বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ডে কেয়ার সেন্টারের জন্য হাহাকার

  •    
  • ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১০:২৫

আড়াই কোটি মানুষের এই নগরে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১১৯টি এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র রয়েছে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে চাহিদার তুলনায় সংখ্যাটি একেবারেই অপ্রতুল। আবার যেগুলো আছে, সেগুলোর মান নিয়েও আছে প্রশ্ন।

সাংবাদিক শারমিন নিরা। বাসা মগবাজারের দিলু রোডে। সকাল থেকে অ্যাসাইনমেন্ট, রিপোর্ট তৈরির কাজে ব্যস্ত। জীবনসঙ্গী সাইফুর রাসেল সরকারি চাকুরে। সন্তানের দেখাশোনার কেউ নেই, তাই দিতে হয়েছে ডে কেয়ার সেন্টারে।

কিন্তু এটি খুঁজে পাওয়া সহজ কাজ ছিল না। কিলোমিটার ছয়েক দূরে নিকেতন এলাকায় একটি সেন্টারের খোঁজ পান এক সহকর্মীর কাছ থেকে। সেখানেই প্রায় পাঁচ বছর ধরে রাখছেন সন্তান অতল আনন্দকে।

নিরা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সেন্টারটিতে ছুটি হয় সন্ধ্যার আগে। কোনো কোনো দিন সাড়ে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। তখন বাচ্চাকে আনার বিষয়টা কঠিন হয়ে যায়। রাসেলকে বলি, সে নিজে যায়, অথবা ব্যবস্থা করে।’

‘বাসার আশপাশে কোনো সেন্টার থাকলে অনেক ভালো হতো। বেইলি রোডে মহিলা সমিতিতে একটি খুঁজেও পেয়েছিলাম। কিন্তু সেটার পরিবেশ দেখে আর দেয়া হয়নি।’

রাজধানীর একটি ডে কেয়ার সেন্টারে শিশুদের সঙ্গে দুজন কর্মী। ছবি: নিউজবাংলা

মিতা পাল ইংলিশ মিডিয়ামের একটি কোচিং সেন্টারে ক্লাস করাতেন। সন্তান জন্ম নেয়ার পর বাধ্য হন চাকরি ছাড়তে। পরে এক বন্ধুর পরামর্শে অনলাইনে পেজ খুলে মেয়েদের ফ্যাশন আইটেম বিক্রি করে আয় করতে থাকেন।

মিতার মতো কর্মজীবী নারীদের সন্তান লালনপালনে চাকরি ছাড়তে হতো না যদি না দিনের বেলায় শিশু লালনপালনের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার সহজলভ্য হতো।

সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সরকারি-বেসরকারি অফিসে ডে কেয়ার সেন্টার করার তাগাদা এসেছে একাধিকবার। তবু এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। এমনকি এ নিয়ে কর্মকর্তারা কিছু বলতেও চাইছেন না।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত মহাখালী ডে কেয়ার সেন্টারের কার্যালয়। ছবি: নিউজবাংলা

আড়াই কোটি মানুষের এই নগরে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১১৯টি এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র রয়েছে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে চাহিদার তুলনায় সংখ্যাটি একেবারেই অপ্রতুল।

কেন মানসম্মত কেয়ার সেন্টার গড়ে তোলা যাচ্ছে না, আর যেগুলো আছে, সেগুলোতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা কেন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না- এই প্রশ্নে ডে কেয়ার সেন্টারের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কোনো কথাই বলতে চাইলেন না।

সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ফাতেমা ফেরদৌসীর কাছে প্রশ্ন রাখলে তিনি পাঠান অফিসের প্ল্যানিং শাখায়।

সম্প্রতি চালু করা দ্য ডেইলি স্টার-এর ডে কেয়ার সেন্টার। ছবি: নিউজবাংলা

সেই শাখায় যাওয়ার পর বেনুআরা নামের এক কর্মকর্তা কথাই বলতে চাইলেন না। ডে কেয়ার সেন্টার নিয়ে কী পরিকল্পনা, সে বিষয়ে কথা বলতে হলে তাদের মহাপরিচালক বরাবর দরখাস্ত দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। বললেন, দরখাস্ত মঞ্জুর হলেই কেবল তিনি কথা বলবেন।

যে কয়টি ডে কেয়ার সেন্টার আছে, সেগুলোর মধ্যে যে যে সমস্যা আছে, তা হলো শিশুদের যত্নের মতো পর্যাপ্ত লোকবল ও সুযোগ-সুবিধা নেই। উন্নত বিশ্বে ডে কেয়ার সেন্টারে প্রাক-প্রাথমিকে পড়াশোনাও করা হয়। কিন্তু দেশে হাতে গোনা এক-দুটিতে আছে এই সুবিধা। আবার সেন্টারগুলো এমন সময়ে বন্ধ হয়, যে সময়ে বাবা-মায়ের পক্ষে সন্তানকে নিয়ে যাওয়া কঠিন, আবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকে দুদিন, কিন্তু সব অফিসে ছুটি দুদিন নেই।

