বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘জীবন খুবই সহজ এবং মজার’

  •    
  • ৬ জুন, ২০২২ ২১:৩৫

থাইল্যান্ডের কৃষক জন জানদাই বলেন, ‘আগে আমার অনেক ভয় ছিল। আমি কিছুই করতে পারতাম না। তবে এখন মুক্তবোধ করি। মনে হয়, পৃথিবীতে আমি একজন অনন্য মানুষ। কেউ নেই আমার মতো। আমার অন্য কারোর মতো হওয়ার দরকার নেই। আমিই প্রথম। এ বিষয়গুলো আসলেই সহজসাধ্য, খুব হালকা।’

উত্তর-পূর্ব থাইল্যান্ডের কৃষক জন জানদাই। স্ত্রী পেগি রিন্টসকে নিয়ে ২০০৩ সালে পর্বতঘেরা চিয়াং মাই শহরে গড়ে তোলেন পুন পুন নামে একটি জৈব খামার। উদ্দেশ্য দেশীয় এবং বিরল বীজগুলোকে আবার ব্যবহারের উপযুক্ত করে তোলা। এ প্রকল্পে দারুণ সফল জন।

উদ্যোক্তার পাশাপাশি জন একজন অধিকারকর্মীও। গত ১০ বছরে এক ডজন প্রকাশনার পাশাপাশি টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের মুখপাত্র হিসেবেও দেখা গেছে তাকে। তবে জীবনকে সহজভাবে নেয়ার ওপরে ২০১১ সালে দেয়া বক্তৃতার পর বিশ্বজুড়ে জনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

‘লাইফ ইজ ইজি, হোয়াই উই মেইক ইট সো হার্ড?’ শীর্ষক সেই বক্তৃতার বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হলো নিউজবাংলার পাঠকের জন্য।

‘একটি শব্দ আছে যা আমি সব সময় সবাইকে বলতে চেয়েছি। শব্দটি হলো “জীবন সহজ”। এটা খুবই সহজ এবং মজার। এর আগে আমি কখনও এমন ভাবিনি।

যখন ব্যাংককে ছিলাম, আমার মনে হয়েছিল জীবন খুব কঠিন, খুব জটিল।

আমার জন্ম থাইল্যান্ডের উত্তর-পূর্বের একটি দরিদ্র গ্রামে। ছোটবেলায় সবকিছু ছিল মজার এবং সহজ। যখন টিভি এলো, তখন অনেক লোক গ্রামে এসেছিল। তারা বলেছিল, ‘আপনি গরিব, আপনাকে সফলতার পথ অনুসরণ করতে হবে। জীবনে সাফল্য অর্জনের জন্য আপনাকে ব্যাংকক যেতে হবে।

আমার খুব খারাপ লাগছিল। ঠিক করলাম, সফলতা অর্জনের জন্য আমাকে ব্যাংকক যেতেই হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা

রাজধানীতে অনুভব করলাম, কঠোর পরিশ্রম করার পরও আমার জীবন এত কঠিন কেন?বুঝতে পারলাম, এখানে কিছু একটা গোলমাল আছে। কারণ আমি অনেক কাজ করতাম, কিন্তু এর বিনিময়ে পর্যাপ্ত মজুরি পেতাম না।

আমার ব্যাংকক যাত্রা খুব একটা সুখকর ছিল না। সবাই বলত, আপনাকে শিখতে হবে, অনেক পড়াশোনা লাগবে এবং কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। তারপর আপনি সাফল্য পেতে পারেন।

আমি কঠোর পরিশ্রম করেছি, প্রতিদিন অন্তত ৮ ঘণ্টা। বিনিময়ে আমি যা খেতে পারতাম তা হলো এক বাটি নুডুলস বা ফ্রাইড রাইস বা এ রকম কিছু। অনেকের সঙ্গে একটা ঘুপচি ঘরে থাকতাম। সেখানে প্রচণ্ড গরম ছিল।

এমন পরিস্থিতির মুখে অনেক প্রশ্ন জাগতে থাকে আমার মধ্যে। এত পরিশ্রম করেও জীবন এত কঠিন কেন? কিছু একটা ঝামেলা তো আছেই। আমি অনেক কাজ করতাম, বিনিময়ে পর্যাপ্ত পেতাম না।

