বান্দরবানের থানচিতে যখন পৌঁছাই, তখন সূর্য ঠিক মাথার ওপর। নভেম্বরের দুপুরের সূর্য খুব একটা মোলায়েম ছিল না। থানা-পুলিশ ঘুরে যখন নৌকার ঘাটে আসি, আমার বিব্রত হওয়ার পালা শুরু। আমার ছয় ফুট লম্বা আর শত কেজি পেরনো দেহখানি দেখে দুই নৌকাওয়ালার দুজনাই আমাকে তুলতে গাঁইগুঁই শুরু করে দিল। কী এক বেইজ্জতি! শেষে তুলনামূলক নতুন নৌকায় ঠাঁই পেলাম।
তখনও কি জানতাম, ভোগান্তির সবে শুরু? থানচি থেকে রেমাক্রির তিন ঘণ্টার যাত্রায় অন্তত তিনবার নৌকা থেকে নামতে হলো আমাকে। নৌকার তলা আটকে যায় নিচের পাথরে। একবার নামো, তারপর কিছু দূর হাঁটো, তারপর আবার নৌকায় ওঠো, আবার নামো, আবার ওঠো। এইভাবে ওঠানামা করতে করতে যখন রেমাক্রি বাজারের ঘাটে এসে থামলাম, নৌকার মাঝি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
রেমাক্রিতে এক রাত কাটিয়ে পরদিন শুরু হলো আমাদের আসল পরীক্ষা। রেমাক্রি থেকে নাফাখুম যাত্রা।
আধা ঘণ্টার মতো নৌকায় করে গিয়ে শুরু করলাম হাঁটা। সেই আধা ঘণ্টার নৌযাত্রায় কয়বার নামতে হয়েছে, সেটা এখানে আর নাইবা বলি।
দেড় ঘণ্টার হাঁটাপথ যেন আর শেষ হয় না। দলের সবাই আগে চলে যায়, আর আমি হাঁপাতে হাঁপাতে পথ চলি। ফিরতি পথে আসা পর্যটকরা আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলে, আঙ্কেল, আপনাকে দেখে উৎসাহ পেলাম।
এভাবেই হাঁটি হাঁটি পা পা করতে করতে একসময় পৌঁছে গেলাম নাফাখুম। পৌঁছে তো গেলাম, কিন্তু ফিরব কীভাবে? আবার এই দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হবে?
আমি রাতে নাফাখুম ঝরনার পাশে বসে বসে ভাবি, এই বয়সে এমন শরীর নিয়ে এমন দুর্গম জায়গায় কেন এলাম?
কোথাও ঘুরতে যাওয়ার আগে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো জায়গা নির্বাচন করা। সেখানে কীভাবে যাবেন, সেটা জেনে নেয়া, যাত্রাপথের দুর্গমতা সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নেয়া। নিজের বয়স আর শারীরিক সক্ষমতাকে বিবেচনায় নেবেন। দেশ-বিদেশে হাজারও ট্যুরিস্ট স্পট আছে, সব জায়গা আপনার আমার জন্য না। আর যদি যেতেই হয়, তাহলে নিজেকে সেভাবে তৈরি করুন।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ঘুরতে যাওয়ার বাজেট। আজ থেকে ১৫-১৬ বছর আগে একটা আর্টিকেলে লিখেছিলাম, প্রতিদিন ১০ টাকা করে জমালে বছর শেষে দেশের যেকোনো স্থানে দুই দিন ঘুরে আসা যায়। আজ আর সেই কথা খাটবে না। আজকাল সেই টাকার পুরোটাই চলে যাবে যাওয়া-আসার ভাড়ায়। তো কী আর করা, জমানোর পরিমাণ বাড়ান।
আবারও একই কথা বলি, দুনিয়ার সব জায়গায় আমার যেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমার বাজেটের মধ্যে যেখানে যেতে পারি, সেখানেই যাব। আপনি যেমন নায়াগ্রা ফলস না দেখে মারা যাবেন, ঠিক তেমনি বিল গেটসও নাফাখুম ঝরনা না দেখে মারা যাবেন। সো, বাজেট কম বলে মন খারাপ করা যাবে না। ঠিক আছে?
এবার আসুন সঙ্গী নির্বাচনে। আমার তিন কলিগ একবার তাদের ১৪ জনের বহর নিয়ে ইন্ডিয়া গেল ঘুরতে। প্ল্যান ছিল কলকাতা থেকে দিল্লি, জয়পুর, আজমির আর আগ্রার তাজমহল দেখে দেশে ফিরবে।
ঢাকা থেকে তো ঠিকঠাক গেল, কিন্তু বিপত্তি বাধল কলকাতা গিয়ে। কোনো হোটেলে ১৪ জন থাকার মতো এতগুলো রুম দিতে পারছে না। কী আর করা, দুই হোটেলে ভাগ হয়েই থাকতে হলো তাদের।
এরপর শুরু হলো আসল ঝামেলা। ৩-৪ দিন ঘুরেও একসঙ্গে ১৪টা ট্রেনের টিকিট জোগাড় করতে পারল না। প্লেনেও একই অবস্থা। শেষে পুরো ১০ দিন কলকাতার নিউমার্কেটে ঘুরে ঘুরে শাড়ি, কাপড়, জুতা কিনে দেশে ফিরে এলো।
কী বুঝলেন? দেশের বাইরে যাওয়ার সময় হয় আগে থেকে বাস, ট্রেন বা প্লেনের টিকিট কেটে যাবেন অথবা ছোট গ্রুপ নিয়ে যাবেন।
ভাবছেন ছোট গ্রুপ নিয়ে গেলেই সব ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে? উহু, তা হবে না। আমি একবার এক কলিগকে নিয়ে ইন্ডিয়ার হিমাচল প্রদেশে গিয়েছিলাম ঘুরতে। তখন কি আর জানতাম যে আমার কলিগ ক্রনিক কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছে? সকালে যখন আমি রেডি হয়ে বসে থাকি তখনও সে টয়লেটে। আমি যখন দুর্দান্ত একটা সূর্যাস্ত দেখে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন লাগল? তখন সে তার পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, নাহ, আজকেও হইল না।
পরিশেষে বলব, পরিবারের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন। আপনার সন্তানকে নিয়ে ঘুরতে যান। তাকে দেশ-বিদেশ দেখান। তাদের চিন্তার বিকাশে ভ্রমণের কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখবেন, আজকে যদি আপনি আপনার সন্তানকে দেশ-বিদেশ ঘুরে দেখান, একসময় আপনার সন্তান আপনাকে দেখাবে।