বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শিথিল সংসারজীবনে বাড়ছে বোঝাপড়ার অভাব

  •    
  • ১৫ মে, ২০২২ ১৯:৪২

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে বিয়েবিচ্ছেদ বেড়েছে ১৭ শতাংশ। ২০২০ সালে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে ১২ হাজার ৫১৩টি ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৪৮১টি আবেদন করেছিলেন নারী, বাকি ৪ হাজার ৩২টি বিচ্ছেদ চেয়েছিলেন পুরুষ।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে প্রেমের শুরু, তার বয়স দশক পেরিয়ে গেলেও সম্পর্কের উষ্ণতা মরেনি। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে সংসারজীবনে প্রবেশ। সেই শুরুটাও ছিল দারুণ। তবে ধীরে ধীরে আসে ভাটার টান। সংসারের নানা খুঁটিনাটি নিয়ে শুরু হয় টানাপড়েন। ভুল-বোঝাবুঝি শুরু হলে, বাড়তে থাকে মানসিক দূরত্ব।

এভাবেই ১১ বছর ধরে বিবর্ণ সংসার টেনে নিয়ে যাচ্ছেন ফজল-মিশু দম্পতি (ছদ্মনাম)। সংসারজীবনে সন্তানহীনতা আরও জটিল করেছে পরিস্থিতি। এক পর্যায়ে জীবিকার প্রয়োজনকে সামনে এনে দুজনের ঠিকানা হয় দুটি আলাদা জেলায়। দূরত্ব প্রায় সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার।

এখন লোক দেখানো কাগুজে সম্পর্কই শুধু টিকে আছে। তবে সামাজিক বাস্তবতা মেনে এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথাও তুলতে চান না তারা।

মিশু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এসব নিয়ে কীভাবে কথা বলি? বলতে পারি না বলেই তো সংসার টিকে আছে এখনও।’

দুজন মানুষের মতের অমিল হলে বা বনিবনা না হলে বিয়েবিচ্ছেদের সুযোগ আছে। এ প্রসঙ্গে মিশু বলেন, ‘বাবা-মা, সমাজ সবকিছু মিলিয়ে বের হতে চাইলেও পারছি না। মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। প্রচণ্ড ভেঙে পড়ি। আবার মানিয়ে নিই। এভাবেই চলছে।’

রিয়ার (ছদ্মনাম) গল্পটা ভিন্ন। ভালোবেসে এক প্রকৌশলীকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। ভ্রমণপ্রিয় বরের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটছিল। তবে বিয়ের বছর না পেরোতেই রিয়া আবিষ্কার করেন তার বর যৌনতায় আগ্রহ হারাচ্ছেন। শারীরিক দূরত্ব ধাপে ধাপে বাড়াতে থাকে মানসিক দূরত্ব।

এর মধ্যেই রিয়া জড়ান নতুন সম্পর্কে। সেই সম্পর্ক তাকে কিছুটা হলেও ছন্দে ফেরায়। এর মধ্যেই আবিষ্কার করেন তার বরও ফিরতে শুরু করেছেন পুরোনো রূপে।

বাইরের অধ্যায়টি বন্ধ করে আবারও সংসারে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন রিয়া। সবকিছুই ছিল প্রাণবন্ত। রিয়া টের পেলেন, মা হতে যাচ্ছেন তিনি। তবে সন্তান পৃথিবীতে আসার পর আকস্মিকভাবে ডিভোর্সের খবর পেলেন তিনি। আকাশ ভেঙে পড়ে রিয়ার মাথায়।

ফিরে গেলেন বাবার বাড়িতে। সেখানে থেকে ‘সিঙ্গেল মাদার’ হিসেবে সন্তানকে বড় করার লড়াই করছেন রিয়া। এখন অবশ্য ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। একটি প্রতিষ্ঠানে ভালো চাকরি করছেন। নিজেকে আর বাবা-মার বোঝা বলেও মনে হচ্ছে না তার।

সম্পর্কের টানাপড়েন শুরুর কারণ হিসেবে রিয়া বলেন, ‘প্রেমের সময় দুজন মানুষ নিজের সর্বোচ্চ ভালো দিকটা একে অন্যের সামনে আনে। তবে কাছাকাছি থাকতে গেলে একে অপরের বাজে অভ্যাসগুলো বেরিয়ে আসে। ফলে তৈরি হয় পারস্পরিক অনীহা। সেগুলো ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। যোগ হতে থাকে আরও নানা কিছু।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে বিয়েবিচ্ছেদ বেড়েছে ১৭ শতাংশ।

২০২০ সালে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে ১২ হাজার ৫১৩টি ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৪৮১টি আবেদন করেছিলেন নারী, বাকি ৪ হাজার ৩২টি বিচ্ছেদ চেয়েছিলেন পুরুষ।

এসব আবেদনে পুরুষরা কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন স্ত্রীর সন্দেহপ্রবণতা, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, বদমেজাজ, সন্তান না হওয়ার মতো কারণ। বিপরীতে নারীরা দেখিয়েছেন বিয়েবহির্ভূত প্রেম, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, মাদকাসক্তির মতো বিষয়গুলোকে।

পরিবার ভেঙে পড়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অন্যতম কারণ গ্লোবালাইজেশন। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাইরের সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে অনেকখানি ঢুকে পড়েছে। এটার সঙ্গে এখন আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। এটার একটা এফেক্ট তো সমাজে পড়েছেই।’

