বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে…’

  •    
  • ১৫ জুন, ২০২২ ১৩:১৫

বর্ষা মানেই মেঘ, বৃষ্টি, প্রেম, নতুন প্রাণ, নতুন গান ও জেগে ওঠার অনুষঙ্গ। বর্ষা আমাদের আবহমান বাংলাকে অনেক বেশি রূপবতী করে তোলে। প্রকৃতি হয়ে ওঠে আরও বেশি সবুজ-শ্যামলীমাময়।

আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে/ আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে।/ এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি/ পলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি/ নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে/ আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে। ..রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

যদিও নতুন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে বৃষ্টির সুবাতাসের পরশে হৃদয়ে দোল লাগতে শুরু করেছে আরও বেশ কিছুদিন আগেই- তবুও ক্যালেন্ডারের পাতা অনুযায়ী আষাঢ় এসেছে আজ। আর এই দিনটির মধ্য দিয়েই সূচনা হচ্ছে প্রিয় ঋতু বর্ষার।

বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের কাঠফাটা গরমের পর বর্ষা যেন বহুল প্রতীক্ষিত এক ঋতু। সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দিয়ে থাকা রাশি রাশি কদম ফুলের কলি যেমন আষাঢ়ের বাদর দিনের অপেক্ষায় থাকে, তেমনি অপেক্ষায় থাকেন অগণিত কবি-সাহিত্যিক-গীতিকাররাও। সত্যিই আষাঢ় বাঙালির এক রোমান্টিক ঋতু। আষাঢ়ের কদম-কেতকী ধোয়া বৃষ্টি না এলে যেন পূর্ণতা পায় না বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য।

আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস মিলে বর্ষকাল। বর্ষা বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতির জন্য এক অপরিহার্য ঋতু। বর্ষা মানেই মেঘ, বৃষ্টি, প্রেম, নতুন প্রাণ, নতুন গান ও জেগে ওঠার অনুষঙ্গ। বর্ষা আমাদের আবহমান বাংলাকে অনেক বেশি রূপবতী করে তোলে। প্রকৃতি হয়ে ওঠে আরও বেশি সবুজ-শ্যামলীমাময়। বর্ষায় বিলে-ঝিলে শাপলা-শালুক ফোটে। কদমের পাশাপাশি হিজল-কেয়ার অপরূপ রূপে সেজে ওঠে চারপাশ। রিমঝিম বৃষ্টির শিহরণ হৃদয়কে করে তোলে স্নিগ্ধ ও সুশোভিত। বর্ষার জলে ধুয়ে-মুছে যায় দীর্ঘদিনের পুরোনো সব জঞ্জাল। বৃষ্টির পরশে নতুন শস্যাদি জন্মায়। রুক্ষ-অনুর্বর জমি উর্বর হয়। নদী, খাল-বিল ফিরে পায় পূর্ণ যৌবন। গাছপালা ফিরে পায় প্রাণ।

আবহমান বাংলার নারীদেরও প্রিয় ঋতু বর্ষা। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের নারীরা এ ঋতুটির জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন। আষাঢ় কিংবা শ্রাবণের ঘন বর্ষায় নৌকা বা ট্রলারে চড়ে তারা বাবার বাড়িতে বেড়াতে যান। বৃষ্টির দিনে ঘরের মেঝেতে নকশিকাঁথা বিছিয়ে ফুল তোলেন একের পর এক। অথবা বুনন করেন বাঁশ কিংবা তালপাতার পাখা।

মাঝিমাল্লারাও আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন বর্ষা ঋতুর জন্য। বর্ষা এলে তারা জলে নৌকা ভাসান। নাবিক সেজে দেশ ঘোরেন। তখন গেয়ে বেড়ান ভাটিয়ালী সুরের গান। জেলেরা নতুন পানির মাছ শিকার করে করেন বাড়তি রোজগার। অন্যদিকে কৃষক সম্প্রদায় বর্ষাকালে কিছুটা অবসর যাপন করেন। যেন সারা বছরের হাড়ভাঙা খাটুনির পর খানিকটা বিশ্রাম নেন তখন। এভাবে বর্ষা ঋতু নানাভাবে সম্পর্ক স্থাপন করে আছে মানবজীবনের সঙ্গে। সংগত কারণেই বর্ষায় মানবমন কাব্যিক দ্যোতনাময় হয়ে ওঠে। অকবিকেও করে তোলে কবি। বেসুরো লোককেও করে তোলে গায়েন।

