২৩ বছর ধরে নিঃসঙ্গ আব্দুল আলিম (ছদ্মনাম)। জীবন-সংসার তার বৃদ্ধাশ্রমে বন্দি। দুই সন্তান আছে, কিন্তু তাদের কাছে জায়গা নেই। ঈদ বা কোনো উৎসব এলেই একাকিত্বটা আরও তীব্র হয়। তখন যেন অতীত কাতরতায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় চারপাশ।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রবীণ নিবাসে আলিমের মতোই থাকেন ৩০ জন।
তারা সারা জীবন সংসার, সন্তানদের জন্য করে গেছেন; কিন্তু শেষ জীবনে হয়েছেন সেই সংসারেরই বোঝা। একটু স্বস্তি, শান্তি খুঁজতে বৃদ্ধাশ্রমই কিছু মানুষের ভরসা।
এ যেন আরেক পরিবার। আপনজন কেউ নেই তার পরও সবাই আপন।
‘বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান’-এর পরিচালনায় এই প্রবীণ নিবাস। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এটি পরিচালিত হয়।
এই নিবাসে নারী-পুরুষের জন্য রয়েছে আলাদা থাকার ব্যবস্থা। এখানে মোট ৫০ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে ৩০ জন সেখানে আছেন। সবার বয়স ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে। তাদের দেখভাল করার জন্য রয়েছে প্রবীণ সংঘের পক্ষ থেকে ১০-১২ জন।
পরিবার-পরিজন থেকে দূরে থাকলেও এটি এখন তাদের আরেক পরিবার।
এই প্রবীণ নিবাসে ঈদের দিনটাও তাদের কাছে বিশেষ কোনো দিন মনে হয় না। বরং উৎসব এলেই তাদের বুকটা হাহাকার করে। সন্তানের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান তারা। আশা করেন সন্তান বা স্বজনরা এই দিনে অন্তত দেখতে আসবেন।
কারও কারও প্রতীক্ষার অবসান ঘটে। কেউ না কেউ দেখা করতে আসেন। আবার কেউ কেউ একাই কাটিয়ে দেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেও কেউ আসে না দেখতে। আবার কারও বছরের পর বছর দেখতে আসা তো দূরের কথা, স্বজনদের সঙ্গে ফোনালাপ পর্যন্ত হয় না।
সমাজে প্রতিষ্ঠিত সন্তানের মানহানি হয় সে জন্য গণমাধ্যমে কথা বলতে চাননি অনেক প্রবীণ সদস্য।
পরিবার ছাড়া কেমন কাটে ঈদের দিন জানতে চাইলে এই নিবাসের সুপারভাইজার নুরুন নাহার মিনা বলেন, ‘প্রায় সবারই আত্মীয়স্বজন ও সন্তান থাকলেও তারা আজ একা। কিন্তু এখানে সবাই প্রায় এক বয়সী হওয়ায় সময় ভালোই কেটে যায়। ঈদের দিন সকাল থেকে ফোনে অনেকে খোঁজ নেন। দুপুরে অনেকে দেখা করতে আসেন।’
কেউ ইচ্ছে করে এখানে থাকেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এক-দুজন আছেন যারা প্রবীণ না হয়েও এই নিবাসে এসেছেন। স্বামী চাকরি করতেন, অবসরের আগেই মারা গেছেন। তার পর থেকে একা। সন্তানরা অন্য দেশে থাকে। ফোনে বা ভিডিও কলে কথা বলেন তারা।’
নিবাসে একজনকে এক রুমে থাকা-খাওয়া বাবদ দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। আর ডাবল বেডের রুমে আট হাজার টাকা। এই খরচ প্রবীণ সদস্য বা তার পরিবারের সদস্যরা বহন করেন।
রুটিন অনুযায়ী নিবাসের পক্ষ থেকে প্রবীণদের খাবার দেয়া হয়। দিবস বা উৎসবে থাকে বিশেষ খাবারের আয়োজন। কেউ ইচ্ছে করলে রান্না করেও খাওয়ার সুযোগ আছে।
এ ছাড়া রয়েছে নামাজের জন্য আলাদা কক্ষ। পড়ার জন্য লাইব্রেরি। বসার কক্ষসহ টিভি দেখার ব্যবস্থা। জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে রয়েছে অ্যাম্বুলেন্স।
নিবাসের কেয়ারটেকার, নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদ বা বছরের যেকোনো দিনে প্রবীণরা চাইলে বাইরে যেতে পারেন। আবার কেউ কেউ রান্না করে খান। বাজার করার জন্যও বের হতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রার বুকে কিছু তথ্য লিখতে হয়।
নিবাসে ঈদের দিন সকালে থাকে মিষ্টান্নসহ বিভিন্ন খাবার। যাদের বাইরে গিয়ে নামাজ পড়ার সক্ষমতা আছে, তারা জামাতের সঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করতে পারেন।
কেউ অসুস্থ হলে কী করেন জানতে চাইলে কেয়ারটেকার আব্দুস সাত্তার জানান, অসুস্থ হলে প্রাথমিকভাবে বিনা মূল্যে প্রবীণ হাসপাতালে সেবা দেয়া হয়। যদি বাড়তি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে বাইরের হাসপাতালে নেয়া হয়। তখন পরিবারের সদস্যদের ফোনে জানানো হয়।