খুশির ঈদ চলেই এলো। ঈদের আয়োজনে কারও যেন কমতি নেই। এ সময় সবার বাড়িতেই খাওয়াদাওয়ার বিশাল আয়োজন থাকে। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে একটু বেশি যাওয়া হয়ে ওঠে এই সময়টায়। বন্ধুবান্ধবরাও অনেকটা জোর করে বসেন। আর এই আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো খাবার। বেড়াতে গেলেও খাবার-দাবারের এলাহি কাণ্ড থাকে। আর ঈদের খাবারের সঙ্গে মূল আয়োজনে থাকে বিভিন্ন রকমের মাংস বা প্রাণিজ আমিষ। তবে এক মাস রোজা রাখার পর হুট করেই এ ধরনের খাবারে নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। ঈদের সময় খাবারদাবারের ভুল থেকে স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হলে পুরো আনন্দটাই মাটি হতে পারে। তা ছাড়া এখন গরমকাল। এই গরমের কথা মাথায় রেখেও খাবারদাবার নির্বাচন করতে হবে।
-
কী খাবেন, কী খাবেন না?
যাদের কোনো শারীরিক সমস্যা নেই, হজমেও সমস্যা নেই কিংবা তরুণ তারা সবই খেতে পারবেন। তবে মনে রাখবেন খাওয়াটা যেন অতিরিক্ত না হয়। চর্বিজাতীয় খাবার থেকে দূরে থাকা ভালো। অনেক সময় দেখা যায় বেশি পরিমাণে মাংস, বিরিয়ারি খাওয়ার ফলে পেট ফাঁপা থাকে কিংবা বুক জ্বালাপোড়াও করতে পারে। ঈদের দিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে যাতে কোষ্ঠকাঠিন্য না হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসিডেন্ট চিকিৎসক ডা. আবীর হাসান বলেন, ‘এক মাস রোজা রাখার পরে ঈদের সময় হঠাৎ করে বেশি মাংস খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত চর্বি ও আমিষজাতীয় খাবারের পরে বুকে জ্বালাপোড়াও হতে পারে। যাদের পাইলসজাতীয় রোগ আছে, তারা কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যায় সাবধান থাকুন। প্রচুর পরিমাণে পানি, শরবত, ফলের রস, ইসবগুলের ভুসি ও অন্যান্য তরল খাবার বেশি করে খাবেন। বুকের জ্বালাপোড়ার জন্য ওমিপ্রাজল বা পেন্টোপ্রাজলজাতীয় প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর খেতে পারেন। বমি বমি ভাব হলে ডমপিরিডন খাবেন। যাদের হার্টের সমস্যা ও কিডনিতে সমস্যা আছে তারা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করুন। কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রোটিন খাবার যতটা পারেন এড়িয়ে চলুন।’
-
কেমন হবে ঈদকালীন ডায়েট চার্ট
সকালে কী খাবেন?
এক মাস রোজা রাখার ফলে ঈদের দিন সকালে অনেক কিছু খেতে মন চাইবে। তবে মনের সেই গোঁ ধরে বসে থাকলে হবে না। সকালের নাশতার মেন্যুটা যাতে হালকা খাবারের হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। নরওয়েতে কর্মরত গ্লোবাল হেলথ বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদ আশিক মাহমুদ বলেন, ‘সকালের নাশতাটা শুরু করতে পারেন ফলের রস দিয়ে। তাই বলে বাজারে পাওয়া যায় এমন ফ্রুট জুস দিয়ে নয়। ঈদের দিন সকালে অনেকেই দেখি কোমল পানীয় খান। এগুলো থেকে বিরত থাকুন। বাজারে প্রচলিত ফ্রুট জুসের বেশির ভাগই আসল ফলের রস দিয়ে তৈরি নয়। এ ছাড়া কোনো কোনোটিতে কৃত্রিম রংও মেশানো থাকে। তাই এসব পানীয় থেকে দূরে থাকুন। এগুলো লিভার ও কিডনি উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। ঈদের দিন সকালে ফলমূল, ডাবের পানি খেতে পারেন। নামাজে যাওয়ার আগে দুধের তৈরি পায়েস কিংবা অল্প পরিমাণে সেমাই খেতে পারেন। অনেকে একটু বোরহানি খেতে চান, সেটাতেও না নেই।’
-
দুপুর ও রাতে
