ঈদের জামাতের ক্ষেত্রে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার বিশাল জমায়েত যে দেশের সবচেয়ে বড়, এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না কখনও। তবে কয়েক বছর ধরে দিনাজপুরের গোর-এ শহীদ বড় ময়দানে ২০১৭ সাল থেকে জামাতের আয়োজন করার পর থেকে প্রশ্নটা উঠতে শুরু করে, কোন মাঠে জমায়েতটি সবচেয়ে বড়।
২০১৯ সালে দিনাজপুরের ঈদ জামাত আয়োজনের দায়িত্বে থাকা কমিটি দাবি করে, সে বছর সবচেয়ে বড় জমায়েত হয়েছে গোর-এ শহীদে। এবার সেখানে ছয় লাখ মানুষ নামাজ পড়বে বলে আশা করছেন তারা।
তবে শোলাকিয়ার জামাতসংশ্লিষ্টরা এখনও সবচেয়ে বড় জামাতের দাবি ছাড়ছেন না। তারা বলছেন, শোলাকিয়ার জামাত কেবল বিশাল ময়দানে নয়, ময়দান ছাড়িয়ে আশপাশের কয়েক কিলোমিটার সড়ক এবং ফাঁকা জায়গা, স্কুলের মাঠেও ছড়িয়ে যায়। সব মিলিয়ে গোর-এ শহীদের চেয়ে বেশি মানুষ থাকে এখানে।
শোলাকিয়া ময়দানের নামকরণ হয়েছে ব্রিটিশ আমলে এখন থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে ঈদ জামাতকে কেন্দ্র করে। বলা হয়, ওই বছর জামাতে সোয়া লাখ মানুষের জমায়েত হয়েছিল। সেই বিষয়টি ছড়িয়ে যাওয়ার পর বছর বছর মুসল্লির সংখ্যা আরও বেড়েছে। এই জামাতকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ রেলওয়ে বিশেষ ট্রেনের আয়োজনও করে। আর এমনকি ঈদের আগে থেকেও উত্তরবঙ্গ থেকে মানুষ এসে তাঁবু খাটিয়ে ময়দানে অবস্থান করতে দেখা গেছে। পরিচিত, স্বজনদের বাড়িতেও জামাতকে কেন্দ্র করে অতিথি আসার ঘটনাও এক নিয়মিত চিত্র ছিল।
কিশোরগঞ্জ শহর থেকে পূর্ব দিকে কিলোমিটার দুয়েক দূরে এই শোলাকিয়া ময়দানের অবস্থান। সেখানে বিশাল ময়দান ছাড়াও পাশে ফাঁকা জায়গা, যা গরুর হাট হিসেবে ব্যবহার হয় সেটি ও পাশে একটি স্কুলের বিশাল মাঠ এবং কিলোমিটার দুয়েক সড়কেও হয় এই জামাত।
১৯৫তম ঈদের জামাতের জন্য এবার সেখানে চলছে প্রস্তুতি। বিশাল এই জামাত মূলত হয় ঈদুল ফিতরে। ঈদুল আজহার জমায়েত হয় তুলনামূলক অনেক ছোট।
করোনার জন্য দুই বছর বন্ধ থাকার পর এবার জামাতে আরও বেশি জমায়েতের আশা করছে ঈদগাহ কমিটি।
তবে এই ময়দানের জামাতকে টেক্কা দিতে ২০১৭ সাল থেকে দিনাজপুরে শুরু হয় চেষ্টা। তৈরি করা হয় বড় একটি মিনার। সেবারই হয় বড় আকারের প্রথম জামাত। এর আগের বছরগুলোয় জামাত হলেও সেগুলো হতো ছোট আকারের।
শহরে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের পাশে এ ময়দানটি সেনাবাহিনীর। তবে এখানে সাধারণ জনগণ খেলাধুলার পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক বা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচি পালন করতে পারে।
আর ২০১৯ সালে এসে ছয় লাখ মানুষের জমায়েত করার ঘোষণা দিয়ে চলতে থাকে প্রস্তুতি। সে বছর জামাত শেষে বলা হয়, তারা যত মানুষকে জড়ো করবেন ভেবেছিলেন, মুসল্লি এসেছে তার চেয়ে বেশি। ফলে এটিই দেশের বৃহত্তম জামাত।
এরপর ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার কারণে ময়দানে জামাতে ছিল নিষেধাজ্ঞা। ভাইরাসটির তৃতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসার পর চলতি বছর আবার দেশের বৃহত্তম জামাত আয়োজনের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে প্রচার চলছে।
শোলাকিয়া ময়দানের ধারণক্ষমতা কতশোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুস সালাম গোলাপ নিউজবাংলাকে বলেন, ময়দানে ২৬৫টি সারি হয়। প্রতিটি সারিতে প্রায় ৫০০ করে মুসল্লি দাঁড়াতে পারেন। সব মিলিয়ে শুধু মাঠের ভেতরেই প্রায় ১ লাখ ৩২ হাজার ৫০০ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।
তিনি বলেন, ‘এ ছাড়া মাঠের আশপাশের বিভিন্ন খালি জায়গায় মুসল্লিরা নামাজ আদায় করেন। মাঠের সমপরিমাণ মুসল্লি নামাজ আদায় করেন মাঠের পাশের সড়ক ও খোলা জায়গায়।
