গ্রীষ্মের তপ্ত রোদে কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙের আভায় পুরান ঢাকার এক টুকরো সবুজের প্রাণকেন্দ্র জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) সেজেছে বর্ণিল সাজে। গ্রীষ্মের নিষ্প্রাণ রুক্ষতা ছাপিয়ে ক্যাম্পাসের কৃষ্ণচূড়া মেলে ধরেছে তার রূপ।
সবুজ পাতার ফাঁকে উজ্জ্বল লাল রঙের কৃষ্ণচূড়ার অপূর্ব বাহারি দৃশ্য চোখ জুড়ায়। এ যেন ফুল-পাতা দিয়ে গড়া প্রকৃতির এক স্বর্গরাজ্য। যা ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফটক, সমাজকর্ম ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সামনে, ভাষা শহীদ রফিক ভবনের পাশে, শান্ত চত্বর, ক্যাফেটেরিয়ার সামনে, মুক্তমঞ্চের আশেপাশে, সায়েন্স ফ্যাকাল্টির পুরোটা জুড়ে ও একাডেমিক ভবনের পেছনেসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় কৃষ্ণচূড়া গাছের রাঙা ফুল প্রকৃতির সব রঙকে ম্লান করে দিয়েছে।
ক্যাম্পাসের বিজ্ঞান অনুষদ চত্বর, প্রশাসনিক ভবনের পাশে ডালপালা ছড়ানো বিশাল আকৃতির কৃষ্ণচূড়াগুলো সৃষ্টি করেছে রক্তিম বর্ণের এক মোহনীয়তা।
সকালে গাছের নিচে কৃষ্ণচূড়ার ঝরে পড়া রক্তলাল পাপড়ি তৈরি করে এক পুষ্প শয্যা। সকাল থেকে সন্ধ্যা এসব গাছের নিচেই আড্ডায় মাতেন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিস সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর অধিকাংশই কলেজ থাকা অবস্থায় রোপণ করা। এ ছাড়া একাডেমিক ভবন ও দ্বিতীয় ফটকের গাছগুলো ২০০৮ সালের পর লাগানো হয়েছে। অন্য গাছগুলো কখনো শিক্ষার্থীরা আবার কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জায়গায় লাগানো হয়েছে। ২০১৭ সালের ১৭ মে দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্ত চত্বরে বেড়ে ওঠা ক্যাম্পাসের লাল সুন্দরী খ্যাত ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী কৃষ্ণচূড়া গাছটি কোনো ঝড়-বৃষ্টি ছাড়াই হঠাৎ উপড়ে পড়ে যায়।
কৃষ্ণচূড়া গাছ পত্রপল্লব এবং আগুনলাল ফুলের জন্য বিখ্যাত। এটি উচ্চতায় সাধারণত ১২-১৪ মিটার হয়। তবে শাখা-পল্লবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো বড় ৭ থেকে ৮টি পাপড়িযুক্ত। ফুলের ভেতরের অংশ হালকা হলুদ ও রক্তিম হয়ে থাকে। পাপড়িগুলো প্রায় আট সেন্টিমিটারের মত লম্বা হতে পারে। এর প্রতিটি পাতা ৩০-৫০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ২০-৪০টি উপপত্র বিশিষ্ট।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে কৃষ্ণচূড়া ফুল ফোটে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত। কুঁড়ি আসার কিছুদিনের মধ্যে পুরো গাছ ভরে যায় ফুলে ফুলে।
কৃষ্ণচূড়ার বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিক্স রেজিয়া। এটি Caesalpiniaceae (সিসালপিনিয়েসি) গোত্রের অন্তর্গত একটি উদ্ভিদ। এর আদি নিবাস আফ্রিকার মাদাগাস্কার। ১৮২৪ সালে সেখান থেকে প্রথম মুরিটাস, পরে ইংল্যান্ড এবং শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তার ঘটে। এখন জন্মে আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল, হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ চীন, ভারতসহ বিশ্বের বহু দেশে।
ধারণা করা হয়, কৃষ্ণচূড়া ভারত উপমহাদেশে এসেছে তিন থেকে চার শ বছর আগে। বহুকাল ধরে আছে বাংলাদেশে। তবে ফুলের নাম কী করে কৃষ্ণচূড়া হলো সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায় না।
