বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বসল ‘৫ শতাব্দীর’ ঢাকের হাট

  •    
  • ১ অক্টোবর, ২০২২ ১১:০২

হাটে সাধারণত একটি ঢাক ১০ থেকে ১২ হাজার, ঢোল সাত থেকে আট হাজার, বাঁশি প্রকারভেদে পাঁচ থেকে সাত হাজার, ব্যান্ড পার্টি ৩০ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ টাকায় পর্যন্ত ভাড়া হয়।

ঢাক, ঢোল, সানাই, বাঁশি, কাঁসিসহ বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্রের পসরা সাজিয়ে বসে যন্ত্রীদল। বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে, নেচে, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে পূজারিদের আকৃষ্ট করেন দলের সদস্যরা।

হাটে বিক্রি হয় বাদ্যযন্ত্র, তবে দরদাম বেশি হয় বাদ্যযন্ত্র ভাড়ায় নেয়া নিয়ে।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলা সদরের পুরাতন বাজারে দুর্গাপূজা শুরুর আগে বসে তিন দিনের এ হাট। এটি শেষ হয় ষষ্ঠীর দিনে।

এবার বৃহস্পতিবার থেকে বসে হাট; চলবে শনিবার পর্যন্ত।

হাটে সাধারণত একটি ঢাক ১০ থেকে ১২ হাজার, ঢোল সাত থেকে আট হাজার, বাঁশি প্রকারভেদে পাঁচ থেকে সাত হাজার, ব্যান্ড পার্টি ৩০ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ টাকায় পর্যন্ত ভাড়া হয়।

স্থানীয়দের দাবি, হাটটি বসে ৫০০ বছর ধরে, তবে এমন দাবির সঙ্গে একমত নন কিশোরগঞ্জের সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করা এক গবেষক।

ইতিহাস

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় সর্বপ্রথম তার রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। উপজেলা সদর থেকে দুই কিলোমিটার উত্তরে চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ।

পূজা উপলক্ষে রাজপ্রাসাদ থেকে বিক্রমপুর (মুন্সীগঞ্জ) পরগনার বিভিন্ন স্থানে বার্তা পাঠানো হতো ঢাকঢোল বাঁশিসহ বাদ্যযন্ত্রীদের আগমনের। এ জন্য ব্যবহার হতো নৌপথ।

যন্ত্রীদল কটিয়াদী-মঠখোলা সড়কের পাশে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাট এলাকায় পূজার দুই দিন আগে এসে পৌঁছাত।

স্থানীয়রা আরও জানান, পার্শ্ববর্তী মসুয়া গ্রামে বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ হরিকিশোর রায় চৌধুরীর বাড়িতে মহা ধুমধামে পূজা হতো। সেই সঙ্গে চলত বাদ্যযন্ত্রের প্রতিযোগিতা।

দিন দিন পূজার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন জমিদারদের মধ্যে ঢাকের হাটের স্থান নির্ধারণ নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অবশেষে যাত্রাঘাট থেকে স্থান পরিবর্তন হয়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে আড়িয়াল খাঁ নদের তীরে কটিয়াদী পুরাতন বাজারে গড়ে ওঠে ঐতিহ্যবাহী ঢাকঢোলের হাট।

বাদ্যযন্ত্রীদের ভাষ্য

তিন দিনের সেই হাটে ময়মনসিংহ, ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকঢোলসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যন্ত্রীদল আসে। দুর্গাপূজার আয়োজক ও পূজারিরা হাট থেকে ভাড়ায় বায়না দিয়ে বাদ্যযন্ত্রীদের নিয়ে যান।

যন্ত্রীদলের সদস্যরা জানান, তাদের পূর্বপুরুষরা এখানে ঢাকঢোলসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আসতেন। সেই সূত্রে তারাও আসেন। পূজামণ্ডপে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আয়-রোজগারও ভালো হয় তাদের।

সুনামগঞ্জ থেকে ৭ সদস্যের বাদকদল নিয়ে এসেছেন জয়নুদ্দীন সরকার। শুক্রবার তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি মুসলিম। এটা আমাদের পুরোনো ব্যবসা হওয়ায় মুসলমান হয়েও মণ্ডপে বাদ্য বাজিয়ে জীবন চালাই।’