গুলশানের একটি ডে কেয়ার সেন্টার ‘এবিসি ডে কেয়ার’ এ শিশুরা। ছবি: সংগৃহীত

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল বাবা-মায়ের স্বস্তি দিতে নয়, একসঙ্গে অনেক শিশুর বেড়ে ওঠা তাদের সামাজিকীকরণের জন্যও জরুরি। এতে অর্থ খরচ হলেও বিকল্প হিসেবে ঘরে সহকারী রাখার যে খরচ, সে তুলনায় কম।

যা কিছু আছে তার মান নিয়েও আপত্তি

ডে কেয়ার সেন্টার পাওয়া সহজ নয়। আবার পাওয়া গেলেও মান নিয়ে আছে প্রশ্ন।

যেমন: শারমিন নিরা তার বাসা থেকে খানিক দূরে বেইলি রোডে মহিলা সমিতির একটি ডে কেয়ার সেন্টার খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানকার পরিবেশ দেখে আর দেয়া হয়নি।

এই সেন্টারটিতে মূলত নিম্ন আয়ের মানুষের সন্তানদের রাখা হয়। এমন একটি সেন্টারে অতলকে রাখা হলে তার মানসিক বিকাশের কী হবে, এ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন এই সংবাদকর্মী।

পরে নিকেতনেরটা কীভাবে খুঁজে পেলেন?

নিরা বলেন, ‘যখন কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তখন এক কলিগকে বললাম। দিদিই খোঁজ দিলেন এটির। তার বাচ্চাও এখানে থাকত।’

গুলশানে ‘এবিসি ডে কেয়ার’ এ একটি শিশু কাগজ দিয়ে ঈদ শুভেচ্ছা কার্ড বানাচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

নিরার পরিবারের একটি প্রাইভেট কার আছে, যে কারণে বাচ্চাকে আনা-নেয়া করা খুব একটা কঠিন হয় না। যদি না থাকত- এই প্রশ্নে নিরা হেসে বলেন, ‘জানি না, খুব কঠিন হতো।’

আরেক কর্মজীবী নারী উর্মি দে। সরকারি কর্মকর্তা। বাড়ির পাশে ডে কেয়ার সেন্টার খুঁজে না পেয়ে বাড়ি থেকে আনিয়েছেন সহকারী।

তিনিও বললেন, মানসম্পন্ন ডে কেয়ার সেন্টার থাকলে তার এবং সন্তান রূপকথার জীবনটা আরও সহজ হতো।

উর্মি বলেন, ‘আমি হাতিরঝিলের পাশে মহানগর এলাকায় থাকি। সেখানে তো নেইই, অফিসের আশপাশেও ভালো কোনো ডে কেয়ার নেই। একটা ছিল, সেখানে পরিবেশ ভালো লাগেনি। বাচ্চার দেখাশোনার ব্যাপারে যত্নশীলতা কম মনে হয়েছে।

‘গুলশানে যেগুলো আছে সেগুলোর খরচ আকাশছোঁয়া। তাই বাধ্য হয়ে এভাবে বাসায় রাখতে হয়।’

বাসায় সহকারী রেখে মানসিক যাতনা

বাসায় সহকারী রেখে দূর থেকে সব পর্যবেক্ষণ করা সহজ নয়। শিশুর যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সে জন্য পুরো বাসা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় এনেছেন উর্মি। কিন্তু এর ঝক্কি ঝামেলা কম নয়।

মহাখালীতে মরকারি ডে কেয়ার সেন্টারের বাইরের দৃশ্য। ছবি: নিউজবাংলা

তিনি বলেন, ‘অফিস থেকে এভাবে সিসি ক্যামেরায় বাচ্চাকে দেখাও অনেক চাপের। সব সময় অন রাখা সম্ভব হয় না। এই ফাঁকে বাসার মেয়েটি আমার বাচ্চাকে দারোয়ানের কাছে রেখে বাসায় চলে গিয়েছিল। দারোয়ান ফোন করায় দৌড়ে বাসায় যেতে হয়েছে অফিস থেকে।

‘আমার ওয়াশরুমেও সিসি ক্যামেরা রাখতে হয়েছে। এটা একটা মায়ের জন্য অনেক দুঃখজনক। কারণ ওয়াশরুমে নিয়ে আমার বাচ্চাকে মারধর করেছিল মেয়েটি। একটাই বাচ্চা আমার। সেই ট্রমা থেকে আমি আর বাচ্চা নেয়ার সাহস পাইনি।’

নানা সময় ঘরে একা থাকা গৃহকর্মীর হাতে শিশুর নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজে নির্মম পিটুনির বিষয়টি ধরা পড়ার পর একাধিক গৃহকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে যেসব বাসায় এই পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা নেই, সেসব বাসায় শিশুদের শারীরিক ও মানসিক কষ্টের বিষয়টি জানাও যায় না।

অভিজাত এলাকায় মানে ভালো, কিন্তু অর্থের চাপ

গুলশানের একটি ডে কেয়ার সেন্টার এবিসি ডে কেয়ার। সেখানে নিজের দুই সন্তানকে রাখেন কর্মজীবী মা তানজিদা ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘সার্ভিস খুব ভালো। প্রি-স্কুল রয়েছে। তবে খরচ তুলনামূলক অনেক বেশি। তবু কোনো উপায় তো নেই আর।

