রাসলীলা মণিপুরি সম্প্রদায়ের একটি ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় উৎসব হলেও এখন তা আকৃষ্ট করছে সম্প্রদায়ের বাইরের মানুষকেও। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে রাস উৎসবে প্রতিবছর নানা জাতিধর্মের লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটছে।
দেশের অন্য কোনো নৃগোষ্ঠীর লোক উৎসব এত বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি।
রাস উৎসব ছাড়াও মণিপুরি নাচ সিলেট-মৌলভীবাজার অঞ্চলের শিল্পকলায় একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ধর্মীয় আচার থেকে এই নাচ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হয়ে ওঠার পাশাপাশি প্রচারের আলোয় আসার গল্পটি চমকপ্রদ।
বাঙালি সংস্কৃতির অনেক মণিমুক্তো খুঁজে বের করার মতো মণিপুরি নাচের সুবাস ছড়িয়ে দেয়ার পেছনেও জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের নাম। তার উদ্যোগেই মণিপুরি নাচ অন্য জাতিগোষ্ঠীর কাছেও পরিচিতি পায়।
সিলেটের প্রবীণ নৃত্যগুরু অনিল কিষান সিংহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কল্যাণেই লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা মণিপুরি নৃত্য প্রচারের আলোয় আসে। রবীন্দ্রনাথ সিলেটে এসে প্রথম মণিপুরি নৃত্য দেখেন। এতে মুগ্ধ হয়ে শান্তিনিকেতনে এই নাচের চর্চা শুরু করেন। এরপর থেকেই মণিপুরি নৃত্য সব মহলে সমাদৃত হতে থাকে। বিভিন্ন জায়গায় সাংস্কৃতিক উৎসবগুলোতে মণিপুরি শিল্পীরা আমন্ত্রণ পেতে শুরু করেন।’
তিনি বলেন, ‘মণিপুরিদের কাছে নৃত্য তাদের ধর্মীয় আচারের অংশ। এখন এটি এই অঞ্চলের সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। মণিপুরি নৃত্যের প্রচারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসামান্য অবদান রেখেছেন।’
রবীন্দ্রনাথের সিলেট সফর
১৯১৯ সালে অবকাশ যাপনের জন্য অভিভক্ত ভারতের আসাম রাজ্যের তখনকার রাজধানী শিলংয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেখানে অবস্থানের সময় শ্রীহট্ট ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে তাকে সিলেট সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ওই বছরের ৫ নভেম্বর ছেলে ও ছেলেবউকে নিয়ে সিলেট আসেন রবীন্দ্রনাথ।
৫ নভেম্বর সকালে সুরমা নদীর ঘাট চাঁদনী ঘাটে শঙ্খধ্বনি বাজিয়ে শোভাযাত্রাসহ সিলেটে স্বাগত জানানো হয় কবিকে। সিলেটে তিন দিন অবস্থান করেন কবি।
ভ্রমণকালে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে মুগ্ধ হয়ে সিলেটকে নিয়ে একটি কবিতাও লেখেন রবীন্দ্রনাথ। সে সময় বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে সিলেটকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। এ নিয়ে আক্ষেপও ফুটে ওঠে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়। শতবর্ষ পরেও সিলেটের বর্ণনা দিতে গিয়ে এখনও অনেকে দ্বারস্থ হন সেই কবিতার-
মমতাবিহীন কালস্রোতে/ বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হতে/ নির্বাসিতা তুমি/ সুন্দরী শ্রীভূমি।/ ভারতী আপন পুণ্য হাতে/ বাঙালির হৃদয়ের সাথে/ বাণীমালা দিয়া/ বাঁধে তব হিয়া/ সে বাঁধনে চিরদিনতরে তব কাছে/ বাঙলার আশীর্বাদ গাঁথা আছে।