‘মাঠের পাশ দিয়ে যে রাস্তা রয়েছে, সে রাস্তায়ও প্রায় এক থেকে দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত জামাত ছড়িয়ে যায়। সব মিলিয়ে এই ময়দানে প্রায় তিন লাখ মুসল্লি নামাজ আদায় করে থাকেন।’
শোলাকিয়ায় ঈদ জামাত। ফাইল ছবি
দুই বছর করোনার কারণে জামাত না হওয়ায় এবার মুসল্লিদের আগ্রহ আরও বেশি থাকবে বলেও মনে করেন তিনি। ধারণা করছেন, এবার মুসুল্লির পরিমাণ বেড়ে চার লাখ হতে পারে।
সাংবাদিক সাইফউদ্দীন আহমেদ লেনিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঈদগাহ মাঠ ছাড়াও আশপাশের বাড়িঘর, ফাঁকা জায়গা এবং মাঠের পাশের সড়কেও প্রায় দেড় থেকে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত ঈদের জামাত ছড়িয়ে যায়। আকাশের অবস্থা ভালো থাকলে এবার মুসল্লির সংখ্যা আরও বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পাই অনেক জায়গায় নতুন নতুন ঈদগাহ গড়ে উঠেছে, সেখানে শোলাকিয়া ঈদগাহের সঙ্গে তুলনা করার জন্য বা শোলাকিয়া ঈদগাহকে পেছনে ফেলার জন্য প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিভিন্ন উপজেলায় বাস পাঠিয়ে লোকজন জড়ো করে থাকেন। কিন্তু শোলাকিয়ার ক্ষেত্রে এমনটা হয় না।
‘এখানে মুসল্লিরা নিজেদের আগ্রহ থেকেই আসেন। ঈদের দু-তিন আগে থেকেই অনেক দূরদূরান্ত থেকে মুসল্লিরা আসেন। তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও ঈদগাহ কমিটি করে থাকে।’
ঢাকা গুলশান-২ থেকে মাঠে ঘুরতে এসেছেন সুমন মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের গল্প শুনে আসছি। বিভিন্ন টেলিভিশনেও এই মাঠের জামাত দেখেছি। কিন্তু বাস্তবে দেখার সুযোগ হয়নি। এবার এই মাঠে জামাত আদায় করার নিয়ত করেছি। তাই ভাবলাম ঈদের আগে একবার মাঠটি দেখে আসি।’
ঢাকার ভাটারা থেকে মাঠ দেখতে এসেছেন মেহেদী হাসান। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন বন্ধুকে। ঈদের আগে ফাঁকা মাঠটি দেখতে এসেছেন তারা।
গোর-এ শহীদে কত মানুষ ধরতে পারে?
দিনাজপুরের এ ময়দানটি আনুমানিক ২২ একর জমিতে। এবার মূল মাঠে দুই শতাধিক কাতার হবে বলে জানিয়েছে আয়োজক কমিটি। প্রতিটি কাতারে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। এই হিসাবে ময়দানে ২ লাখ ৪০ হাজার থেকে ২ লাখ ৬০ হাজার মানুষ ধরে।
এই ময়দানে জামাতের উদ্যোক্তাদের একজন স্থানীয় সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বড় ময়দানের পাশে আরেকটি মাঠ রয়েছে। সেই মাঠেও মুসল্লিরা নামাজ আদায় করবেন। মাঠ দুটি ভর্তি হয়ে গেলে রাস্তায়ও নামাজ পড়তে পারবেন মুসল্লিরা। আমরা আশা করছি, এই জামাতে গোটা দেশের প্রায় লক্ষাধিক মুসল্লি শরিক হবে।’
দিনাজপুর গোর-এ শহীদ বড় ময়দানে ঈদের জামাত। ফাইল ছবি
২০১৭ সালে সেখানে ঈদগাহ মিনারের নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। ৫২ গম্বুজের ঈদগাহ মিনার তৈরিতে খরচ হয়েছে ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এই গম্বুজের দুই ধারে ৬০ ফুট করে দুটি মিনার, মাঝের দুটি মিনার ৫০ ফুট করে। ঈদগাহ মাঠের মিনারের প্রথম গম্বুজ অর্থাৎ মেহেরাব (যেখানে ইমাম দাঁড়াবেন) তার উচ্চতা ৪৭ ফিট। এর সঙ্গে রয়েছে আরও ৪৯টি গম্বুজ। এ ছাড়া ৫১৬ ফুট লম্বায় ৩২টি আর্চ নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রতিটি গম্বুজ ও মিনারে রয়েছে বৈদ্যুতিক লাইটিং। রাত হলে ঈদগাহ মিনার আলোকিত হয়ে ওঠে।
দুই ময়দানই প্রস্তুত
শোলাকিয়া ও আশপাশে মাঠ প্রস্তুতের কাজ প্রায় শেষ। কিশোরগঞ্জ পৌরসভার কনজারভেন্সি ইন্সপেক্টর আশরাফুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ১০ রমজান থেকেই এই মাঠ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করছি। প্রতিদিন ৫০ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী এখানে কাজ করেছেন। কেউ দাগ কেটেছেন, কেউ দেয়াল ঘষামাজার কাজ করেছেন। কেউ ময়লা অপসারণ করেছেন, কেউ করেছেন রঙের কাজ। মাঠের সব কাজ শেষ হয়েছে।’
