বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

লক্ষ্মী পূজায় কারও প্রতিমা, কারও কেন ঘট-সরা

  •    
  • ৯ অক্টোবর, ২০২২ ১৫:৪৭

লক্ষ্মীপূজার আয়োজনে ভিন্নতার ক্ষেত্রে ধর্মীয় কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বলে জানাচ্ছেন পুরোহিতরা। আর গবেষকেরা মনে করছেন লক্ষ্মী পূজায় প্রতিমা, ঘট বা সরা ব্যবহারের রীতি মূলত আঞ্চলিক সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত।

আশ্বিন মাসের শেষে পূর্ণিমা তিথিতে রোববার কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা করছে হিন্দু সম্প্রদায়। মনে করা হয়, এ পূর্ণিমার রাতে দেবী লক্ষ্মী স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে আসেন।

লক্ষ্মী পূজা হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় সবার বাড়িতে করা হলেও অনেকেই প্রতিমার পরিবর্তে অন্য আয়োজনে দেবীর আরাধনা করেন। কেউ পূজা করেন লক্ষ্মীসরায়, আবার কেউ স্থাপন করেন ঘট। পূজার আয়োজনে কেন এই ভিন্নতা তা নিয়ে পূজারী, পুরোহিত ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা।

টাঙ্গাইলের সদরের ধানাপাড়া গ্রামে উত্তম কুমার ঘোষের বাড়িতে প্রতিবছরই লক্ষ্মীপূজা হয় সরায়।

কারণ জানতে চাইলে উত্তম কুমার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটি আমাদের বংশপরম্পরায় করা হয়ে থাকে। আমরা শুনেছি তিন ভাবে লক্ষ্মীপূজা করা হয়ে থাকে- ঘট, পট ও মূর্তিতে। আমাদের বাড়িতে সরায় করা হয়।’

নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার গালিমপুরের প্রতাপ রায়ের বাড়িতে এই পূজা করা হয় মূর্তিতে। এর সুনির্দিষ্ট কারণ জানা নেই প্রতাপ রায়ের। তিনিও বলছেন বংশপরম্পরায় প্রতিমায় পূজার রীতি চলে আসায় তিনি এর বাইরে যাননি।

ফরিদপুরের মধুখালি উপজেলার ডুমাইন বোস বাড়িতে লক্ষ্মী পূজায় প্রতিমা ও ঘট দুটিই রয়েছে। এই বাড়ির মৌসুমি রায়ও বললেন ‘বংশপরম্পরায় মেনে চলা রীতির কথা।’

প্রতিমা ছাড়াও যত রূপে পূজিত লক্ষ্মী

প্রচলিত রীতি অনুযায়ী মাটির লক্ষ্মী প্রতিমায় ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা করেন অনেকে। ‘কোঃ’ শব্দের অর্থ- ‘কে’, আর ‘জাগর’ শব্দের অর্থ ‘জেগে আছে’। সবমিলিয়ে কোজাগরী শব্দের অর্থ হলো ‘কে জেগে আছে?’

প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, এই পূর্ণিমার রাতে জেগে থাকতে হয়। মনে করা হয়, এ দিন রাতে দেবী পৃথিবীতে এসে ভক্তদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আশীর্বাদ করেন। এ জন্য বাড়ির দরজা খুলে রেখে সারারাত জেগে লক্ষ্মীর আরাধনা করতে হয়। ভক্তরা বিনিদ্র থেকে লক্ষ্মী পূজা করেন বলে এ রাতকে বলা হয় কোজাগরী পূর্ণিমা।

কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় প্রতিমা ছাড়াও নানারূপে দেবীর আরাধনা করা হয়, যার একটি হলো লক্ষ্মীসরা বা লক্ষ্মীপট।

লক্ষ্মীসরা

বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, লক্ষ্মীপটের উদ্ভব বাংলাদেশে। লক্ষ্মীসরা মোটামুটি চার রকমের। এর মধ্যে ঢাকাই সরার উদ্ভব ঢাকা অঞ্চলে। এ সরার চারদিকের কিনারা খানিকটা উঁচু, মাঝখানের অংশটি খুব উঁচু নয়। এর উপরে সাদা রঙের প্রলেপ দেয়া থাকে। নারায়ণ ও লক্ষ্মীকে এই সরায় পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থায় আঁকা হয়। তাদের হাতে থাকে ফসলের শীষ।

এছাড়া আছে ফরিদপুর অঞ্চলের ফরিদপুরী সরা। এ ধরনের সরায় প্রতিমা আঁকায় স্থানবিভাজন ও পটভূমি সাদা রাখা হয়। ঢাকাই সরার মতোই এই সরার কানাটি শুধু উঁচু করা হয় না।

ফরিদপুরের একটি গ্রাম সুরেশ্বরে তৈরি হয় আরেক ধরনের সরা, যার নাম সুরেশ্বরী সরা। এই সরার গোলাকার জায়গা পাঁচটি খাড়া প্যানেলে ভাগ করা হয়। মধ্যভাগের প্যানেলে থাকেন প্রধান দেবী দুর্গা। এই প্যানেলের ওপরের ছোট প্রকোষ্ঠে আঁকা হয় দুর্গার স্বামী শিবকে। বাম পাশের দুই খাড়া প্রকোষ্ঠে লক্ষ্মী ও গণেশ এবং ডানদিকে সরস্বতী ও কার্তিককে আঁকা হয়।

