বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন যুবকেরাও, চিকিৎসায় দেরিতে ক্ষতি বেশি

  •    
  • ২৯ অক্টোবর, ২০২২ ১৪:১৮

ইদানীং ৩০ বয়সের নিচে রোগী ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে, যাদের বেশির ভাগের খাদ্যাভ্যাস স্বাস্থ্যকর ছিল না। আবার আক্রান্ত হওয়ার ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয় সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে না নেয়ায়। মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম থাকায় স্ট্রোকের লক্ষণগুলো তারা বুঝতে পারে না বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপিতে গত তিন মাসে স্ট্রোকের রোগী ভর্তি হয়েছেন আড়াই শর বেশি। এর আগে কখনও এত বেশি রোগীর দেখা মেলেনি। অন্য বছর প্রতি তিন মাসে রোগী থাকত এক শর আশপাশে।

রোগীর সংখ্যা লাফ দেয়ার পাশাপাশি আরও একটি বিষয় ভাবিয়ে তুলেছে সেখানকার কর্মীদের। সেটি হলো কম বয়সীরাও ভর্তি হতে আসছেন সেখানে।

সিআরপির ফিজিওথেরাপি বিভাগের কনসালট্যান্ট ফারজানা শারমিন জানিয়েছেন, গত তিন মাসে আসা রোগীদের মধ্যে ৮ জনের বয়স ৩০ বছরের কম। ৫ জনের বয়স ৩০ থেকে ৪০-এর মধ্যে, আরও ৮ জনের বয়স ৫০-এর ঘরে। এই বয়সীদের মধ্যে স্ট্রোকের প্রবণতা নতুন।

সিআরপির একজন চিকিৎসক জানান, রোগীদের ইতিহাস পর্যালোচনা করে তারা জেনেছেন, এই কম বয়সীদের খাদ্যাভ্যাস স্বাস্থ্যকর ছিল না। তারা বাইরের তৈলাক্ত খাবার বেশি পছন্দ করতেন। তা ছাড়া শারীরিক পরিশ্রম করতেন কম।

স্ট্রোকের রোগীদের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসালয় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্সের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক জানান, তাদের এখানে ৫০০টি শয্যার মধ্যে ৩০০টি বরাদ্দ স্ট্রোকের রোগীদের জন্য। এসব শয্যার প্রতিটিতে রোগী ভর্তি আসছে। ইদানীং রোগীর চাপ আরও বেড়েছে। তাদের ভর্তি করাতে না পেরে অন্য হাসপাতালে পাঠান তারা।

২০১৮ সালে করা একটি গবেষণায় বলছে, দেশে প্রতি হাজার রোগীর মধ্যে ১১ দশমিক ৩৯ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত। হাসপাতালের ইনডোর এবং আউটডোরে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের ওপর জরিপের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে এসেছে তারা।

বাংলাদেশের মতো গোটা বিশ্বেই স্ট্রোক মানুষের মৃত্যুর একটি বড় কারণ। বিশ্বে প্রায় ১৭ মিলিয়ন মানুষ প্রতিবছর এতে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়।

মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় যেসব কারণে, তার মধ্যে স্ট্রোকের অবস্থান তৃতীয়। এতে আক্রান্ত হওয়ার পর যারা জীবিত থাকেন তারা বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভোগেন।

স্ট্রোকের ফলে মস্তিষ্কের রক্ত সরবরাহে বাধা ঘটে এবং এতে মস্তিষ্কের কোষের মৃত্যু হয় তাই পরবর্তী সময়ে মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি কার্যক্ষমতা হারায়।

নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শিরাজী শাফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে নেয়া জরুরি। এই সময়ের মধ্যে চিকিৎসা দেয়া না গেলে রোগীর ক্ষতি বেশি হয়। কিন্তু মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম থাকায় রোগী আসে দেরিতে।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সঠিক সময়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় না আর তাই সঠিক চিকিৎসাও পায় না। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি এবং ক্যাম্পেইন করছি যেন মানুষ এগুলো সম্পর্কে জানে।’