ঈদ জামাতের জন্য প্রস্তুত শোলাকিয়া মাঠ। ছবি: নিউজবাংলা
শ্রমিকদের তত্ত্বাবধায়ক হোসেন আলী বলেন, শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ পরিষ্কারের কাজ করছি। অনেক দূর থেকে মুসল্লিরা এখানে নামাজ পড়তে আসেন। তারা এসে যেন মাঠটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখেন, এ জন্য আমরা কাজ করেছি।’
শ্রমিক কাঞ্চন মিয়া বলেন, ‘এই মাঠে নামাজ পড়তে আসেন তারা নিজেদের জন্যও দোয়া করেন, পাশাপাশি আমাদের জন্যও দোয়া করেন। তাই মাঠে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে আমাদের ভালো লাগে।’
গোর-এ শহীদও প্রস্তুত পুরোপুরি
সকাল ৯টায় এই জামাতের জন্য এরই মধ্যে মাঠের গর্তগুলো বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। মাঠ সমান করার জন্য চালানো হচ্ছে রোলার।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণের কাজও প্রায় শেষ। মাঠের দক্ষিণ অংশে নামাজ পড়ার জন্য আগত মুসল্লিদের যানবাহন রাখার স্থান তৈরি করা হচ্ছে। মাঠে মুসল্লিদের প্রবেশের জন্য তৈরি করা হচ্ছে তোরণ। মুসল্লিদের অজুখানা ও ভ্রাম্যমাণ টয়লেটের কাজ শেষের দিকে। নামাজের দাঁড়ানোর জন্য কাতারের লাইনের দাগও টানার কাজ চলছে। মাইক বসানোর কাজও চলছে।
বিশাল আয়োজনে নিরাপত্তায় কড়াকড়ি
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালেদ নিউজবাংলাকে জানান, শোলাকিয়ায় মানুষ ঢুকবে ২৮টি প্রবেশপথে। হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে নিরাপত্তাকর্মীরা মুসল্লিদের দেহ তল্লাশি করে ঢোকার ব্যবস্থা করবেন।
ঈদগাহ ময়দানে প্রবেশ করতে হলে একজন মুসল্লিকে পুলিশের চারটি চেকপোস্ট বা পার হয়ে আসতে হবে। আর ময়দানের ভেতরে ছয়টি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। তার মধ্যে দুটি ব্যবহার করবে র্যাব আর চারটি ব্যবহার করবে পুলিশ।
চারটি ড্রোন ক্যামেরাসহ ছয়টি ভিডিও ক্যামেরা থাকবে। মাঠে প্রবেশ ও বাহিরের পথ নামাজের আগের দিন জানিয়ে দেয়া হবে।
তিনি জানান, মাঠে ফায়ার সার্ভিস, ছয়টি অ্যাম্বুলেন্সসহ মেডিক্যাল টিম, পুলিশের কুইক রেসপন্স টিম থাকবে। পুরো ময়দান সুইপ করা হবে। বোমা শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয়করণের একটি দল ঢাকা থেকে শোলাকিয়া মাঠে মেটাল ডিটেক্টরের সাহায্যে বিশেষ অনুসন্ধান চালাবে। মাঠের নিরাপত্তার জন্য পাঁচ প্লাটুন বিজিবি চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা কাজ করবেন। সাদা পোশাকে পুলিশ কাজ করবে।
ঈদগাহ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম নিউজবাংলাকে বলেন, প্রত্যেককে নামাজের বিছানা এবং মাস্ক পরে মাঠে প্রবেশ করতে হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে মোবাইলটিও রেখে আসতে হবে।
গোর-এ শহীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে দিনাজপুর পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মাঠকে ঘিরে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিটি মুসল্লিকে তল্লাশি করে মাঠে প্রবেশ করতে দেয়া হবে। এ জন্য মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে মাঠে থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
‘পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, এনএসআই, ডিজিএফআই , ডিএসবিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা মোতায়েন থাকবেন। মাঠের আইনশৃঙ্খলা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে ওয়াচ টাওয়ার থেকে। শহরের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো সার্বক্ষণিক মনিটর করা হবে। শহরের প্রবেশের সব পথেও তল্লাশি চৌকি স্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’