তরুণরা নিজের পছন্দমতো খাবার খেতে পারবেন। তবে মনে রাখবেন অতিরিক্ত খেয়ে ফেললে মুশকিল। চর্বি সব সময়ই পরিহারযোগ্য। ঈদের দিন পোলাও-মাংস কিংবা বোরহানি খাবেন সেটাই স্বাভাবিক। তবে কিছুটা সতর্ক থাকুন। খাবারের মাঝে পানি পান করবেন না। হজমে সমস্যা হতে পারে। আপনি চাইলে খাবারের মাঝে বোরহানি খেতে পারেন। দুপুরের খাবারের তালিকায় মাছ, মাংস, শাকসবজি রাখতে পারেন। এ ছাড়া সবুজ সালাদ ও টক দই রাখতে পারেন। খাবারের অনেক আইটেমের পরিবর্তে দুই-তিনটি আইটেম ভালোভাবে রান্না করলে পুষ্টি, ক্যালরি, স্বাদ সবই পাওয়া সম্ভব। খাবারে সফট্ ড্রিংকস পরিহার করতে পারলে ভালো। বয়স্কদের একটু বুঝেশুনে খেতে হবে। আমিষ খেতে ইচ্ছে করলেও অল্প পরিমাণে খাবেন। চর্বিযুক্ত ও মসলাযুক্ত খাবারে হাতই দেবেন না। রাতের খাবার হালকা হলে ভালো। যারা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান রাতের খাবারে সাদা ভাত পরিহার করে রুটি ও সবজি খেতে পারেন। তরুণরা রাতের খাবারের ভিন্নধর্মী স্বাদ পেতে বাসায় চায়নিজ খাবার রান্না করেও খেতে পারেন। এগুলোতে তেল ও মসলা উভয়ই কম থাকে। ঘুমানোর কমপক্ষে দুই ঘণ্টা আগে খাবার খেতে হবে।
-
ডায়াবেটিস রোগীর জন্য পরামর্শ
যেহেতু ডায়াবেটিস রোগীদের সুগারের সমস্যা আছে, তাই ভাজাপোড়া খাবারও নিয়ন্ত্রণে রেখে খেতে হবে। ঈদের দিন বিভিন্ন ধরনের তেলে ভাজা কাবাব, চিকেন ফ্রাই, চপ এগুলো খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। চিনিযুক্ত শরবতের পরিবর্তে প্রাকৃতিক ফলের রস যেমন : বেল, তরমুজ, পাকা আম, পাকা পেঁপে বা মাল্টার রস পরিমাণে অল্প করে চিনি ছাড়া খাওয়া যেতে পারে। দুপুর বা রাতের খাবারের মেন্যুতে মাছ বা মুরগির মাংস রাখা যাবে। গরুর মাংস খুব বেশি খাওয়া উচিত না। আঁশযুক্ত খাবার বেশি খেতে হবে। খাবারে ফাইবার বাড়াতে মটরশুঁটি, শিম, আপেল, ব্রকলি, গাজর, খেজুর রাখতে পারেন। ডায়াবেটিস রোগীরা চাইলে আবার সাধারণ চালের পরিবর্তে লাল চাল, লাল আটা খেতে পারেন। অন্যদের মতো খাবারের তালিকা লম্বা করে ঈদের আনন্দটা যাতে মাটি না হয় সেদিকে আপনাদের সতর্ক হতে হবে।
-
বয়স্কদের বাড়তি যত্ন নিন
বয়স একটু বেড়ে গেলে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো আগের মতো কর্মক্ষম থাকে না। হার্টের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ নানা ধরনের রোগে বাসা বাঁধে। ফলে তাদের খাবারদাবারের ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হয়। অতিরিক্ত খাবার খেয়ে ফেললে পেট ফাঁপা বা অস্বস্তি অনুভব হতে পারে। এ ছাড়া বুক জ্বালাপোড়া তো থাকছে। খাবারে যাতে অতিরিক্ত তেল ব্যবহার না করা হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। খাবারে ঘিয়ের ব্যবহারও কমিয়ে দিতে হবে।
-
বেশি বেশি ফলমূল খান
টাককা সবজি খেলে পাকস্থলী ভালো থাকে। যেহেতু এখন গরমকাল তাই বেশি বেশি ফলমূল খেতে পারেন। ফলের রস আপনার শরীরকে ডিহাইড্রেট হওয়া থেকে রক্ষা করবে। বাজারে প্রচলিত কোমল পানীয় খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। প্রয়োজনে রসাল ফল যেমন তরমুজ, বেল বা লেবু দিয়ে শরবত বানিয়ে খেতে পারেন।
-
আরও কিছু টোটকা
১। ঈদের দিন কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিলে আমিষজাতীয় খাবার বন্ধ রাখুন। ইসবগুল পানিতে ভিজিয়ে রেখে পান করুন।
২। খালি পেটে টকজাতীয় কিছু খাবেন না। এমনকি আচার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৩। খাবারের স্বাদ বাড়ানোর জন্য টেস্টিং সল্ট, ফুড কালার, সস, পানীয় ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
৪। অতিরিক্ত মসলা ও চর্বি বর্জন করুন। বেশি বেশি পানি পান করুন।
৫। শরীরকে বেশি বেশি হাইড্রেট রাখুন। প্রখর রোদ এড়িয়ে চলুন। রাতে খাওয়ার পর কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করুন।
৬। আলো-বাতাসে হাঁটাচলা করুন। এতে মন ও শরীর উভয়ই ভালো থাকবে।