এই সচেতনতার জোর দিয়ে শনিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘না করলে সময়ক্ষেপণ, স্ট্রোক হলেও বাচঁবে জীবন।’

লক্ষণ কী কী

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে প্রথমেই কথা জড়িয়ে যায়। হাত-পা একদিকে অবশ হয়ে যায়। হাঁটতে গিয়ে তিনি হঠাৎ পড়ে যেতে পারেন বা কাজ করতে গিয়ে টেবিলে পড়ে যেতে পারেন।

হঠাৎ করে রোগী অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে বা কাজে অমনোযোগীও হয়ে যেতে পারে। আবার এমন হতে পারে হাঁটতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন। চিকিৎসকেরা এই লক্ষণগুলোকে সংক্ষেপে BE FAST বলে থাকেন।

এখানে B মানে Balance, অর্থাৎ ভারসাম্য রাখতে না পারা।

E মানে Eye, অর্থাৎ হঠাৎ চোখে দেখতে না পাওয়া।

F মানে Face, অর্থাৎ মুখ যদি একদিকে বেঁকে যায়।

A মানে Arm, অর্থাৎ হাত অবশ হয়ে যাওয়া।

S মানে Speed, অর্থাৎ গতি কমে যাওয়া বা কথা জড়িয়ে যাওয়া।

T মানে Time, অর্থাৎ যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া।

অধ্যাপক শিরাজী জানান, স্ট্রোক দুই ধরনের হয়। ১. রক্তনালি ব্লক হয়ে যায়, ২. মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ।

তিনি বলেন, লক্ষণগুলো দেখা দিলে যদি সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে কোনো বিশেষায়িত হাসপাতালে নেয়া যায়, তাহলে তাকে একটি ইনজেকশন দিতে হয়। এর নাম অ্যাল্টিপ্লেস।

যদি কোনো রোগীর মস্তিষ্কের রক্তনালি বন্ধ হয়ে যায় অর্থাৎ ব্লক হয়ে যায় তাহলে এই ইনজেকশনে বন্ধ রক্তনালি খুলে যাবে। এতে স্ট্রোকের প্যারালাইজড থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। স্ট্রোক দুই ধরনের হয়।

সাড়ে চার ঘণ্টা পার হলে কী করবেন

রোগীকে হাসপাতালে নিতে সাড়ে চার ঘণ্টার বেশি সময় লেগে গেছে কী হবে?

অধ্যাপক শিরাজী বলেন, ‘সে ক্ষেত্রেও চিকিৎসা হতে পারে। এটি অনেক দেশেই চালু রয়েছে। ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, আমেরিকায় সাড়ে চার ঘণ্টা পার হলেও স্ট্রোকের ট্রিটমেন্ট দেয়া যায়। এখন বাংলাদেশেও আমরা সেটি চালু করে করেছি।

‘এ ক্ষেত্রে এই রোগীকে এনজিওগ্রাম করে ব্রেনের ভেতর থেকে ওই জমাট রক্ত বের করে আনা হয়। এই বের করে আনার পদ্ধতিকে বলে মেকানিক্যাল থ্রম্বেকটমি। এটি লক্ষণ দেখা দেয়ার ৯ ঘণ্টার মধ্যে করা হয়। এই চিকিৎসা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্স হসপিটালে রয়েছে। ইউনাইটেড হসপিটালেও আমরা চালু করতে যাচ্ছি।’

স্ট্রোকের যেসব কারণ

অধ্যাপক শিরাজী জানান, উচ্চ রক্তচাপ, বেশি কোলেস্টেরল বা চর্বির পরিমাণ বেশি থাকলে ডায়াবেটিস বা মদ্যপান, ধূমপান, তামাকজাতীয় দ্রব্য সেবন, পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদি এর কারণ। স্ট্রোকে সাধারণত ৫৫ বছর বা তার বেশি বয়সী পুরুষদের এতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

যেমন বয়স ৪০-এর বেশি হলে পারিবারিক ইতিহাস থাকলে অর্থাৎ মা, খালা, বাবা, চাচা, এদের আগে স্ট্রোক হয়ে থাকলে, উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস থাকলে বয়স যদি ৪০-এর নিচেও হয় এবং তার কোনো রোগ না থাকে, তারপরেও স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ।

