অভিভাবকত্বের জ্ঞানটা আসে পরিবার থেকেই। সে অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে নিজের আদরের সন্তানকে গড়ে তোলায় তৎপর হন সবাই। তবে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সেই ধারায় বদল এসেছে। সন্তান লালনপালনের সনাতনী সেসব ধারণা থেকে বেরিয়ে আসছেন অভিভাবকরা।
এমন বাস্তবতায় আজ বুধবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব অভিভাবক দিবস। জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০১২ সাল থেকে প্রতি বছরের ১ জুন বিশ্বজুড়ে দিনটি পালিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে আজও অনেক অভিভাবক সনাতনী ধারায়ই সন্তান লালনপালনে অভ্যস্ত। একই সঙ্গে নতুন ধারাও বেগবান হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপসহ নানা সাইট থেকে পরামর্শ নিয়ে সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনের প্রবণতা ক্রমে বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সন্তান কিভাবে মানুষ হবে, তার মূল্যবোধের জায়গাটা কী হবে- এই পুরো প্রক্রিয়া সঠিক অভিভাবকত্বের ওপর নির্ভর করে।
বাংলাদেশে অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে মনোযোগ ও সচেতনতার ধারাটা সঠিকভাবে তৈরি হয়নি। সঠিক অভিভাবকত্ব কিভাবে প্রয়োগ করা যায় সেক্ষেত্রে মা-বাবা আজও পুরোপুরি সচেতন নন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সন্তান কিভাবে মানুষ হবে, তার মূল্যবোধের জায়গাটা কী হবে- এই পুরো প্রক্রিয়া সঠিক অভিভাবকত্বের ওপর নির্ভর করে। ছবি: সংগৃহীত
বেসরকারি চাকরিজীবী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান মারুফের সন্তান সৈয়দ মিরাফ রহমান ইয়ানের বয়স দুই বছর হতে চলল। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগে সন্তান কোনো ঘটনা ঘটানোর পর মা-বাবা ব্যবস্থা নিয়েছেন। তবে বর্তমানে অভিভাবকরা অনেক অ্যাডভান্সড। আগাম চিন্তা থেকেই আমরা সন্তানের ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়ে নেই।’
অভিভাবকত্বের এই ধ্যান-ধারণাটা কোথা থেকে পাচ্ছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অনলাইন মিডিয়া, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে ধারণা নেয়ার পাশাপাশি চিকিৎসকের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। বর্তমানে ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ আছে। তাতে ক্রিটিক্যাল মোমেন্টস নিয়ে বিভিন্ন ধরনের টিপস থাকে। বাচ্চা যখন কিছু বুঝতে চায় না তখন বাচ্চার সঙ্গে কী আচরণ করা উচিত, সে বিষয়গুলোও জানা যায়।
‘তবে এটা ঠিক, বাবা হওয়ার পর নিজেদের শৈশবের অভিজ্ঞতা থেকেই পিতৃত্বের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি সম্পর্কে একটি ধারণা আসে। এ বিষয়ে আজও বাবার কাছ থেকে শিখছি।’
বাবার কাছ থেকেই পিতৃত্ব বিষয়টি শিখছেন বলে মনে করেন ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম টিংকু। তিনি বলেন, ‘বাবা হওয়ার পর সন্তানের যত্নআত্তির পাশাপাশি অন্যান্য দায়িত্ব পালনের বিষয়গুলো সম্পর্কে আস্তে আস্তে জানতে শুরু করি। তবে এখন ডিজিটাল যুগ। সমস্যা সমাধানে চিকিৎসকের পাশাপাশি ইউটিউব বা বিভিন্ন সাইট ঘেঁটে নানা উপদেশ-পরামর্শ পেয়ে যাই। তবে আমাদের শৈশবে বাবা-মায়েদের জন্য বিষয়টি অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। বর্তমানে সেই চ্যালেঞ্জ একটু কম।’
মিডিয়া কর্মী সারওয়ার হোসেন বলেন, ‘ডে-কেয়ারে যে সন্তানরা বেড়ে উঠছে তাদের তো বাধ্য হয়েই সেখানে রাখছেন অভিভাবকরা। কারণ মা-বাবা দুজনই বাইরে কাজে ব্যস্ত থাকেন। ফলে বেশ বড় একটা সময় শিশু মা-বাবার সান্নিধ্য ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত থাকে।
‘পারিবারিক বন্ধন ক্রমে আলগা হয়ে যাওয়ার প্রবণতাও শিশুদের একাকিত্বের একটি বড় কারণ। আগে যৌথ পরিবারে আর দশটা শিশুর মাঝে থেকে সন্তান বেড়ে উঠত। বর্তমানে বিশেষত নগর জীবনে শিশুরা বলতে গেলে ঘরবন্দি জীবন কাটায়। তাদের চেনা মুখ বলতে থাকেন মা-বাবা। এ অবস্থায় মা-বাবাও অভিভাবকের দায়িত্ব সম্পর্কে পরামর্শ নেয়ার জন্য কাউকে পাশে পান না। তারা তখন নির্ভর করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্যান্য দিকের ওপর।’