আর এ কারণেই বাঙালি মননে সবচেয়ে বেশি রোমান্টিকতা ও আধ্যাত্মিকতার সুর বেজেছে এই বর্ষায়। বর্ষায় আবেগ ও অনুভূতির জোয়ারে ভাসেননি এমন কবি, সাহিত্যিক খুঁজে পাওয়া ভার। কালীদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ বা নির্মলেন্দু গুণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে হুমায়ূন আহমেদ- কেউই বর্ষাকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মা নদীর মাঝি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী, জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে, হুমায়ূন আহমেদের শ্রাবণ মেঘের দিনে দেখা যায়, বর্ষা যেন বিপুল বিস্ময় নিয়ে আবির্ভূত। তবে শুধু কবি-সাহিত্যিকরা নন, বর্ষার অপরূপ সৌন্দর্যের মুগ্ধতা ছুঁয়ে যায় অতি সাধারণ যে কাউকেও।

কবিকূলের শিরোমণি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায়, গানে, গল্পে নানাভাবে বর্ষার বন্দনা করেছেন। ‘আষাঢ়’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর, আউশের ক্ষেত জলে ভরভর, কালি-মাখা মেঘে ওপারে আঁধার, ঘনিছে দেখ্ চাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।’ আরেক কিবতায় বলেন, ‘ঐ আসে ঐ ঘন গৌরবে নবযৌবন বরষা, শ্যাম গম্ভীর সরসা।’ ‘বর্ষা-মঙ্গল’ কাব্যে লাবণ্যস্নিগ্ধ রূপবতী বর্ষাকালকে নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘ওগো সন্ন্যাসী, কী গান ঘনাল মনে।/গুরু গুরু গুরু নাচের ডমরু/বাজিল ক্ষণে ক্ষণে।/তোমার ললাটে জটিল জটার ভার/নেমে নেমে আজি পড়িছে বারম্বার/বাদল আঁধার মাতাল তোমার হিয়া,/বাঁকা বিদ্যুৎ চোখে উঠে চমকিয়া।’

অন্যদিকে মহাকবি মাইকেল মধূসুদন দত্ত লিখেছন, ‘গভীর গর্জন করে সদা জলধর/উথলিল নদ-নদী ধরনীর উপর। পল্লীকবি জসীম উদদীন বর্ষার বন্দনা লিখেছেন এভাবে: ‘বনের ঝিয়ারি কদম্বশাখে নিঝঝুম নিরালায়,/ ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে, অস্ফুট কলিকায়।’ এদিকে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণেরও প্রিয় ঋতু বর্ষা। তিনি বর্ষার চিত্র এঁকেছেন ঠিক এভাবে: ‘গ্রীষ্ম চলিল, বর্ষা আসিল, আষাঢ়ে নামিল ঢল;/বুনো পাখি সব ডাকে অবিরল: ‘বাওয়া ক্ষেত কর তল।’/এই তো কখন নেমেছে বৃষ্টি, অবিরাম তবু ঝরছে;/না পেয়ে উপায় রাখালের দল ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরছে।’

তবে উল্লিখিত সব বর্ণনার বাইরেও বর্ষার আরেক রাক্ষুসী রূপ আছে। মাঝে মাঝে বাঙালিদের প্রিয় ঋতু বর্ষাই আবার হয়ে ওঠে মারাত্মক কীর্তিনাশা, যা অসহনীয় করে তোলে সাধারণ মানুষকে। বিশেষ করে ঘন ঘোর বর্ষা কখনও কখনও দুর্যোগের বার্তা নিয়ে হাজির হয়। ফলে জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। বর্ষার অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যায় পানিবন্দি হয় অগণিত মানুষ । ভাসিয়ে নেয় জনপদ। ওদিকে আবার হাওর আর খরস্রোতা নদীর রাক্ষুসী ঢেউয়ে চোখের পলকে ভেঙে নেয় উপকূল। টানা বৃষ্টিবাদলে কর্মহীন হয়ে পড়েন খেটে খাওয়া মানুষ। যদিও এমন বর্ষা চায় না কেউই।

তবুও বলি, বর্ষা আসুক। প্রাণ-প্রকৃতি বরাবরের মতোই আষাঢ় ও শ্রাবণের সজল মেঘের বৃষ্টিতে স্নাত হোক। সিক্ত হোক। বর্ষার জলে শুধু প্রকৃতিরই নয়, মানবজীবনেরও সব জঞ্জাল ধূয়ে-মুছে অপসারিত হোক। কদম, কেতকী, জুঁই, কামিনী, বেলি, রজনীগন্ধা ও দোলনচাঁপাসহ শতফুলের সুবাসে সুবাসিত হোক প্রত্যেকের হৃদয়। সবার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসুক ‘সজল শ্যাম ঘন বরষা’।

এ বিভাগের আরো খবর