আমি শিখতে চাইতাম, জানতে চাইতাম। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখা খুব কঠিন, খুব বিরক্তিকর

যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়গুলো দেখতাম, এগুলোর বেশির ভাগেরই ধ্বংসাত্মক জ্ঞান চোখে পড়ত। আমার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো উৎপাদনশীল শিক্ষা ছিল না।

মনে হতে থাকে, আপনি যদি স্থপতি বা প্রকৌশলী হতে চান, তার মানে আপনি সবকিছু ধ্বংস করতে যাচ্ছেন। এই ব্যক্তিরা যত বেশি কাজ করবে, তত বেশি পাহাড় ধ্বংস হবে। চাও ফ্রেয়া নদীর কাছের উর্বর জমিগুলো কংক্রিটে ঢেকে যাবে।

যদি কৃষি অনুষদ বা এ-জাতীয় কিছুতে পড়াশোনা করেন, তার মানে আপনি কীভাবে বিষ দিয়ে জমি ও পানিকে বিষাক্ত করতে হয়, এসব শিখবেন।

আমার মনে হতে থাকে, সবকিছু কত জটিল, কত কঠিন। সবকিছুকেই আমরা কঠিন করে তুলেছি।

জীবন এত কঠিন! হতাশা বোধ করি

আমি ভাবতে লাগলাম, কেন আমাকে ব্যাংকক থাকতে হবে? আমি যখন ছোট ছিলাম তখন দেখতাম, কেউ দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করত না, সবাই ২ ঘণ্টা কাজ করত। বছরের দুই মাস কাজ করত। এক মাসে ধানের বীজ বপন করত; অন্য মাসে ধান কাটত। বাকি ১০ মাস ছিল অবসর। এ কারণে থাইল্যান্ডে উৎসব লেগেই থাকে। প্রতি মাসেই কোনো না কোনো উৎসব থাকে।

দুপুরে সবাই ঘুমিয়ে নেয়। এখনও যদি লাওসে যান দেখবেন লোকেরা দুপুরের খাবারের পর ঘুমিয়ে নেয়। জেগে ওঠার পর তারা কেবল গল্প করে। গল্পের বিষয়গুলোও বেশ হালকা। এই যেমন তোমার জামাই কেমন আছে, বউ কেমন আছে, পুত্রবধূ কেমন আছে। আসলে মানুষের হাতে অনেক সময় থাকে। তার মানে নিজের জন্য অনেক সময় থাকে।

সেখানকার মানুষদের পর্যাপ্ত সময় আছে। এ কারণে নিজের জন্য ব্যয় করার সময় আছে তাদের। যেহেতু নিজেদের জন্য সময় আছে, তাই তারা নিজেদের বোঝার জন্য সেই সময় ব্যয় করতে পারে। তারা জীবনে আসলে কী চায়, তা জানতে পারে। অনেকে সুখ চায়, অনেকে ভালোবাসা চায়, অনেকে তাদের জীবনকে উপভোগ করতে চায়।

তারা জীবনের সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে পারে। সেই সৌন্দর্যকে বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশও করতে পারে। অনেকে খুব সুন্দর করে ছুরির হাতল খোদাই করে। অনেকে ঝুড়ি বুনেন।

তবে ব্যাংককের লোকেরা এসব করে না। তারা এমন কিছু করতেই পারে না। তারা সব জায়গায় প্লাস্টিক ব্যবহার করে। আমার মনে হয়েছে, এখানে কিছু একটা গোলমাল আছে। আমার মনে হতো, এভাবে বাঁচতে পারব না। তাই আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং বাড়ি ফিরে এলাম।

বাড়ি ফিরে শৈশবের দিনগুলোর মতো বাঁচতে লাগলাম। বছরের দুই মাস চাষাবাদ করে সেখান থেকে চার টন চাল পাই। ছয়জনের পুরো পরিবার মিলে বছরে আধা টনেরও কম চাল খেতে পারি। এতে কিছু চাল বিক্রিও করতে পারি।

