বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজাকে বলা হয় সার্বজনীন। এই সার্বজনীনতা শুধু উৎসবে সবার অংশগ্রহণেই সীমিত নয়, দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণও সংগৃহীত হয় নানা জায়গা থেকে।
প্রতিমা তৈরি ও পূজায় ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা মাটি। সমাজের একদম প্রান্তিক অবস্থানে থাকা এবং মূল সমাজে ‘নিষিদ্ধ’ যৌনকর্মীদের দানের মাটিও মিশে আছে প্রতিমা ও দেবী বন্দনায়।
প্রতিমা শিল্পী ও পূজা সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, চণ্ডী পুরাণের নির্দেশনা অনুসারে দেবী দুর্গার প্রতিমা বানানো ও পূজা করা হয়। সেখানে ‘বেশ্যাদ্বার’ বা যৌনপল্লীর মাটি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।
পুরান ঢাকার বাংলাবাজার জমিদার বাড়ির প্রতিমা তৈরি করেছেন বলাই পাল। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেবীর প্রতিমা তৈরিতে পাঁচ ধরনের মাটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে যৌনপল্লীর মাটিও রয়েছে।’
ঢাকার শিল্পীরা কোথা থেকে এই মাটি সংগ্রহ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেসব জায়গায় অনেক আগে যৌনকর্মীরা থাকত সেখানকার মাটি আমরা সংগ্রহ করে রাখি। প্রতিবছর প্রতিমা তৈরিতে সেগুলো ব্যবহার করি।’
ঢাকায় আগে ইংলিশ রোড ও কুমারটুলি এলাকায় যৌনকর্মীরা থাকতেন উল্লেখ করে এই প্রতিমা শিল্পী বলেন, ‘আমরা সেখানকার মাটি সংগ্রহ করে রেখেছি। সেই মাটি অল্প পরিমাণে প্রতিমায় ব্যবহার করি।’
ঢাকার সিদ্ধেশরী কালী মন্দিরের পুরোহিত ননী গোপাল গাঙ্গুলি অবশ্য দাবি করছেন প্রতিমায় যৌনকর্মীদের বসতির মাটি ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা নেই, তবে এই মাটি পূজার ঘট বসাতে অবশ্যই প্রয়োজন।
ননী গোপাল গাঙ্গুলি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মায়ের (দুর্গা) প্রতিমা তৈরিতে এই মাটি ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে প্রতিমার সামনে ঘট বসানোর জন্য আটটি স্থানের মাটি লাগে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা (মাটি)।
‘এই মাটি ছাড়া পূজা করার কোন অর্থ নেই। এটা বাধ্যতামূলক।’
অন্য সাতটি জায়গার মাটির বিষয়ে তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘এগুলো হলো গজদন্ত মৃত্তিকা (হাতির দাঁতে লেগে থাকা মাটি), পর্বতের মৃত্তিকা, নদীর দুই ধারের মৃত্তিকা, গঙ্গার দুই কূলের মৃত্তিকা, চৌমাথার মৃত্তিকা, রাজবাড়ির মৃত্তিকা, সাগরের নীচের মৃত্তিকা।’
তবে এসব মাটির সবগুলো বাংলাদেশে সব সময় পাওয়া যায় না বলেও জানান এই পুরোহিত।
তিনি বলেন, ‘পূজায় এখন যা ব্যবহার করা হয় তার সবই আসে ভারত থেকে। কলকাতা থেকে এগুলো নিয়ে আসা হয়। মূলত ঢাকার শাঁখারীবাজার এলাকায় পূজার সব উপকরণ বিক্রি করা হয়। সেখান থেকেই সবাই কিনে নিয়ে পূজায় ব্যবহার করেন।’
দুর্গাপূজায় এসব বিশেষ মাটি ব্যবহারের কথা চণ্ডী পুরাণ, বিষ্ণু পুরান, পুরোহিত পার্বণ, ব্রহ্মপুরাণে উল্লেখ আছে বলে জানান পুরোহিত ননীগোপাল।
বাংলাদেশ সার্বজনীন পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক চন্দ্রনাথ পোদ্দার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি বিশেষ স্থানের (যৌনপল্লী) মাটি লাগে। এটা কমবেশি সবাই মেনে আসছে। ঢাকেশ্বরী মন্দিরেও এই নিয়ম মানা হয় বলেই আমি জানি।’
তবে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রতিমা শিল্পী সুকুমার পালের দাবি, তিনি বৈষ্ণব রীতি মেনে চলেন। এই রীতিতে দুর্গা প্রতিমা তৈরিতে যৌনপল্লীর মাটি ব্যবহার বাধ্যতামূলক নয়।
ফরিদপুরের মধুখালীর পুরোহিত শংকর কুমার মুখোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, দুর্গা প্রতিমায় যৌনকর্মীদের বসতিসহ বেশ কয়েকটি জায়গার মাটি ব্যবহারের নিয়ম রয়েছে। তবে সেই মাটি পেতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয় বলে অনেকে অন্য পদ্ধতি অনুসরণ করেন।
শংকর কুমার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন সব জায়গার মাটি পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। তাই আমরা শাস্ত্রমতে মন্ত্রের সাহায্যে সাধারণ এলাকার মাটিকে বিশেষ স্থানের মাটি কল্পনা করে ব্যবহার করে থাকি।’
