সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিকিনি পরা ছবি পোস্ট করায় প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্যে আঘাত লেগেছে মনে করে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয় এক ইংরেজি শিক্ষিকাকে চাকরিচ্যুত করেছে কর্তৃপক্ষ। চাকরিচ্যুতির সে ঘটনায় সাঁতারের পোশাক পরা ছবি পোস্ট করে প্রতিবাদে সরব হয়েছেন সমাজের বিভিন্ন মহলের মানুষজন।
মেন্টাল হেলথ অ্যাক্টিভিস্ট রত্নাবলী রায় ফেসবুকে নিজের সাঁতারের পোশাক পরা ছবি পোস্ট করে সেন্ট জেভিয়ার্স ইউনিভার্সিটির এই পিছিয়ে পড়া মনোভাবের বিরুদ্ধে সবাইকে সাঁতারের পোশাক পরা ছবি পোস্ট করে প্রতিবাদ জানানোর আবেদন জানান।
রত্নাবলী তার ফেসবুকে, ‘কাঁচকলা। কাঁচকলা। ব্যক্তি শিক্ষকের পোশাক ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বিড়ম্বনার হয় না। এটি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি। যে কর্তৃপক্ষ এটা বোঝে না, তাদের শিক্ষার পরিধি বাড়ানোর দরকার।’
রত্নাবলীর পোস্টকে সমর্থন করে তীব্র সমালোচনার পাশাপাশি আরও অনেকে সাঁতারের পোশাক পরা ছবি পোস্ট করে এই ঘটনার প্রতিবাদে সরব হয়েছেন।
সেন্ট জেভিয়ার্স ইউনিভার্সিটির ওই শিক্ষিকা গত বছর জুন মাসে তার ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে বিকিনি পরা কয়েকটি ছবি পোস্ট করেছিলেন। যা সম্পূর্ণ প্রাইভেট বলে দাবি করেছেন তিনি।
ঘটনার দুই মাস পর অক্টোবরে তিনি কাজে যোগ দিলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে একটি বৈঠকে ডেকে তার বিকিনি পরা ছবির প্রিন্ট দেখিয়ে অশ্লীল মন্তব্য ও যৌন হেনস্তার পাশাপাশি তাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করে বলে সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে।
এ বিষয়ে ওই শিক্ষিকা আগে যাদবপুর থানায় একটি অভিযোগ করেন। সেখানে তিনি বলেন, ইনস্টাগ্রাম প্রাইভেট মোডের ছবি, যা কিনা ২৪ ঘণ্টা পর এমনি মুছে যাওয়ার কথা, দুমাস পর সেই ছবি দেখিয়ে তাকে হেনস্থা করা হয়েছে। তাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।
তার দাবি, তার প্রোফাইল হ্যাক করা হয়ে থাকতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবশ্য শিক্ষিকার দাবি অস্বীকার করে, তিনি স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন বলে দাবি করেছে।
সেন্ট জেভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইংরেজি স্নাতক স্তরের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রের বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে।
ওই ছাত্রের বাবা অভিযোগে লেখেন, ‘ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা এক শিক্ষিকার বিকিনি পরা ছবি দেখছিল আমার ছেলে। ছবিগুলো কুরুচিকর, অশ্লীল, প্রায় নগ্ন। যৌন উত্তেজনামূলক পোশাক পরা। শিক্ষিকার অন্তর্বাস পরা ছবি দেখছে ছেলে, বাবা হিসেবে এ দৃশ্য অত্যন্ত লজ্জার।’
এরপর ফেসবুকে চিঠিটি ভাইরাল হয়। পরে শিক্ষিকার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৯৯ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেছে বলেও দাবি করেন ওই শিক্ষিকা।
শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী মিরাতুন নাহার এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি অধ্যাপনা পেশার সঙ্গে দীর্ঘ ৩৪ বছর যুক্ত ছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এত তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে তিনি ইনস্টাগ্রাম পোস্টে যাচ্ছেন কেন? প্রাইভেট হোক আর পাবলিক হোক। এরকম মনোবৃত্তিটা হয় কীভাবে? এরকম প্রশ্ন আমার মনে জাগে। তাই বলে, তার ওপর কিছু আমি আরোপ করতে চাই না।’
মীরাতুন্নাহার বলেন, ‘যেটা শুনতে পাচ্ছি, একজন মাত্র অভিভাবক অভিযোগ করেছেন। তাও ঘটনার দুমাস পরে এবং তিনি তখনও অধ্যাপনায় যোগ দেননি। সেরকম সময়ের ইনস্টাগ্রাম পোস্ট। এই তথ্যগুলো যুক্তিসঙ্গত। সেন্ট জেভিয়ার্সের যিনি অধ্যক্ষ তিনি আমার খুব পরিচিত। তার ব্যক্তিগত জীবন, তিনি কেমন মানুষ, আমার জানা। ফলে তার মতো মানুষ বা কর্তৃপক্ষ একটা মানুষের উপর সবটা কর্তৃত্ব করবেন, এটা হতে পারে না।
‘অধ্যাপনা জীবনের বাইরের ঘটনা নিয়ে যদি চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়, তার তীব্র নিন্দা করছি। অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে বলে আমি মনে করি। এটা ঠিক হয়নি।’
সাহিত্যিক আবুল বাশার নিউজবাংলার থেকে এই ঘটনা শোনার পর তিনি বলেন, ‘বর্তমান ডিজিটাল যুগে ব্যক্তিগত পরিসর বলে আর কিছু নেই। তবে আমাদের জানতে হবে কীভাবে ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়, সেই সামাজিক জ্ঞানও মানুষের নেই।’
আবুল বাশার আরও বলেন, ‘চাকরি এখন খোলামকুচি নয়। ইচ্ছে করলেই চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যায়? বিকিনি পরে উনি তো আর বিশ্ববিদ্যালয় যাননি?
‘কোথায় কী গোপন ছবি বেরিয়েছে, তার উপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেন সিদ্ধান্ত নেবেন? একটা ব্যক্তিগত পরিসর আর একটা সামাজিক পরিসর। বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক পরিসরের অংশ। দুটোকে গুলিয়ে ফেলার কারণ নেই। ব্যক্তিগত ছবি ব্যবহার করে জীবন বিনাশী, হঠকারী সিদ্ধান্ত, এটা মোটেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঠিক কাজ করেনি।’