এরপর মাছ চাষের জন্য দুটি পুকুর খনন করি। সারা বছর আমার আর মাছ কিনতে হয় না। আধা একরেরও কম জায়গা নিয়ে একটি ছোট বাগানও করে ফেলি। সেটির যত্ন নিতে দিনে গড়ে ১৫ মিনিট ব্যয় করি। এখন আমার বাগানে ৩০ জাতের বেশি সবজি আছে। ছয়জন মানুষ সব খেতে পারে না। বাজারে বিক্রির জন্য কিছু থেকে যায়। তা বিক্রি করেও কিছু আয় করতে পারি।

বাসস্থান

আমার মনে হয়, জীবন সহজ। তবে কেন আমাকে সাত বছর ব্যাংকক থাকতে হবে, যেখানে কঠোর পরিশ্রম করেও পর্যাপ্ত খাবার নেই! এখানে বছরে মাত্র দুই মাস, প্রতিদিন ১৫ মিনিট ব্যয় করে আমি ছয়জনকে খাওয়াতে পারি। এ কারণে আমি বলতে পারি, এটা খুব সহজ।

আগে ভাবতাম, আমার মতো নির্বোধরা যারা কখনও বিদ্যালয়ে ভালো নম্বর পায় না, তারা ঘরবাড়ি গড়তে পারে না। কারণ যারা প্রতি বছর ক্লাসে প্রথম হয় তারা আমার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। তারা ভালো চাকরি পায়। তবে তাদের বাড়ি পেতে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করতে হয়।

একটা বিষয় তখন আমাকে খুব ভাবাত। সেটা হলো, আমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিই পেরোতে পারিনি, সেই আমি কীভাবে বাড়ি গড়ে তুলতে পারি? আমার মতো স্বল্পশিক্ষিত লোকদের জন্য এটা সত্যিই হতাশার।

এরপর আমি মাটির দালান গড়তে লাগলাম। এটা বেশ সহজ। আমি প্রতিদিন ২ ঘণ্টা ব্যয় করি। ভোর ৫টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত ২ ঘণ্টা কাজ করি। এভাবে আমি তিন মাসের মধ্যে একটি বাড়ি পেয়ে যাই।

আমার আরেক বন্ধু যে ক্লাসে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ছিল, তারও বাড়ি বানাতে তিন মাস সময় লেগেছে। তবে তাকে ধার করতে হয়েছে। ৩০ বছর ধরে সে ঋণ তাকে পরিশোধ করতে হয়েছে। তার তুলনায় আমার ২৯ বছর এবং ১০ মাস অবসর সময় আছে। যে কারণে আমি অনুভব করতে পারি, জীবন খুব সহজ।

কখনও ভাবিনি এত সহজে বাড়ি বানাতে পারব। প্রতি বছর অন্তত একটি করে ঘর বানাই। আমার কাছে টাকা নেই, তবে আমার অনেক ঘর আছে। আমি রাতে কোন ঘরে ঘুমাতে যাব এখন সেটাই সমস্যা! আসলে বাড়ি করা কোনো সমস্যা নয়, কেউ চাইলেই তা করতে পারে।

১৩ বছরের শিশুরা যারা স্কুলে একসঙ্গে খেলনাঘর গড়ে, তারাও ঘর তৈরি করতে পারে। এভাবে কাজ শুরু করলে এক মাস পর তাদের একটা পড়ার জায়গা হয়ে যায়।

একজন বৃদ্ধ সন্ন্যাসীও নিজের থাকার জন্য একটা কুঁড়েঘর গড়তে পারেন। যে কেউ ঘর গড়তে পারে। তার মানে এটাও সহজ। বিশ্বাস না করলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

পোশাক

বাড়ি আর খাবারের পর হলো পোশাক। আমি মনে করি আমি দরিদ্র, সুদর্শন নই। তাই আমি সিনেমার তারকাদের মতো সাজতে চেষ্টা করেছি। নিজেকে আরও সুন্দর দেখানোর জন্য।

এক জোড়া জিন্স কিনতে প্রায় এক মাস ধরে টাকা সঞ্চয় করলাম। জিন্স পরার পর আয়নায় নিজেকে দেখলাম। কিন্তু কোনো পরিবর্তন পেলাম না। বুঝতে পারলাম, সবচেয়ে দামি প্যান্টও আমার জীবন পরিবর্তন করতে পারবে না। তখন নিজেকে মূর্খ মনে হচ্ছিল। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমাকে কেন এটা কিনতে হবে? এক জোড়া প্যান্ট কিনতে আমি এক মাস ব্যয় করেছি, অথচ এটা আমাকে পরিবর্তন করেনি!

