আড্ডা দিতে গিয়ে নির্ধারিত কোনো টেবিলে বসে যদি সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার ভয় থাকে, তাহলে কি সেই টেবিলে কেউ বসতে চাইবেন? নাকি এমন টেবিল রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ রাখবেন?
রাজশাহী শহরের একটি ফাস্টফুড শপ এদিক থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম এই কারণে যে, সেখানে একটি টেবিলের নাম রাখা হয়েছে ‘ব্রেকআপ টেবিল’। এই টেবিলে যেসব জুটি বসেছেন তাদের বেশির ভাগেরই নাকি প্রেম ভেঙে গেছে। আর এই গোপন কথাটা রেস্তোরাঁর মালিক ঘটা করে প্রচারও করছেন।
টেবিলের পাশে রীতিমতো ব্যানার টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে টেবিলের নাম। সেই সঙ্গে এখানে বসে কতজনের ব্রেকআপ হলো সেটাও উল্লেখ করা আছে। এই টেবিলের জন্য একটি আলাদা খাতা রাখা হয়েছে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর মন্তব্য লেখার জন্য।
রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষের হিসাবে এখানে বসে আড্ডা দেয়া অন্তত ১০০ জুটির প্রেমের সমাধি ঘটেছে। এমনকি রেস্টুরেন্ট মালিকের নিজের সংসারও নাকি নড়বড়ে হতে বসেছিল এই টেবিলে বসার পর।
রাজশাহী নগরের সাহেববাজার এলাকায় অবস্থিত ‘টেস্টি টাইমস’ ফাস্টফুড রেস্তোরাঁ। তিন তলার এই রেস্তোরাঁর সাত নম্বর টেবিলটাকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘বিপজ্জনক’ টেবিল হিসেবে।
রেস্টুরেন্টটি রাস্তার পাশে। কাচের সঙ্গে লাগনো এই টেবিলটি। এটি সেই রেস্তোরাঁর মাঝামাঝি অবস্থানে। টেবিলের পাশের ওয়ালে কাচে কাগজে প্রিন্ট করা ‘দ্য ব্রেকআপ টেবিল। ডেনজার।’
পাশে রাখা একটি খাতা। সেখানেই লিখতে বলা হয়েছে নিজেদের অনুভূতি। এ ছাড়া বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে এখানে ‘৮০ প্লাস জনের ব্রেকআপ হয়েছে।’
কত কষ্টের কথা লেখা সেখানে!
এখানে অনেকেই লিখছেন তাদের মন্তব্য। অনেকেই আবার লিখেছেন এই টেবিলের কারণেই তাদের সম্পর্ক আর নেই। আবার কেউ কেউ দাবি করছেন এখানেই তাদের সম্পর্ক জোড়া লাগে, আবার এখানেই তাদের সম্পর্ক শেষ হয়েছে। তবে অনেকে মজাও করেন বিষয়টি নিয়ে।
সেই নোটবুক উল্টে দেখা গেল কয়েকজনের মন্তব্য। কোনোটা মজার, কোনোটা কষ্টের।
একজন লিখেছেন ‘আন্টি জিতসেন, ভালো একটা ছেলে পাইসেন। আপনাদের জন্য সবই করে ফেলতে পারবে এই জীবনে। ওকে, টাটা বাই বাই খতম।’
অন্য আরেক পাতায় ‘কে’ আদ্যাক্ষরের নামের একজন লিখেছেন ‘আমার জীবনে কোনো লাভ নাই। আমার পুরো জীবনটাই লস।’
‘স’ আদ্যাক্ষরের একজন লিখেছেন ‘আমি জাস্ট চাই তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো। আই লাভ ইউ। তোমার অপেক্ষায় আছি।’
আ আদ্যাক্ষর নামের একজন লিখেছেন ‘সন্ধানে আছি। ব্রেকআপ তো দূরের কথা।’
