হোটেলে ঢুকতেই চোখে পড়ে ইংরেজিতে বড় করে ‘রিসিপশন’ লেখাটি। তার নিচে বিদেশি ভাষায় কিছু লেখা। যারা এই অঞ্চল সম্পর্কে জানেন না বা ইংরেজি পড়তে পারেন না, তারা সহজে বুঝতে পারবেন না বিষয়টা।
বলছি পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরের কথা। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মীদের সুবাদে এ অঞ্চল যেন এক টুকরা রাশিয়া।
পুরো এলাকাটি রুশ সংস্কৃতির নতুন ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দোকানের সাইনবোর্ড থেকে শুরু করে মূল্য তালিকায় বাংলাকে হটিয়ে ইংরেজির পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে রাশিয়ান ভাষা।
২০১৬ সালের জুলাই থেকে রূপপুরে রাশিয়ার অর্থায়নে চলছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ। গত ছয় বছরে এলাকাটির পরিবর্তন হয়েছে অনেকভাবে, তবে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন এসেছে ভাষাগত।
বিকেলের পর রূপপুর অঞ্চলের দোকানপাট, শপিংমলে চলে রুশদের রাজত্ব। দোকানে দোকানে বিক্রি বাড়ে। চলে রুশ ভাষায় কথা আদান-প্রদান।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরুর কয়েক মাস পর থেকেই শুরু হয় রূপপুরের পরিবর্তন। অবকাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে কয়েক হাজার রুশ ভাষাভাষীর বসবাসের জন্য সেখানকার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জীবনযাত্রায় পড়ে ব্যাপক প্রভাব।
রূপপুরে রুশ নাগরিকদের থাকার জন্য রয়েছে গ্রিন সিটি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১০ মিনিট দূরে এ সিটির অবস্থান। আর গ্রিন সিটির সামনেই গড়ে উঠেছে রুশদের জন্য আধুনিক মার্কেট ও দোকান।
রূপপুরের রিসোর্ট ও হোটেলগুলোতে প্রতিটি নির্দেশক বোর্ডে ইংরেজির পাশাপাশি রয়েছে রাশিয়ান ভাষা।
‘স্বপ্নদ্বীপ রিসোর্ট’ নামের রেস্তোরাঁর বয় মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে খাবারের মেন্যু থেকে শুরু করে সবকিছুতেই রাশিয়ানদের জন্য আলাদা গুরুত্ব দেয়া আছে। মেন্যুতে রাশিয়ান খাবারের আলাদা তালিকা আছে।’
মামুন বলেন, ‘রিসোর্টের ৭০ ভাগ কাস্টমার রাশিয়ার নাগরিক। আমাদের খাবারের মেন্যু উনারা মোবাইলের অ্যাপের মাধ্যমে রাশিয়ান ভাষায় বুঝে নেন।’
রুশদের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে রূপপুরের দোকানপাটেও আমূল পরিবর্তন এসেছে। মোবাইল রিচার্জ থেকে শুরু করে সেলুন, কাঁচাবাজার, ফলের দোকান, চায়ের দোকান—কিছুই বাদ যায়নি ভাষাগত বদল থেকে। অনেক খাবারের দোকান শুধু রুশদের জন্যই চালু হয়েছে। বাইরে আলাদা করে লেখাও আছে রাশিয়ান ভাষায়।
রাস্তায় টি-শার্ট বা প্যান্ট বিক্রি করেন মোখলেস। এর আগে তিনি প্রকল্পে চাকরি করেছেন। প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুন করে ব্যবসা শুরু করা মোখলেসের দোকানে ভিড় করেন রাশিয়ার নাগরিকরা। তারা কথা বলেন ইংরেজিতে।
মোখলেস বলেন, ‘প্রতিদিন ভালো বিক্রি হয়। উনারা যখন (রাশিয়ার নাগরিক) দেশে ফিরে যান, তখন যাওয়ার আগে প্রচুর জামাকাপড় কিনে নেন। এখন শীতের সময়। অনেকেই ফিরে যাবেন।’
বিক্রির নিয়ম জানিয়ে মোখলেস বলেন, ‘রাশিয়ানদের জন্য ফাইভ জিরো জিরো আর আমাদের জন্য থ্রি জিরো জিরো। এখানে দাম ৫০০ আর ৩০০ টাকা।’
পাশেই জুতার দোকানে দেশীয় কোনো সাইজের জুতা পাওয়া গেল না। বাংলাদেশিদের যেখানে স্বাভাবিক পায়ের মাপ ১০ ধরা হয়, সেখানে রূপপুরে জুতার দোকানগুলোতে মাপ দশের বেশি থেকে শুরু হয়।
দোকানে ঢুকতেই এক রাশিয়ানকে জুতা খুঁজতে দেখা যায়। পছন্দমতো সাইজ মিলে গেলে খুব অল্প ভাষায় দাম নির্ধারণ করা হয়।
দোকানি বলেন, ‘এখানে আমাদের সঙ্গে উনাদের বেশি দামাদামি হয় না। আমরা ইংরেজি বলি, উনারা হয়তো একটু কম বলেন। ব্যবসা ভালো। আর বাইরের দেশের মানুষ বলে আমরাও বেশি দামাদামি করতে চাই না।’
বাংলাদেশ নিয়ে রাশিয়ান নাগরিকদের অভিজ্ঞতা ভালো বলে জানান দোকানে আসা রুশ নাগরিকরা। প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত এক রাশিয়ান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এখানে ভালো আছি। এখানের মানুষ আমাদের প্রতি আন্তরিক।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের দ্বিতীয় চুল্লির উদ্বোধন করবেন। এ উপলক্ষে নেয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। রূপপুরের লোকজনের বিশ্বাস, প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও রাশিয়ার নাগরিকরা থেকে যাবেন এখানেই।