বিষয়টি নিয়ে আরও ভাবতে লাগলাম। কেন আমাদের ফ্যাশন ফলো করতে হবে? আমরা যখন ফ্যাশন ফলো করি, তখন নিজেরা কখনই ফ্যাশনে পরিণত হই না। কারণ আমরা কেবল এর ফলোয়ার। তাই এটি আর ফলো করবেন না, এখানেই থামুন। আপনার যা আছে, তা ব্যবহার করুন।

মজার বিষয় হলো, তখন থেকে এ পর্যন্ত এই ২০ বছরে আমি কোনো কাপড় কিনিনি। আমার কাছে যেসব জামাকাপড় আছে, সেগুলোর সবই মানুষের উচ্ছিষ্ট। যখন কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে যাওয়ার সময় তারা অনেক কাপড় রেখে যায়। এ কারণে আমার কাছে অনেক কাপড় আছে।

লোকে যখন আমাকে অনেক পুরোনো কাপড় পরতে দেখে, তখন তারা আমাকে আরও বেশি কাপড় দেয়। এখন আমার কাছে এত কাপড় জমেছে যে প্রায়শই তা মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হয়।

যখন জামাকাপড় কেনা বন্ধ করে দিই, তখন থেকে আমার মনে হয়, এটি শুধু জামাকাপড়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে তা নয়। এটা আমার জীবনের অন্য কিছু সম্পর্কেও কাজে আসতে পারে। এখান থেকে আমি যা শিখেছি তা হলো, আমি যখন কিছু কেনার সিদ্ধান্ত নিই, তখন আমি ভেবে দেখি এটা আমার পছন্দ, নাকি প্রয়োজন। উত্তরটি যদি পছন্দ হয় তার মানে আমি ভুল করছি। আমি যখন এভাবে চিন্তা করি, তখন আমি সত্যিই আরও স্বাধীন অনুভব করি।

চিকিৎসা

আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে কী করব? বিষয়টি শুরুতে আমাকে খুব ভাবাত। কারণ আমার কাছে যখন টাকা থাকবে না, তখন আমি কী করব। এই নিয়ে ভাবতে শুরু করি।

অসুস্থতা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা খারাপ না। অসুস্থতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা জীবনে কিছু ভুল করেছি। তাই অসুস্থ হয়েছি। যখন অসুস্থ হই, তখন আমাকে থামতে হবে এবং নিজের কাছে ফিরে আসতে হবে।

ভেবে দেখতে হবে, কী ভুল করেছি। আমি শিখেছি কীভাবে আরোগ্য লাভের জন্য পানি ব্যবহার করতে হয়। শিখেছি কীভাবে আরোগ্য লাভের জন্য পৃথিবীকে ব্যবহার করতে হয়। কীভাবে আরোগ্য লাভের জন্য প্রাথমিক জ্ঞান ব্যবহার করতে হয়।

পরিশেষে

নিজে যখন কেবল খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার ওপর নির্ভর করি, তখন মনে হয় জীবন খুব সহজ। আমি স্বাধীনতার মতো কিছু একটা অনুভব করি, মুক্তবোধ করি। আমি খুব একটা চিন্তা করি না। আমার ভয়ও কম। আমি আমার জীবনে যা চাই তা-ই করতে পারি।

আগে আমার অনেক ভয় ছিল। আমি কিছুই করতে পারতাম না। তবে এখন মুক্তবোধ করি। মনে হয়, পৃথিবীতে আমি একজন অনন্য মানুষ। কেউ নেই আমার মতো। আমার অন্য কারোর মতো হওয়ার দরকার নেই। আমিই প্রথম। এই বিষয়গুলো আসলেই সহজসাধ্য, খুব হালকা।

এ বিভাগের আরো খবর