার ওপরে ক্রিম দিয়ে ডেকোরেশন করা হয়।

এই কারখানায় ভ্যানিলা ও চকলেট ফ্লেভারের দুই ধরনের বেসিক ক্রিম রয়েছে। ডালডার সঙ্গে রং, ফ্লেভার ও কোকো পাউডার মিশিয়ে এই ক্রিম তৈরি হয়। আকর্ষণ বাড়াতে লাল, সবুজ, হলুদসহ নানা রঙের ক্রিম তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল কালার।

এক কর্মী স্বীকার করেন, কারখানা চালাতে মালিকের কোনো ট্রেড লাইসেন্স বা বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নেই।

কোথায় যাচ্ছে এসব কেক

অত্যন্ত নিম্নমানের এসব কেকের গন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিষ্কার কোনো তথ্য দেননি মর্নিং ফুড কারখানার কর্মীরা। তারা জানান, বিভিন্ন দোকান থেকে লোক এসে অর্ডার দিয়ে নগদ টাকায় কিনে নিয়ে যান। তারা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো দোকানে কেক সরবরাহ করেন না।

তবে পরদিন কারখানার ওপর নজর রেখে নিউজবাংলা দেখতে পায় সকাল ১০টার কিছু পরে দুই ব্যক্তি সেখান থেকে দুটি সাইকেলে চড়ে বেরিয়ে যান। ঘণ্টাখানেক পর তারা সাইকেলের পেছনে কয়েকটি কেকের বাক্স নিয়ে কারখানায় ফিরে আসেন।

এক সাইকেল আরোহী বুলবুলকে প্রশ্ন করলে স্বীকার করেন তিনি কারখানার ডেলিভারি ম্যান হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী হিসেবে খণ্ডকালীন কেক তৈরি করেন।

তার কাজ হলো প্রতিদিন দুপুরের পর বিভিন্ন দোকানে অর্ডার অনুযায়ী কেক পৌঁছে দেয়া। আর পরদিন সকালে তিন দিনের বেশি পুরোনো কেক কারখানায় ফিরিয়ে আনা।

এভাবে বিভিন্ন দোকানে পাঠানো হয় মর্নিং ফুড কারখানার কেক

ঘটনার দিন সকালে তিনি দুই দোকান থেকে তিনটি পুরোনো কেক ফেরত এনেছেন।

কারখানার এক কর্মী নাম না প্রকাশ করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, দোকান থেকে ফিরিয়ে আনা বাসী কেকে আবার নতুন ক্রিম মাখিয়ে পরদিন ফের দোকানে সরবরাহ করা হয়।

তিনি বলেন, ‘পাউন্ড ১০০ টাকা দরে কেক বিক্রি করে খুব সীমিত লাভ হয়। এর মধ্যে যদি আবার কেক ফেরত আসে তাহলে ব্যবসা চলবে না। তাই আমরা পুরোনো কেকে আবার ক্রিম মাখিয়ে বিক্রি করি।’

দুপুরের পর কারখানা থেকে নতুন কেক নিয়ে সাইকেলে চড়ে বেরিয়ে যান ওই দুই ডেলিভারি ম্যান। একজনের পিছু নিয়ে দেখা যায় কারখানা থেকে কিছুটা দূরে হাসেম খান রোড বাজারের হৃদয় কনফেকশনারি ও ভাগ্যকুল মিষ্টিমুখ নামে দুটি দোকানে তিনি কেক পৌঁছে দিলেন। দোকানের কর্মচারীরা বেশ যত্ন নিয়ে এই কেক সাজিয়ে রাখেন।

দাম জানতে চাইলে ভাগ্যকুল মিষ্টিমুখ নামের দোকানের কর্মচারী ১ পাউন্ড কেকের দাম চান সাড়ে ৩০০ টাকা, আর দুই পাউন্ডের দাম ৬০০ টাকা। তবে দামাদামির পর ১ পাউন্ড কেক ২৫০ টাকায় দিতে রাজি হন তিনি।

দোকান মালিক আরাফাত রহমান লিংকন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পাশের একটি কারখানা থেকে এই কেকগুলো দিয়ে যায়। দুই ধরনের কেক হয়। হাই কোয়ালিটি আর লো কোয়ালিটি। হাই কোয়ালিটির কেক বাটার দিয়ে তৈরি হয় আর লো কোয়ালিটির কেক ডালডা দিয়ে।

‘তবে এই এলাকায় হাই কোয়ালিটি কেক খুব একটা চলে না। মাঝে মাঝে কেউ অর্ডার করলে আমরা কারখানাকে হাই কোয়ালিটি কেক দিতে বলি। এ ধরনের কেক প্রতি পাউন্ড ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়।’

লিংকন জানান, সাধারণত তিনি লো কোয়ালিটির কেক অর্ডার করেন, কারণ এই কেক সস্তা হওয়ায় চাহিদা বেশি।

বাসী কেক ফেরত দেয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কারখানার সঙ্গে আমার কনট্রাক্ট হলো বিক্রি না হলে ফেরত নিয়ে নতুন কেক দেবে। এটাই হয় সব জায়গায়।’

বাসী কেকের ওপর ক্রিমের নতুন প্রলেপ দেয়া এবং কারখানায় নোংরা পরিবেশের তথ্য জানেন কি না, এমন প্রশ্নে লিংকনের দায়সারা জবাব, ‘এত কিছু আমাদের জানতে হয় না, এত কিছু জানলে ব্যবসা করা যাবে না।’

এ বিভাগের আরো খবর