সিলেটে ভ্রমণকালে ৬ নভেম্বর টাউন হল প্রাঙ্গণে ও ৭ নভেম্বর মুরারীচাঁদ (এম সি) কলেজের ছাত্রাবাসের উদ্যোগে কবিকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। টাউন হলে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা ‘বাঙালীর সাধনা’ নামে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার আর এম সি কলেজের বক্তৃতার সারমর্ম ‘আকাঙ্ক্ষা’ নামে ‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
সিলেট অঞ্চলে কবিগুরুর সফরের প্রামাণ্য দলিল
টাউন হল প্রাঙ্গণে সংবর্ধনা মঞ্চের টেবিল মোড়ানো ছিল মণিপুরিদের তাঁতের কাপড়ে। এটি পছন্দ হয় রবীন্দ্রনাথের। এই কাপড়ের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে তিনি মণিপুরিদের সম্পর্কে জানতে পারেন। এরপর মণিপুরিদের তাঁতশিল্প ও তাদের জীবনযাত্রা দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন কবি।
মাছিমপুরে রবীন্দ্রনাথ
কবির আগ্রহে পরদিন ৬ নভেম্বর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় নগরের মাছিমপুর মণিপুরিপাড়ায়। সেখানকার বাসিন্দারা বর্ণাঢ্য আয়োজনে বরণ করেন কবিগুরুকে। কবির সম্মানে আয়োজন করা হয় মণিপুরি নৃত্যের।
‘শ্রীভূমি সিলেটে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের লেখক কবি ও গবেষক অধ্যাপক নৃপেন্দ্রলাল দাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘৬ নভেম্বর বিকেল ৩টার দিকে মাছিমপুর মণিপুরিপাড়ায় আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিকে স্বাগত জানাতে এখানকার বাসিন্দারা সড়কে সারি সারি কলাগাছ পুঁতে তোরণ নির্মাণ করেন। প্রতি গাছের গোড়ায় মঙ্গলঘট ও আমপাতার সজ্জা করেন। মাছিমপুরে আসার পর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যাওয়া হয় গোপীনাথ জীউ মন্দিরে।’
নৃপেন্দ্রলাল বলেন, ‘মণ্ডপে কবির উদ্দেশে মণিপুরি ছেলেমেয়েরা রাখালনৃত্য পরিবেশন করেন। রাধা-কৃষ্ণের প্রেম নিয়ে এই রাখাল নৃত্যের কাহিনি। এরপর রাসনৃত্যের আয়োজনও করা হয়। তবে কবি ক্লান্ত বোধ করায়, রাসনৃত্য না দেখেই নয়াসড়ক টিলার ওপরে ফাদার টমাসের বাংলোয় ফিরে আসেন।
‘সিলেট সফরকালে এখানেই তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এরপর সন্ধ্যায় মণিপুরি ছেলেমেয়েরা তার বাংলোয় এসে রাসনৃত্য পরিবেশন করেন, যা মুগ্ধ করে রবীন্দ্রনাথকে।’
কৃষ্ণপ্রেমের লীলা তথা মণিপুরিদের রাসলীলার নাচে মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শান্তিনিকেতনে মণিপুরি নৃত্য
মণিপুরি নৃত্যের সজ্জা, সাবলীল ছন্দ ও সৌন্দর্যে বিমোহিত হন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের মণিপুরি নৃত্য শেখানোর আগ্রহ প্রকাশ তিনি।
সিলেটে রবীন্দ্রনাথের সামনে যে মণিপুরি নৃত্য পরিবেশিত হয় তা পরিচালনায় ছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি নৃত্যশিল্পী ইমাগো দেবী। ইমাগো দেবীকে কবিগুরু শান্তিনিকেতনে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। তবে মণিপুরিদের কঠোর সামাজিক বিধিনিষেধের কারণে ইমোগা রাজি হননি। তবে এতে দমে যাননি রবীন্দ্রনাথ।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ফারজানা সিদ্দিকা তার ‘সিলেটে রবীন্দ্রনাথ: শতবর্ষে ফিরে দেখা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ মণিপুরী নৃত্যকলায় এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, কলকাতায় ফিরবার পথে ত্রিপুরার রাজার সাহায্য নিয়ে একজন নাচের শিক্ষককে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যান সেখানকার শিক্ষার্থীদের নাচ শেখাবার জন্যে।’