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দুর্গা প্রতিমা গড়তেও যৌনপল্লীসহ বিভিন্ন জায়গার মাটি ব্যবহারের প্রচলনের তথ্য পাওয়া গেছে।
এর কারণ হিসেবে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ এইটিন বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সমাজ যাঁদের দূরে ঠেলে দিয়েছে, অবজ্ঞা আর বঞ্চনার পাহাড় জমে উঠেছে যাঁদের দেওয়াল বেয়ে, ঘৃণা আর নোংরা দৃষ্টি ছাড়া যাঁদের ভাগ্যে আর কিছুই জোটেনি, তাঁদের ঘরের মাটিই আবার দেবীমূর্তির অপরিহার্য অঙ্গ৷
‘কিন্তু কেন? বলা হয়, পুরুষ মানুষ পতিতালয়ে গিয়ে যখন বারাঙ্গনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়, তখন তিনি জীবনে সঞ্চিত সমস্ত পুণ্য সেখানেই ফেলে আসেন৷ আর সংগ্রহ করেন ঘড়া ভর্তি পাপ৷’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘চিরাচরিতভাবে মানুষ বিশ্বাস করেন যে, মানুষের মধ্যে যে কামনা, বাসনা, লালসার বাস... পতিতারা তা নিজেদের মধ্যে নিয়ে নেন। তাঁরা নিজেদের অশুদ্ধ, অপবিত্র করে সমাজকে শুদ্ধ রাখতে চান। পবিত্র রাখতে চান। ফলে হাজার হাজার পুরুষের পুণ্যে বেশ্যাদ্বারের মাটি হয়ে ওঠে পবিত্র৷
‘সে কারণেই এই মাটি দিয়ে গড়তে হয় দেবী মূর্তি৷ এই আচার থেকে বোঝানো হয় যে, নারী মায়ের জাতি। নারীর ঔরসেই পুরুষের জন্ম। নারীকে পতিতা বানায় পুরুষরাই। তাই ঐ পুরুষরাই অপবিত্র। মায়ের প্রতিমা তৈরীতে পতিতালয়ের মাটি দিতে হয় অর্থাৎ যাঁরা এই পরিস্থিতির শিকার তাঁদের সম্মান করতে হবে। নারী কখনও অপবিত্র হতে পারে না, এই ধারণাটিই লুকিয়ে থাকে এই রীতির আড়ালে৷’
দুর্গাপূজা উপলক্ষে #thesecondquestion হ্যাশট্যাগে পশ্চিমবাংলার একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এতে দেখা যায়, যৌনকর্মীদের কাছ থেকে প্রতিবছর মাটি সংগ্রহ করে দুর্গা প্রতিমা গড়েন শিল্পী, তবে পূজার উৎসবে সেই যৌনকর্মীদের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না।
ভিডিওতে এবারের পূজায় এক যৌনকর্মীর পরিবারকে অংশ নিতে প্রতিমা শিল্পীর আমন্ত্রণ জানানোর দৃশ্য রয়েছে। পূজার সার্বজনীনতাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে এই ভিডিওতে।
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কলকাতার যৌনকর্মীরা প্রতিবছর দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরিতে মাটি দান করলেও পূজার উৎসবে এখনও তারা ‘নিষিদ্ধ’।
কলকাতার এক যৌনকর্মীর মেয়ে টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে বলেন, ‘আমি পঞ্চম শ্রেণিকে পড়ার সময় পর্যন্ত আমার মা যৌনপেশায় জড়িত ছিলেন। আমি দেখতাম যৌনকর্মীরা প্রতিমা গড়ার মাটি দান করার সময়ে পুরোহিতের কাছ থেকে কিছু মিষ্টি অথবা টাকা পেতেন। তবে তাদের কখনোই পূজার উৎসবে নিমন্ত্রণ করা হতো না।’
সার্বজনীন দুর্গোৎসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রতিবাদে কলকাতার যৌনকর্মীদের মাঝে প্রতিমার মাটির জোগান দেয়ার অনাগ্রহ বাড়ছে বলেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাবিদ, পুরাণ বিশেষজ্ঞ ও ইতিহাসবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি দাবি করছেন, দুর্গা প্রতিমায় যৌনকর্মীদের দান করা মাটি ব্যবহারের বিষয়ে ধর্মগ্রন্থে কিছু বলা নেই। বিশেষ প্রেক্ষাপটে এই চল অনেক পরে তৈরি করা হয়েছে।
নৃসিংপ্রসাদ বলছেন, ‘জমিদারবাড়ির লোকেরা যখন পুজো শুরু করেন, তখন তাঁরাই তৈরি করেছেন। পুরানে এ রকম কোথাও নেই যে, যৌনপল্লির মাটি দিয়েই দুর্গাপুজো হবে।’
নৃসিংহপ্রসাদের কথায়, 'দুর্গাপুজো যেহেতু মহোৎসব, তাই ওই সময় সমাজে জাতিভেদ, অন্তজ শ্রেণি ইত্যাদি মনে রাখা হয় না। এটা হল সবচেয়ে বড় যুক্তি। যেমন, সমাজে নানা অস্পৃশ্যতা রয়েছে, ব্রাহ্মণ নিম্নজাতিকে ছোঁবে না, আবার ডোম যে মাদুর তৈরি করত, তার উপর পেতেই লোকে বসেছে। সে রকমই যৌনপল্লি থেকে মাটি এই কারণেই নিয়ে এসো, যাতে আমরা যৌনকর্মীদের ঘৃণা না করি। তাঁরাও তো সমাজের একপ্রকার উপকার করছেন।
‘চণ্ডীর মধ্যে একটা শ্লোক আছে, স্ত্রেয়ঃ সমৎসা সকলা জগৎসু। অর্থাৎ সব স্ত্রী-ই আমি, অন্য কেউ নেই। দেবী বলছেন, এই যে ব্রাহ্মবাদী ভক্তি, ব্যপ্তি, সর্বত্র তিনি-ই আছেন। তাই যৌনপল্লীর মাটি মিশিয়ে নেওয়া হয় দুর্গাপ্রতিমা তৈরির মাটির সঙ্গে।’