‘সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বাচ্চাকে রাখি। বাসার কাছে হওয়ায় এবং অফিসের দূরত্বও কম হওয়ায় আমার অসুবিধা হয় না। কিন্তু যাদের বাসা দূরে এবং এ রকম বেসরকারি ডে কেয়ারের খরচ বহন করাও অনেকের জন্য কঠিন। আমি মনে করি, প্রতিটি অফিসেই ডে কেয়ার থাকা উচিত। ডে কেয়ারের সংখ্যা বাড়লে মেয়েরা আরও কর্মমূখী হবে।

‘সরকারিভাবে এই সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার। কারণ বাসায় যখন অপরিচিত কারও কাছে সন্তানকে রেখে আসা হয়, সে ক্ষেত্রে মা অনেক অনিরাপত্তায় ভোগেন। সেখানে সুযোগ সুবিধাসহ এবং সামর্থ্য অনুযায়ী ডে কেয়ারে রাখতে পারলে মায়েরা নিশ্চিন্তে কাজে যেতে পারবেন। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের সংখ্যা আরও বাড়বে।

‘শুধু বাচ্চাকে নিরাপদে রাখতে না পারার অনিশ্চয়তার জন্য চাকরি ছাড়ার কথা ভাবতে হবে না।’

এবিসি ডে কেয়ারের স্বত্বাধিকারী সোনিয়া আকরাম জানান, ঢাকায় তাদের পাঁচটি শাখা আছে, যার তিনটিই গুলশানে। বাকি দুটির একটি ধানমন্ডি ও একটি তেজগাঁও এলাকায়।

চাহিদা থাকলেও আর বাড়াচ্ছে না কেন- এমন প্রশ্নে এবিসির কো-অর্ডিনেটর লীনা ইসলাম বলেন, ‘এটা একদমই আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটা বাইরে প্রকাশ করতে চাই না।’

সময়সীমা ও সপ্তাহে দুই দিন ছুটিও এক সমস্যা

মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত মহাখালী ডে কেয়ারে গিয়ে দেখা গেল, শিশুরা খেলা করছে। সেখানকার শিক্ষক সাথী বৈদ্য জানান, ৪ মাস বয়সী থেকে শুরু করে ৬ বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের তারা রাখেন।

কিন্তু সেখানে সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত রাখার সুযোগ, যেটি কর্মজীবী নারীর জন্য সংকট তৈরি করেছে। কারণ, অফিস সময় কারও ৫টা, কারও ছয়টা পর্যন্ত। ছুটি শেষে এখানে আসতে আসতেই ডে কেয়ার সেন্টার বন্ধ হয়ে যায়।

এখানে মূলত যাদের আয় কম, তাদের বাচ্চাদেরই দেখা গেল। সাথী বৈদ্য জানান, বাবা-মার আয় এবং বাচ্চার বয়সের ওপর নির্ভর করে সরকার ভর্তুকিও দেয়। বাবা-মা মায়ের সম্মিলিত আয় ৫০ হাজার টাকার কম হলে এই সুবিধা পাওয়া যায়।

তবে শুক্র ও শনিবার এর সঙ্গে সরকারি সব বন্ধের দিন সেন্টারটি বন্ধ থাকে। কিন্তু বেসরকারি বেশির ভাগ অফিসেই সাপ্তাহিক ছুটি এক দিন। ফলে বাকি এক দিনের দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে।

শনিবার মায়েরা বাচ্চাকে কোথায় রাখবে- এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারলেন না সাথী।

আধুনিক জীবনে ডে কেয়ার কেন জরুরি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ডে কেয়ার পাশ্চাত্য সমাজের একটি ধারণা। যেন মায়েরা নিশ্চিন্তে তাদের সন্তানকে সেখানে রেখে কাজে যেতে পারে। আমাদের সরকারি নীতিমালায় অনুযায়ী প্রতিটি কর্মক্ষেত্রেই ডে কেয়ার রাখার নির্দেশনার কথা বলা হয়েছিল। তবে সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। সেক্ষেত্রে মনিটরিং করা হচ্ছে কি না বা কেন হচ্ছে না তার কোনো ব্যাখ্যা সরকার দিয়েছে বলে আমরা জানি না।’

তিনি বলেন, ‘একজন মা তার কর্মক্ষেত্রে বা আশপাশে ভালো ডে কেয়ার পেলে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারবেন। পাশাপাশি অফিসে ডে কেয়ার থাকলে কাজের সময়টুকুতে সন্তানকে দেখাশোনার ব্যাপারটাও সহজ হবে।’

কেবল কর্মজীবী মায়েদের কথা ভেবেই নয়, শিশুদের সামাজিকীকরণের জন্যও এসব ডে কেয়ার সেন্টার জরুরি বলে মনে করেন এই শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘সব শিশুই যেন বাইরের জগতের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, অন্য শিশুদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার মানসিকতা যাতে তৈরি হয়, সে জন্যও দিবাযত্ন কেন্দ্র জরুরি।’

এ বিভাগের আরো খবর