নিজের নাম ‘ছেকা খাওয়া প্রেমিক’ উল্লেখ নামে একজন এই খাতায় লিখেছেন, ‘ব্রেকআপ খুব মজার, প্রেম করার শুরুতে ব্রেক-আপ টেবিলে বসেছিলাম। আর এখন ব্রেক-আপ হয়ে গেছে।’
আরেকজন লিখেছেন, ‘আমার দুই বছরের রিলেশনের অবসান ঘটে এখানে আসার কিছুদিন পরেই। আমার বার্থ ডে ট্রিট দিতে এসেছিলাম। এটাই লাস্ট দেখা। বর্তমানে ভালো থাকলেও এখানে আসলে ওইদিনটার কথা মনে পড়ে। স্টে হ্যাপি, স্টে সিঙ্গেল।’
মালিকের সম্পর্কও ভেস্তে যেতে বসেছিল
রেস্তোরাঁটির পরিচালকদের মধ্যে একজন শাওন সাইয়ান। তিনি জানান, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তারা রেস্টুরেন্টটি চালু করেন।
বলেন, ‘চালুর তিন দিনের মাথায় দেখলাম এই টেবিলে ঝগড়া করে দুইজন চলে গেল। এর কয়েক দিন পরের ঘটনা, একজন গেস্ট আসে সকালবেলায়। তখনও আমরা রেস্টুরেন্ট চালু করিনি। তাকে বলি এখনও চালু হয়নি, তিনি চলে গেলেন। এর কিছুক্ষণ পর আবার আসেন। এসে এই টেবিলেই বসে। সঙ্গে বান্ধবীও ছিল। কিছুক্ষণ পরই দেখি তাদের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর তারা চলেই গেল।
‘আরেকটি ঘটনা এই টেবিলেরই। একটা ছেলে ও একটা মেয়ে আসল, পুরো টেবিলটা ভর্তি করে খাবারের অর্ডার করে। দুইজন ভালোভাবেই বসে গল্প করছিল। হঠাৎ ছেলেটার মোবাইলে একটা কল আসে। এরপরই তাদের মাঝে ঝগড়া বেধে গেল। খাবার না খেয়েই বেরিয়ে চলে গেল।’
শাওন বলেন, ‘প্রায়ই আমরা দেখতাম এই টেবিলটাতে বিশেষ কিছু হচ্ছে। ঝগড়া থেকে মারামারি। প্রায়ই এখানে ব্রেক-আপের ঘটনা ঘটতে থাকে। এখানে অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই এসব ঘটে। এখানে বসলেই যেন ঝগড়া হতো।
‘এমনকি আমি নিজেও বিয়ের আগে এই টেবিলে একদিন খেতে বসে ঝামেলার মধ্যে পড়েছিলাম। হঠাৎই ঝগড়া লেগে গেল। এরপর অনেক কষ্টে আমি সেটি ম্যানেজ করি। এই ঘটনার পর থেকে আমি আর এই টেবিলে বসতে চাইতাম না। এখন পর্যন্ত বসতে চাই না।
‘এমন অনেকেই আছেন, যারা এখানে আর বসতে চান না। অনেক গেস্ট এসে বলেন, এই টেবিলে না, অন্য টেবিলে বসবে। আবার অনেকেই মনে করেন, বসে দেখি কী হয়। তারা এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন।’
শাওন বলেন, ‘এই টেবিলে অনেকের সম্পর্ক ভাঙছে। অনেকের আবার জোড়াও লেগেছে। টেবিলের একের পর এক ঘটনা দেখার পর ২০১৮ সালের নভেম্বরে আমরা সেখানে নোটিশ লাগিয়েছি। আমরা এই টেবিলের পাশে নোটবুক রাখি, অনেকেই সেখানে গল্প লিখছেন। নিজের ঘটনা লিখে যান।’
টেবিলটাকে ঘিরে নানা পরিকল্পনাও আছে রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষের। শাওন বলেন, ‘এই টেবিল ঘিরে আমরা আগামীতে বিশেষ অফার চালু করতে চাই। হতে পারে-এখানে বসে খেয়েও যদি গণ্ডগোল না হয়, তাদের জন্য বিশেষ ছাড় দেয়া হবে। এমন একটা ভাবনা আমরা ভাবছি। পাশাপাশি এই যে নোটবুকে যারা গল্প লিখে যাচ্ছেন, এগুলোকে আমর ম্যাগাজিন আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেব।’