কেবল শিক্ষক নিয়োগ নয়, শান্তিনিকেতনে মণিপুরি নৃত্যের জন্য আলাদা শাখা গঠন করা হয়। পরবর্তীকালে রবীন্দ্ররচনাতেও পাওয়া যায় মণিপুরি নৃত্যের প্রভাব। রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা, চণ্ডালিকা, মায়ার খেলা, নটীর পূজা, শাপমোচন নৃত্যনাট্যে মণিপুরি নৃত্যেও সুর ও তাল অনুসরণ করা হয়েছে।
রবীন্দ্র কালচারাল একাডেমি গঠনের দাবি
সিলেট নগরের মাছিমপুর এলাকার মণিপুরিপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, যে মণ্ডপে রবীন্দ্রনাথ এসে মণিপুরি নৃত্য দেখেছিলেন তার পাশেই উঁচু বেদীর ওপর কবিগুরুর আবক্ষ ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে।
ভাস্কর্যের কয়েক ফুট সামনেই মণ্ডপটি। পুরোনো মণ্ডপের টিনের চালে লাগানো সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ‘শ্রী শ্রী গোপীনাথ জিউর আখড়া। স্থাপিত ১৮৮০ সন।’
সাইনবোর্ড জানান দিচ্ছে, মণ্ডপের বয়স ১৪২ বছর। এখানেই ১৯১৯ সালের ৬ নভেম্বর এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
২০১৯ সালে সিলেটে মহাসমারোহে পালিত হয় ‘শ্রীহট্টে রীবন্দ্রনাথ: শতবর্ষে স্মরণোৎসব’। তার আগের বছর সিলেট সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত মাছিমপুরে নির্মিত হয় রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি।
তবে ঐতিহাসিক মণ্ডপটি দীর্ঘদিনেও সংস্কার করা হয়নি, এর জায়গাও বেদখল হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
বাংলাদেশ মণিপুরি সমাজকল্যাণ সমিতি, সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সংগ্রাম সিংহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাছিমপুরে মণিপুরি-রবীন্দ্র কালচারাল একাডেমি গঠনের দাবি দীর্ঘদিনের। মন্ত্রী-মেয়রসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা বরাবর আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।’
রাস উৎসব কী
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাস মূলত শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলার অনুকরণে বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় অনুষ্ঠিত ধর্মীয় উৎসব।
‘রাস’ শব্দটি এসেছে ‘রস’ থেকে। ‘রস’ মানে আনন্দ, দিব্য অনুভূতি, দিব্য প্রেম। ‘লীলা’ অর্থ নৃত্য। রাসলীলা মূলত পুরাণের কৃষ্ণ ও বৈষ্ণব সাহিত্যের চরিত্র রাধার অপ্রাকৃত প্রেমলীলার একটি আখ্যান। বৃন্দাবনের গোপীদের নিয়ে রাধা ও কৃষ্ণ এই রাস করেন।
বাংলাদেশ মণিপুরি সাহিত্য সংসদের সভাপতি কবি একে শেরাম নিউজবাংলাকে বলেন, ’পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মহামিলনই রাস। পরমাত্মা হচ্ছেন ঈশ্বর, মানে শ্রীকৃষ্ণ। আর জীবাত্মা হলেন রাধা ও গোপীরা, যারা পুণ্যবলে কৃষ্ণের সান্নিধ্যলাভ করেছেন।’
তিনি বলেন, ’রাসনৃত্য একধরনের বৃত্তাকার নাচ যা আট, ষোলো বা বত্রিশজনে সম্মিলিতভাবে উপস্থাপনা করা যায়।’
প্রতিবছরের মতো এবারও কার্তিকের পূর্ণিমায় মঙ্গলবার সকাল থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে রাস উৎসব হবে।
কমলগঞ্জের আদমপুরের নৃত্যগুরু ধীরেন্দ্র কুমার সিংহ বলেন, ‘মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে রাখাল নৃত্য শুরু হবে। সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাত সাড়ে ১১টার দিকে শুরু হবে রাস নৃত্য, যা পরদিন ভোর পর্যন্ত চলবে।’