সংবাদকর্মী আহমেদ দীপ্ত বাবা হয়েছেন ছয় মাস আগে। মেয়ের নাম হুমাইশা মারিয়াম দ্যুতি। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথম বাবা হয়ে আমি সন্তানের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। আবার সংবাদকর্মী হওয়ায় বাসায় সন্তানকে খুব একটা সময়ও দিতে পারি না। প্যারেন্ট হুড নিয়ে গুগল করে বেশ কিছু আর্টিকেল পড়েছি।’
মোমেনা আক্তার মিতু মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছেন এক যুগ আগে। দুই ছেলে ও এক মেয়ের এই মা অভিভাবকত্বের জ্ঞান নিয়েছেন নিজের মায়ের কাছ থেকেই। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি নিজের অতীত এবং বর্তমানের বাস্তবতা মিলিয়েই সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করি।’
রাজধানীর মোহাম্মাদপুরের বাসিন্দা ছাদিকুর রহমান শামীম বাবা হওয়ার অভিজ্ঞতাকে চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে বলেন, ‘বাবা হওয়ার পর কিছু দায়িত্ব যোগ হয়েছে। এটা অভিভাবকত্ব। পিতৃত্ব বিষয়টা নিজের বাবার কাছ থেকে সনাতনী পদ্ধতিতে শিখেছি। তবে নতুন যেসব বিষয় জানা নেই সেগুলো অ্যাডজাস্ট করার চেষ্টা করছি। সন্তানের সঙ্গে কানেক্ট থাকার চেষ্টা করি।’
উই লার্ন ডে-কেয়ারের ডিরেক্টর এবং প্রাক-শিশুকালীন বিকাশ বিশেষজ্ঞ ফারজানা সেলিনা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা কারিকুলাম বেইজড একটি পদ্ধতি অনুসরণ করছি। খেলার মধ্য দিয়ে শিখিয়ে সামগ্রিক বিকাশের মাধ্যমে শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।’
তিনি বলেন, ‘শিশুদের বিশেষ করে তিন বছর বয়সের সময়ে মানসিকতার বিকাশ বেশি হয়। বুদ্ধি-ভাষার উন্নয়ন যেন সঠিকভাবে হয় সেটার জন্য আমরা কাজ করি।’
বর্তমানে অভিভাবকরা কিভাবে সন্তান লালনপালন করছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগে নিয়ম ছিল খুব শাসনের মধ্য দিয়ে বাচ্চাদের বড় করা। বর্তমান সময়ে সবকিছু (আপডেটেড) হালনাগাদ হয়েছে। অভিভাবকরা বুঝতে পারছেন যে তাদের আগের নিয়মে চললেই হবে না। বাচ্চাদের সঙ্গে কানেক্ট হতে হবে। পাশাপাশি কো-অপারেট করতে হবে।
‘বর্তমান সময়ে অনেক মা-বাবাই কাজের উদ্দেশ্যে বাসার বাইরে থাকেন। এ কারণে বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের কানেকশনটা সেভাবে হয় না। আমরা ছোটবেলায় যেটা পেতাম সেই জায়গাটা খুব মিসিং।’
‘এমন নানা কারণে বাচ্চারা কথা দেরিতে বলছে। কথা বলতে পারছে না। কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। এ ধরনের সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।’
নিজেদের ব্যস্ততার কারণে বর্তমানে অনেক মা-বাবা ডিভাউস মোবাইল দিয়ে বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেন। মোবাইল সেট নিয়ে বাচ্চারা ঠান্ডা থাকছে। তবে এটা কোনো সলিউশন নয়। মোবাইল বাচ্চাদের জীবনে ভবিষ্যতে বড় ধরনের ইফেক্ট ফেলছে।
সন্তান পালনের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সন্তান কিভাবে মানুষ হবে, তার মূল্যবোধের জায়গা কী হবে, এই পুরো প্রক্রিয়া সঠিক অভিভাবকত্বের ওপর নির্ভর করে।’
বাংলাদেশে প্যারেন্টিংয়ের প্রসঙ্গ টেনে ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে যে মনোযোগ দরকার, সে ব্যাপারে সচেতনতা ঠিকভাবে তৈরি হয়নি। সঠিক অভিভাবকত্ব প্রয়োগের জায়গায় তারা অতটুকু সচেতন নন।’
শিশুদের পরিপালনের ক্ষেত্রে যে বিষয় মাথায় রাখতে হবে: শিশুদের লালন-পালনের ক্ষেত্রে যে বিষয় মাথায় রাখতে হবে তা উল্লেখ করে মালেকা সরকার বলেন,‘ কোনো অবস্থাতেই বাচ্চারা যা চায় সে বিষয়ে অতিরিক্ত প্রশয় দেব না। আবার অতিরিক্ত কঠিন শাসনও করব না। কারণ সেটাও শিশুদের জন্য ক্ষতিকারক। বাচ্চারা অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করলে সে বিষয়ে পারতপক্ষে মনোযোগ দেব না।
প্রশ্রয় ও জেদ পূরণ করলে শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ বাড়বে। যখনই জেদ করবে বিষয়টি উপেক্ষা করতে হবে। উপেক্ষার পাশাপাশি সাময়িকভাবে তার কিছুটা সুবিধা কমিয়ে ফেলা যেতে পারে। শাস্তির বদলে প্রাপ্য সুবিধা কিছুটা কমিয়ে দেয়া। আর যখনই বাচ্চা ভালো কাজ করবে তাকে প্রশংসা করতে হবে। উৎসাহও দেয়া যেতে পারে।
চাইল্ড কেয়ারের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘সঠিক মানের চাইল্ড কেয়ার হলে সে ক্ষেত্রে বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখা যেতে পারে। একটি শিশু ডে-কেয়ার সেন্টারে অনেক বাচ্চার সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পায়। বাচ্চাদের একা বাসায় রেখে যাওয়া ক্ষতিকারক। মোবাইল ফোনও শিশুদের জন্য ক্ষতিকর।