অনেকটা সাদামাটা দেখতে ‘গণকীসরা’ সাধারণত ব্যবহৃত হয় নিম্নবর্ণের হিন্দু সমাজের লক্ষ্মীপূজায়। এই সরার পটভূমি ঘন লাল। উপরের অর্ধাংশ অপেক্ষাকৃত বড়। এই সরার কানায় কালো রং ব্যবহার করা হয়। এই পটের প্রধান দেবীমূর্তি হলেন দুর্গা ও তার পরিবার। নিচের প্যানেলে থাকে লক্ষ্মী ও তার বাহন পেঁচা।

লক্ষ্মীঘট

লক্ষ্মীঘট

অনেকে পোড়ামাটির ঘটেও লক্ষ্মী পূজা করে থাকেন। লক্ষ্মীর মুখ সম্বলিত পোড়া মাটির ঘটে চাল বা নদীর জল ভরে একে লক্ষ্মীর প্রতীক হিসেবে জলচৌকিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

আড়ি লক্ষ্মী

আড়ি লক্ষ্মী

অনেক বাড়িতে সাবেক প্রথা মেনে আড়ি লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। একটি ছোট বেতের ঝুড়িতে নতুন ওঠা ধান ভরে, ধানের ওপরে লাল কাপড় মুড়ে দুটি সিঁদুর কৌটো রাখা হয়। এই ঝুড়িটিকেই লক্ষ্মীর রূপ হিসেবে কল্পনা করা হয়। গৃহবধূরা উপবাস করে, জলচৌকিতে প্রতিষ্ঠা করা আড়ি লক্ষ্মীকে পূজা করেন। পাশাপাশি লক্ষ্মীর ব্রতকথা ও পাঁচালি পাঠ করা হয়।

বের লক্ষ্মী

বের লক্ষ্মী

কচি কলাগাছের ছাল লম্বা ও সমান করে কাটার পর সেগুলো পাকিয়ে নারকেল গাছের নতুন কাঠি দিয়ে আটকে দেয়া হয়। এভাবে নয়টি বের তৈরি করা হয়। কলাগাছের বেরগুলোর গায়ে তেল-সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকা হয়। এরপর জলচৌকিতে আলপনা দিয়ে তার উপর চোঙাকৃতি বেরগুলো রাখা হয়। বেরগুলোতে পাঁচ ধরনের শস্য ভরে এর ওপর একটি শিষ-ডাব রেখে লাল কাপড়ে মুড়ে দেয়া হয়।

সপ্ততরী

অনেক জায়গায় লক্ষ্মীর আসনে সপ্ততরী বসিয়ে আরাধনা করা হয়। সপ্ততরী হলো সাতটি কলার খোল দিয়ে তৈরি সাতটি নৌকা। সেই নৌকায় রাখা হয় হলুদ, চাল, ডাল, হরিতকি, খুচরা পয়সা ও টাকা। প্রাচীনকালে নৌকায় ব্যবসাবাণিজ্য চলত, সেখান থেকেই এসেছে ‘সপ্ততরী’কে লক্ষ্মী হিসেবে পূজা করার রীতি।

বেঁধে দেয়া কোনো নিয়ম নেই

লক্ষ্মীপূজার আয়োজনে ভিন্নতার ক্ষেত্রে ধর্মীয় কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বলে জানান ঢাকার সিদ্ধেশরী কালী মন্দিরের পুরোহিত ননী গোপাল গাঙ্গুলী। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লক্ষ্মীপূজার বিভিন্ন ধরন মূলত বংশপরম্পরার মেনে চলা রীতির কারণে হয়ে থাকে। তবে সব ক্ষেত্রেই পূজার মন্ত্র এক।’

পূজার উপাচার।

ফরিদপুরের পুরোহিত শংকর কুমার চট্টপাধ্যায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোন বাড়িতে পূজা হচ্ছে মূলত তার ওপরে পূজার ধরন নির্ভর করে। আলাদা কোনো কারণ নেই। আমরা সব ধরনের লক্ষ্মীকে একই মন্ত্রে পূজা করে থাকি।

‘মূলত প্রতিমাতে পূজা করাকে ষোড়শোপচার বলা হয়ে থাকে। আর ঘটে বা সরায় পূজা করাকে পঞ্চোপচার বলা হয়। এর বাইরে রয়েছে দশোপচার। এই তিন ভাবেই লক্ষ্মী পূজা করা হয়ে থাকে।’

পঞ্চোপচারের নিয়ম উল্লেখ করে তিনি জানান, এতে উপাচার হিসেবে গন্ধ, পুষ্প, ধুপ, দীপ ও বস্ত্র দেয়া হয়।

গবেষক পাভেল পার্থ অবশ্য মনে করছেন লক্ষ্মী পূজায় প্রতিমা, ঘট বা সরা ব্যবহারের রীতি মূলত আঞ্চলিক সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত।

তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চল বলতে কিন্তু জেলা বোঝায় না। এটি নদী অববাহিকার বিষয়। যেমন ভোলা, বরিশাল অঞ্চল মেঘনা অববাহিকায়। সেখানে সরার প্রচলন আছে। যেসব অঞ্চলে সরা বা পটচিত্রের প্রচলন ছিল সেখানেই মূলত সরায় লক্ষ্মী পূজার রীতি বেশি দেখা যায়।’

সুরমা অববাহিকা অর্থাৎ সিলেট অঞ্চলে বা বৃহত্তর হাওড় অঞ্চলে সরায় পূজার রীতি দেখা যায় না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই অঞ্চলে লক্ষ্মী পূজায় ঘটের ব্যবহার বেশি, প্রতিমা দিয়েও পূজা করা হয়। আবার দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরা ও ঘট দুটিতেই পূজা প্রচলিত। তবে নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রতিমা দিয়ে পূজা বেশি দেখা যায়।’

এ বিভাগের আরো খবর