বর্তমান সময়ে নারীদের মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে বলেও জানান এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘আগে বেশির ভাগ মেয়েই স্বামীর ওপর নির্ভরশীল থাকতেন, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। ফলে তারা অনেক কিছু মুখ বুজে সহ্য করতেন। এখন যেহেতু তারা সেলফ ডিপেনডেন্ট হয়ে গেছেন, তাই সবকিছু সেভাবে আর সহ্য করছেন না। অর্থাৎ সামাজিক যে ভ্যালুজের মধ্যে আমরা বড় হয়েছি, তার একটা পরির্বতন দেখা যাচ্ছে।’

পরিবারগুলো সহজেই ভেঙে যাওয়ার আর একটি কারণ হিসেবে নারী-পুরুষ দুজনেরই সহনশীলতার মাত্রা কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন তিনি।

মাহফুজা খানম বলেন, ‘টলারেন্স লেভেল কমে যাওয়ার কারণে একটুতেই কোনো কিছু মানতে না পারার প্রবণতা বেড়ে গেছে। অ্যাডজাস্টমেন্ট পাওয়ার এখন আমরা সেভাবে ব্যবহার করছি না।’

বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা এখনও পুরুষশাসিত বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, ‘এর মধ্য দিয়েই আমাদের ছেলেরা বড় হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু মেয়েদের রোলেও যে একটা পরির্বতন এসেছে তা আমরা (ছেলেরা) মানতে পারছি না বা মেনে নিচ্ছি না।

‘আর এখনকার সমাজব্যবস্থায় পরিবারগুলো ক্রমেই ছোট হয়ে গেছে। এতে বাবা-মা, ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই ইক্যুয়াল ট্রিটমেন্ট দিচ্ছে। এতে পরিবার থেকে সে সমান সুযোগ-সুবিধা পেয়ে তারা বড় হচ্ছে। কিন্তু বৈবাহিক জীবনে এসে সে যখন বিপরীত একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে, আর তখনই বিপত্তি ঘটছে।’

মুক্তবাজার অর্থনীতি বা পুঁজিবাদকে পরিবার ভাঙনের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম আনোয়ার হোসেন।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘একটা সংসারে নানা কিছুর প্রয়োজন হয়। বিশেষত ভোগবাদী পণ্য। এ পণ্য যতটা দরকার, সে অনুযায়ী মানুষের আয় বাড়েনি। টানাপড়েনের এইটা একটা বড় কারণ। ওয়েস্টার্ন মিডিয়া আসার পর মানুষের ভোগবাদী চিন্তাভাবনা বেড়েছে। ফলে আকাশ পর্যন্ত মানুষের প্রত্যাশা বেড়েছে। ফলে চাহিদা পূরণ না হলে টানাপড়েন শুরু হয়।’

স্বামী-স্ত্রীর ভেতরে সাংস্কৃতিক দূরত্বও সংসারজীবনে জটিলতা তৈরি করে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।

তিনি বলেন, ‘রান্নাবান্না করা, বাচ্চাদের লালনপালন, ঘরের প্রবীণ সদস্যদের দেখাশোনা, কাপড়চোপড় পরিষ্কার এগুলো পরিবার বা সংসারের বেসিক দায়িত্ব। যা পরিবারে অনেক ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি করে।’

যখন সংসারে নারী-পুরুষ দুজনেই কর্মজীবী হন, সে ক্ষেত্রে এসব ছোটখাটো বিষয়গুলো সমন্বয় নিয়েও নানা টানাপড়েন তৈরি হয় বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।

সমস্যা সমাধানে করণীয় সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানী মাহফুজা খানম বলেন, ‘সবকিছুর পেছনে পরিবারের একটা বড় ভূমিকা থাকে। পারিবারিক বন্ধন যে গুরুত্বপূর্ণ এ বোধ সবার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে হবে। ছেলেমেয়ে উভয়কেই পরিবারকেন্দ্রিক বন্ধনের গুরুত্বের বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে।’

সহনশীলতার মাত্রা বাড়ানোর ওপরও জোর দিলেন এই শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘ছেলেদের মধ্যে ডমিনেটিং সেন্স যেটা কাজ করে, সেটা কমিয়ে ইক্যুয়াল রিলেশেনশিপে আসার চেষ্টা করতে হবে। পরিবারে ছোটবেলা থেকে এ ধরনের শিক্ষা দিতে হবে।

‘এখনকার রিলেশনশিপের ডেপথনেস খুবই কম দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলায় দুজনকেই ধৈর্য ধারণ করতে হবে। হঠাৎ করেই কোনো সম্পর্কে আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হয় না। এ জন্য প্রয়োজন উভয়কে পর্যাপ্ত সময় দেয়া। এ বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’

সমাজে বড় ধরনের পরিবর্তন এলেও সেই পরিবর্তনের সঙ্গে যেসব সুযোগ সুবিধাগুলো তৈরি হওয়ার কথা ছিল, সেগুলো গড়ে ওঠেনি বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক এম আনোয়ার হোসেন।

তিনি বলেন, ‘গ্রামের সঙ্গে শহরের চিন্তাচেতনার পার্থক্য দূর করা সম্ভব হয়নি। বিষয়গুলো বৈষয়িক, গ্লোবালাইজ ফর্মের প্রবলেম বা ইস্যুজ। যেগুলো খুব সহজে সমাধান সম্ভব না। বাংলাদেশে ডে-কেয়ার ডেভেলপ করা, প্রবীণ নিবাস তৈরি করা, সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের যে সামঞ্জস্য সেগুলোকে সমন্বয় করতে হবে। এগুলো করতে পারলে ভাঙন অনেকটা কমে আসবে।’

এ বিভাগের আরো খবর