প্রতি বছর সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে কিছু গ্রামে কয়েক হাজার মানুষের রোজা ও ঈদ করার বিতর্কে এবার যোগ হয়েছে নতুন দিক। এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে এবার আফগানিস্তানে রোববার ঈদ উদযাপন হয়েছে, যখন গোটা মুসলিম বিশ্বে আরও একটি বা দুটি রোজা পালন বাকি।
গত ২ এপ্রিল আফগানিস্তানে যেদিন থেকে রোজা শুরু হয়, সেদিন রোজা শুরু হয় আরবেও। ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপালে রোজা শুরু হয় পরের দিন ৩ এপ্রিল।
সৌদি আরবের চাঁদ দেখা কমিটি শনিবার ঘোষণা করে, শাওয়ালের চাঁদ দেখা যায়নি। ফলে তারা ৩০টি রোজা শেষে ঈদ উদযাপন করবে সোমবার।
বাংলাদেশে রোজা ও ঈদ উদযাপন হয় সৌদি আরবের পর দিন। কারণ এখানে সাধারণত চাঁদ দেখা যায় আরবের এক দিন পর।
তবে দেশের বিভিন্ন দরগাহ শরিফের অনুসারীরা সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে সেখানে চাঁদ দেখা গেলে পরদিন থেকে রোজার ঈদ করে থাকেন। এ নিয়ে বিতর্কও কম নয়। এক পক্ষ বলছে, চাঁদ একটি জায়গায় দেখা গেলেই চলে; আরেক পক্ষ বলছে, নিজ নিজ ভূখণ্ডে চাঁদ দেখতে হবে- এটাই ধর্মের বিধান।
এ অবস্থায় রোববার দেশবাসী যখন ২৯টি রোজা পালন করছে, তখন চাঁদপুর, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন এলাকার দরগাহ শরিফে ঈদের জামাত হচ্ছিল। তারা আফগানিস্তানের সঙ্গে মিল রেখে ঈদ উদযাপন করছেন।
স্বভাবতই বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তুলেছে।
গত ১৫ আগস্ট কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়া কট্টরপন্থি তালেবান সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, দেশটির চারটি প্রদেশের ২৭ জন চাঁদ দেখতে পেয়েছেন। এরপর তারা রোববার ঈদ উদযাপনের ঘোষণা দেয়।
তবে শনিবার সৌদি আরবে চাঁদ দেখা না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় সে দেশের সরকার। সেখানে ৩০টি রোজা হবে, আর ঈদ উদযাপন হবে সোমবার।
বাংলাদেশে কবে ঈদ হবে তা নির্ধারণ করতে সন্ধ্যায় বসছে জাতীয় ঈদ দেখা কমিটি।
রাজধানীর জামিয়া ইকরা বাংলাদেশের শিক্ষক মুফতি ফয়জুল্লাহ আমানের মতে, প্রত্যেক এলাকা বা অঞ্চলে আলাদাভাবে চাঁদ দেখেই ঈদ বা রোজা পালন করতে হবে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চাঁদ দেখার বিষয়ে ইসলামে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। ওলামা একরামদের মত হচ্ছে এই, প্রত্যেক দেশে এবং প্রত্যেক অঞ্চলেই চাঁদ দেখতে হবে।
‘যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে তাহলে একজন বা দুজন দেখা যথেষ্ট নয়, একটি বিরাট জনগোষ্ঠী বা প্রত্যেক মহল্লা বা প্রত্যেক মসজিদ থেকে কমপক্ষে একজন দেখতে হবে। এভাবে যদি বিরাটসংখ্যক মানুষ দেখে তাহলে সেটা যথেষ্ট হবে।
‘আর যদি আকাশ পরিষ্কার না থাকে তাহরে দুজন সাক্ষী লাগবে। যদি কোনো এক এলাকায় আকাশ পরিষ্কার থাকে আর অন্য এলাকায় মেঘলা থাকে, তাহলে এক এলাকায় দেখা অন্য এলাকার জন্যও যথেষ্ট হবে।
‘যদি দূরবর্তী অঞ্চল হয়, যেমন যদি আমাদের দেশে দেখা যায় সেটা দিয়ে আমেরিকায় ঈদ হবে না। আমেরিকাতেও তিনটি টাইম জোন আছে, সেখানে প্রত্যেক টাইম জোনের জন্য আলাদা হবে। এটা খেয়াল রাখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবে চাঁদ উঠলেই আমাদের এখানে যথেষ্ট হবে না। যেমন আফগানিস্তানে গতকাল চাঁদ উঠেছে বলে দাবি করা হচ্ছে, যদিও এটা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অনেকেই বলছেন চাঁদ ওঠার কথা না।