তিনি বলেন, ‘এখনও বায়না হয়নি। আশা করছি ১ লাখ টাকা হলে বায়নায় বসব।’

মানিকগঞ্জ থেকে ১০ সদস্যের দল নিয়ে আসেন মোহন লাল। তিনি বলেন, ‘বাদ্যযন্ত্র বাজানোটা আমাদের বংশগত পুরোনো ব্যবসা। প্রতি বছরই এ ঢাকের হাটে আসি।

‘করোনার কারণে গত দুই বছর বেশি টাকা পাইনি। এবার ভালো টাকা পাব আশা করছি।’

নেত্রকোনার খালিয়াজুরী এলাকা থেকে বাদ্যদল বায়না করতে এসেছেন তাপস রায়। তিনি বলেন, ‘হাট থেকে প্রতি বছরই দুর্গাপূজার জন্য ঢাকঢোল বায়না করে নিয়ে যাই। এবারও এসেছি।

‘২৮ হাজার টাকা বায়নায় ১টি ঢাক ও ১টি ঢোল নিয়ে মণ্ডপে ফিরছি।’

গাজীপুরের কালীগঞ্জ থেকে ঢাকির দল ভাড়া করতে এসেছেন রতন কর। তিনি জানান, ৫৫ হাজার টাকায় দল ঠিক করেছেন। প্রতি বছর এ হাট থেকেই ঢাকি নিয়ে যান।

তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে বাজনা শুনেছি। তারপর তাদের পারফরম্যান্স দেখে একটা দল ঠিক করেছি।’

হাটের তত্ত্বাবধায়ক বেণী মাধব ঘোষ বলেন, ‘শারদীয় দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে এ বাদ্যযন্ত্রের হাট বসলেও চিরচেনা তাল ও সুরের প্রদর্শনের মহড়ায় প্রকৃতপক্ষে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালির মিলনমেলায় পরিণত হয়।

‘সব ধর্মের লোকজনই হয়ে ওঠে ওদের রক্ষাকবচ। প্রায় ৫০০ বছর ধরে চলে আসা এ হাট কটিয়াদীর ঐতিহ্য। এ ঐতিহ্য ধরে রাখা হবে।’

কটিয়াদী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম শাহাদত হোসেন জানান, পূজার আয়োজক ও বাদকদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঢাকের হাটে পুলিশের একটি দল সার্বক্ষণিক কাজ করছে।

হাটের সময়কাল: কী বলছেন গবেষক

কিশোরগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করেন কবি ও লোকজ সংস্কৃতি গবেষক জাহাঙ্গীর আলম জাহান। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কটিয়াদীর এই ঢাকের হাটটি বেশ পুরোনো, তবে সেটি ৫০০ বছরের কি না এ নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে।

‘স্থানীয়দের দাবি ৫০০ বছরের পুরোনো হলেও আমার ধারণা সেটি দেড় শ বছরের মতো হতে পারে।’

কেন সন্দেহ, তা নিয়ে তিনি বলেন, ‘কটিয়াদীর নিকটবর্তী কুড়িখাই নামক স্থানে আধ্যাত্মিক পুরুষ হজরত শামসুদ্দিন বোখারী সম্রাট আকবরের আমলে এসে আস্তানা গাড়েন। তাঁর আহ্বানে তখন নিম্নগোত্রীয় হিন্দুরা দলে দলে ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হচ্ছে। সে সময় ওই এলাকায় ঢাকের বাজনা বা ঢাকের হাট বসানো বাস্তবতার সঙ্গে যায় না।

‘তাই ৫০০ বছরের দাবিটি যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত নয় বলেই আমি মনে করি, তবে সব দিক বিবেচনায় এ ঢাকের হাট গত এক থেকে দেড় শ বছর ধরে চলে আসছে বলেই যৌক্তিক মনে হয়।’

এ বিষয়ে কথা বলতে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলমের মোবাইলে একাধিকবার কল করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

এ বিভাগের আরো খবর