শিশু বা গর্ভবতী মায়েরাও স্ট্রোকে আক্রান্ত হযতে পারেন। যেসব শিশু আক্রান্ত হয় তাদের সাধারণত জন্মগত ত্রুটি থাকে অর্থাৎ তাদের মস্তিষ্কের রক্তনালিগুলো জন্মগতভাবে ত্রুটিযুক্ত থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি চিকন হয়ে যায় এবং একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়।

স্ট্রোকের আরেকটি কারণ হৃদরোগ বলে জানান চিকিৎসকেরা।

জন্মনিরোধক পিল ও ইনজেকশন স্ট্রোকের আরেকটি কারণ হতে পারে। যারা এই পিল ও ইনজেকশন নেন, তাদের উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তাদের রক্ত ঘন থাকে এবং কম বয়সে স্ট্রোক হতে পারে।

জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নারীরা কোন পিল খাবেন, কীভাবে নিরাপদে খাবেন বা খাবেন কি না, সেটি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিতে হবে। নিরাপদ হচ্ছে 'কপার্টি' ব্যবহার করা। এটি একটি ডিভাইস যা জরায়ুর মধ্যে রেখে দেয়া হয়। এটি ১০ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। তা ছাড়া ছেলেদের কনডম ব্যবহার করতে হবে।

সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা হলে পানিস্বল্পতা এবং অপারেশনের কারণে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বেড়ে যায়। এ থেকেও স্ট্রোক হতে পারে। সাধারণত সিজার হওয়ার ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি থাকে। তাই সিজারের পর পানি খেতে হবে বেশি।

মাইল্ড স্ট্রোক বলতে কিছু নেই

অধ্যাপক শিরাজী বলেন, ‘আমরা অনেক সময় বলি মাইল্ড স্ট্রোক করেছে। কিন্তু আমরা কোনটাকে মাইন্ড স্ট্রোক ধরে নেব? এ রকম সুনির্দিষ্ট কোনো টার্ম নেই।

‘মাইল্ড বা সিভিয়ার এমন কোনো মেডিক্যাল টার্ম স্ট্রোকের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় না। সাধারণত কম ক্ষতি হলে অনেকে বলেন মাইন্ড বা ছোটখাটো স্ট্রোক। যদি পুরো শরীর অবশ হয়ে যায় বা প্যারালাইজড হয়ে যায় অথবা বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যায়, তখন সিভিয়ার স্ট্রোক বলে। কিন্তু মেডিক্যালের ভাষায় স্ট্রোকের আলাদা কিছু নেই। ফলাফল সব ক্ষেত্রে প্রায় কাছাকাছি।’

সিআরপির ফিজিওথেরাপির বিভাগীয় প্রধান আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘সাধারণত দুই ধরনের স্ট্রোক রয়েছে। ১. মস্তিষ্কের রক্ত সংরোধজনিত এবং অন্যটি রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক। দুই কারণেই মস্তিষ্কের কিছু অংশ ঠিকমত কাজ করতে পারে না।’

স্ট্রোকের ঝুঁকি রোধে করণীয় ও ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব

চিকিৎসকেরা জানান, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনমান ঠিক রাখলে স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকটা কমানো যায়।

আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন ২০১৪ সালে স্ট্রোক প্রতিরোধের কিছু নিয়ম প্রকাশ করেছে। যেমন উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে জানা এবং নিয়ন্ত্রণ করা। ধূমপান না করা এবং ভারী মদ্যপান না করা বা বিরত থাকা, নিয়মিত ব্যায়াম করা।

এ ছাড়া শাকসবজি বেশি খাওয়া, মাখন বা ঘি কম খাওয়া, খাবারে সোডিয়ামের পরিমাণ কমানো, রক্তে কোলেস্টরেলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, শরীরের ওজন ঠিক রাখা, দুশ্চিন্তা না করলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

এ বিভাগের আরো খবর