‘আমাদের দেশের জন্য এটা স্পষ্ট যে এখানেও চাঁদ দেখতে হবে। এখানে চাঁদ উঠলে তবেই ঈদ করা যাবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক জুবায়ের মোহাম্মদ এহসানুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাধারণত চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন মাস শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেছিলেন, তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো, চাঁদ দেখে ঈদ উদযাপন করো।’
তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে ইমামদের মধ্যে মতভেদ আছে। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা, তার একটা জোরালো অভিমত আছে, কোনো জায়গায় যদি চাঁদ দেখা যায় আর সে খবরটা যদি সঠিক সময়ে যেখানেই পৌঁছাবে, তাদের আর আলাদাভাবে চাঁদ দেখতে হবে না। তারা চাঁদ দেখার সংবাদ পেয়ে রোজা শুরু করতে পারবে বা ঈদ পালন করতে পারবে।’
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ হানাফি মতবাদের সমর্থক। তবে ঈদ করার ক্ষেত্রে সৌদি আরবে চাঁদ দেখার খবরে বাংলাদেশে ঈদ করার প্রবণতা খুব বেশি মানুষের মধ্যে নেই।
বিষয়টিকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে সরকারের ঘোষণার ওপর নির্ভর করা বেশি যুক্তিযুক্ত বলেও মনে করেন এহসানুল হক। তিনি বলেন, ‘যেহেতু এখন যোগাযোগ অনেক সহজ হয়েছে এবং খুব সহজেই আমরা এক জায়গার সংবাদ অন্য জায়গায় পেয়ে যাই, কোথাও যদি চাঁদ দেখা যায় এবং সেই সংবাদ যদি পাওয়া যায় তাহলে অন্য জায়গাতেও ঈদ এবং রোজা পালন করা যেতে পারে।
‘সে ক্ষেত্রে সরকারিভাবে ঘোষণা আসা উচিত এবং সেটা সবারই ফলো করা উচিত বলে আমি মনে করি। বিচ্ছিন্নভাবে এটা আমল করলে যেমন চাঁদপুর বা অন্য কয়েকটি জায়গায় যেমনটা হয়, এটা কিন্তু সুন্দর হয় না। সরকার যদি কোনো ফর্মুলা গ্রহণ করে তাহলে ভালো হয়।’
আফগানিস্তানের সঙ্গে মিল রেখে রোববার ঈদ উদযাপনের বিষয়টিতে ভুল দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘এখন যেহেতু বিজ্ঞান অনেক উন্নত হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা হিসাব-নিকাশ করে একটি পূর্বাভাস তারা দেন। সেটিও সমন্বয় করতে হয়। আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, আফগানিস্তানে চাঁদ দেখা গেছে বলে যেটা বলা হচ্ছে এখানে হয়তো ভুল হয়েছে। আফগানিস্তানে আসলে চাঁদ দেখা যায়নি।’
কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘নতুন চাঁদের জন্মের পর ২০ থেকে ২২ ঘণ্টা সময় লাগে চাঁদ দেখার জন্য। আফগানিস্তানে গতকাল সন্ধ্যায় যখন তারা চাঁদ দেখেছে বলে দাবি করছে, তখন নতুন চাঁদের জন্মই হয়নি।
‘কাজেই চাঁদ দেখার বিষয়টি অবান্তর। এটা কোনো না কোনোভাবে ভুল হয়েছে। এ কারণে যারা আফগানিস্তানের সঙ্গে মিলিয়ে ঈদ করেছেন তারা ভুল করেছেন, নিশ্চিতভাবেই ভুল করেছেন। এটা সঠিক হয়নি।’
জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটিতে আবহাওয়াবিদ বা জ্যোতির্বিদের অন্তর্ভুক্তির পরামর্শও দিয়েছেন আরবি বিভাগের এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘চাঁদ দেখা কমিটিতে তারা থাকলে ভুল কম হবে।’