কৃষ্ণচূড়া গাছের আরেক নাম গুলমোহর। যদিও তা কম লোকই জানেন, কিন্তু কৃষ্ণচূড়াকে চেনেন না এমন লোক খোঁজে পাওয়া দায়।
কৃষ্ণচূড়াকে সাধারণত আমরা লাল রঙেই দেখতে অভ্যস্ত হলেও উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃষ্ণচূড়া লাল, হলুদ ও সাদা রঙেরও হয়। আমাদের দেশে লাল ও হলুদ রঙের ফুল দেখা গেলেও সাদা রঙের কৃষ্ণচূড়া দেখা যায় না।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মিথিলা দেবনাথ ঝিলিক বলেন, ‘কৃষ্ণচূড়া আমাদের ক্যাম্পাসের পরিবেশ লাল রঙে রাঙিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন লাল টুকটুকে বউ, এই লালের মাঝে ইচ্ছে করে হারিয়ে যেতে। গ্রীষ্মের এই খরতাপে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী মেহরাব হোসেন অপি বলেন, ‘ঈদের ছুটি কাটিয়ে এসে কৃষ্ণচূড়ায় পরিপূর্ণ লাল টুকটুকে ক্যাম্পাস দেখে মনে হচ্ছে যেন ঈদের শেষে আবার কোথাও ঘুরতে এসেছি। এমন সুন্দর দৃশ্য দেখে নিজের সবুজে ঘেরা গ্রাম ছেড়ে আসার জন্য যে মন খারাপ লাগছিল তাও যেন ভুলে গেছি।’
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাঈমা আক্তার বলেন, ‘আমার পছন্দের ফুলগুলোর তালিকায় প্রথমেই স্থান পায় কৃষ্ণচূড়া। এর রক্ত বর্ণ রূপ, সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে বার বার’
কৃষ্ণচূড়ার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘গাছটি খুবই নরম। এটি আমাদের দেশীয় কোনো গাছ না। এরা ঝড়-ঝাপটায় টিকে থাকতে পারে না। কৃষ্ণচূড়া ফুল ফোটার ব্যাপ্তিকাল ভিন্ন। রাতের নিরবিচ্ছিন্ন একটা দৈর্ঘ্য ব্যতীত কৃষ্ণচূড়া ফুল ফুটতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ক্যাম্পাসের বড় গাছটি হেলে আছে ঝুঁকিপূর্ণভাবে। যেকোনো সময় সেটি পড়ে যেতে পারে।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শিক্ষক সমিতির সদস্য ড. এ এম এম গোলাম আদম জানান, কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদের আদিনিবাস মাদাগাস্কার হলেও ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, পাকিস্তানসহ অনেক দেশেই এর বিস্তৃতি। এই উদ্ভিদের লাল, কমলা, হলুদ ফুল এবং উজ্জ্বল সবুজ পাতা রয়েছে। এই বিভিন্ন রং মূলত ক্লোরোফিল, কারোটেনোয়েডস ও অ্যানথোসাইনিন নামক রঞ্জক পদার্থের উপস্থিতির কারণেই হয়ে থাকে।’
উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃক্ষরোপণ কমিটির সদস্য বিভাস কুমার সরকার বলেন, ‘বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে (এপ্রিল-জুন) এই ফুল বেশি দেখা যায়। সৌন্দর্যবর্ধন ছাড়াও এই গাছ উষ্ণ আবহাওয়ায় ছায়া দিতে উপযুক্ত। ক্যাম্পাসকে আরও সুন্দর করতে কৃষ্ণচূড়া লাগোনো যেতে পারে।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ট্যাক্সোনমিক ও উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. নাহিদ সুলতানা বলেন, ‘আমাদের দেশে পত্র ঝরা এই কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদটির পাতা শীতকালে ঝরে যায় আর বসন্তকালে ফুল ফোটে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষ্ণচূড়ার ফুল ফোটার সময় ভিন্ন। অপরূপ সৌন্দর্য ছাড়াও এর পাতা, মূলের বাকল ও ফুল ভেষজ গুণাগুণ সম্পন্ন যা জ্বর ও খুশকি নিরাময়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।’