যত হালফ্যাশনের পোশাকই বাজারে আসুক না কেন, ঈদের বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া পোশাক এখনও পাঞ্জাবিই। ঈদের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজধানীসহ সারা দেশে ঈদ কেনাকাটায় পাঞ্জাবির বেচাকেনা চলছে জমজমাট।
বিক্রেতারা জানিয়েছেন, পুরুষ ক্রেতারা প্রয়োজন অনুযায়ী যে ধরনের পোশাকই কিনুক না কেন, একক পোশাক হিসেবে পাঞ্জাবির বিক্রিই সর্বাধিক। দিনের বেচাকেনা শুরুর পর মাঝরাত পর্যন্ত পাঞ্জাবির ক্রেতার ভিড় লেগে থাকে।
বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, ঈদের বাজারে প্রায় পাঁচ কোটি পিস নতুন পাঞ্জাবির সরবরাহ দরকার। রাজধানীতে এই পোশাকটির সরবরাহ দিয়ে যাচ্ছে পাঞ্জাবির কয়েকটি পাইকারি মার্কেট।
পাঞ্জাবির সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার রাজধানীর সদরঘাটের শরিফ মার্কেট। রাজধানীর পাঞ্জাবির চাহিদার ৭০ শতাংশ এককভাবে সরবরাহ করেন এই মার্কেটের সাড়ে তিন শতাধিক বিক্রেতা। বাকি ২০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে গুলিস্তানের পীর ইয়েমেনি মার্কেট ও মালিবাগ এলাকার আয়েশা শপিং কমপ্লেক্স।
বাকি ১০ শতাংশ সরবরাহ আসে বিচ্ছিন্নভাবে। এর মধ্যে আছে সায়েন্স ল্যাবরেটরিসংলগ্ন মিরপুর রোড ও এলিফ্যান্ট রোডের পাঞ্জাবির কিছু পাইকারি দোকান। এদের অনেকেরই নিজস্ব পোশাক কারখানা রয়েছে অথবা কোনো পোশাক কারখানার সঙ্গে তারা চুক্তিবদ্ধ।
এর বাইরে ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিও হচ্ছে কিছু পাঞ্জাবি।
যেভাবে ঈদের পাঞ্জাবি ছড়ায় সারা দেশে পাইকারি বাজারসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সারা বছর এসব পাইকারের ব্যবসা চললেও তাদের মূল লক্ষ্য থাকে ঈদকেন্দ্রিক বাজার। এটা তাদের সারা বছরের ব্যবসার নিরাপত্তাও নিশ্চিত করে। ঈদ সামনে রেখে তাদের সবার থাকে আগাম বিনিয়োগ প্রস্তুতি।
সদরঘাটের শরিফ মার্কেট, গুলিস্তানের পীর ইয়েমেনি মার্কেট ও মালিবাগের আয়েশা কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, পাঞ্জাবির পাইকারি ব্যবসার তিনটি শ্রেণি আছে। এর মধ্যে ছোট পাইকাররা সাধারণত ৬০-৭০ লাখ টাকা, মাঝারি পাইকার দেড় থেকে আড়াই কোটি টাকা এবং বড় পাইকাররা ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ঈদকেন্দ্রিক অতিরিক্ত পুঁজি খাটান।
এ মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির সূত্রমতে, এবার স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বাড়তি চাহিদা বিবেচনায় রেখে শরিফ মার্কেটের সাড়ে তিন শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সাড়ে তিন কোটি পিস পাঞ্জাবি সরবরাহের লক্ষ্য রয়েছে। ইতোমধ্যে তারা সেই লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন।
ঈদ কেনাকাটায় পাঞ্জাবির বেচাকেনা চলছে জমজমাট। ছবি: নিউজবাংলা
ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি সম্পর্কে এলবি গার্মেন্টসের মালিক ও শরিফ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান জানান, রোজার এক মাস আগে থেকেই শরিফ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের থাকে বাড়তি প্রস্তুতি। ঈদুল ফিতর উদযাপনের জন্য আবহাওয়ার তারতম্যের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হয়।
অভিজ্ঞ সব ডিজাইনারের মাধ্যমে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো পাঞ্জাবির নকশা করায়। কোন কাপড় এই সময়ে আরামদায়ক হবে, সেই কাপড়ের সঙ্গে কোন ডিজাইন, রং এবং কারুকাজ মানানসই হবে তারও থাকে পরিকল্পনা। একই সঙ্গে ক্রেতার বাড়তি চাহিদা সামলাতে দোকানগুলোতেও নিয়োগ দেয়া হয় বাড়তি কর্মচারী।
সব মিলিয়ে শবেবরাতের আগেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কারখানা পর্যায়ে উৎপাদন শুরু হয় এবং শোরুমে পণ্য আসতে শুরু করে। অন্যদিকে সারা দেশ থেকে তাদের নিয়মিত ক্রেতারাও (খুচরা বিক্রেতা) আসতে থাকেন। সাধারণত ২০-২২ রোজার মধ্যেই শরিফ মার্কেটের পাইকারি পর্যায়ের বিক্রি শেষ হয়ে যায়।
শরিফ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির উপদেষ্টা ও ‘পোলাইট পাঞ্জাবি’র কর্ণধার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সারা দেশে আমাদের প্রডাক্ট যায়। এবার ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান ক্যাটস আই এবং আর্টিসট্রিতে গেছে আমাদের সরবরাহ করা পাঞ্জাবি।
‘শুধু আমরাই নই, শরিফ মার্কেট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সরবরাহকৃত পাঞ্জাবি শোভা পাচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মার্কেট থেকে শুরু করে বসুন্ধরা শপিংমল ও যমুনা ফিউচার পার্কের বিভিন্ন ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানের শোরুমেও। খুচরা বিক্রেতারা স্টক শেষ হওয়ামাত্র আবার আসছেন এবং বড় ধরনের লট নিয়ে যাচ্ছেন।’
গুলিস্তানের পীর ইয়েমেনি মার্কেটের পাইকারি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ক্লাসিক পাঞ্জাবি ফ্যাশনের ব্যবস্থাপক মো. হাসান বলেন, ‘সারা দেশ থেকে আসা পাইকারি ক্রেতাদের পাশাপাশি সামর্থ্যবান ক্রেতারাও জাকাতের জন্য পাইকারি দামে এখানে পাঞ্জাবি কিনতে আসেন। তারাও বড় লটে পাঞ্জাবি কেনেন।’
পীর ইয়েমেনি মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির তথ্যমতে, এখানে পাঞ্জাবির দোকানের সংখ্যা ১০৪টি। সব দোকানই পাইকারি বিক্রেতা। আবার তারা খুচরাও বিক্রি করেন। এতে অন্য যেকোনো মার্কেটের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম দামে খুচরা ক্রেতারা তাদের বাজেট অনুযায়ী পছন্দের পাঞ্জাবিটি কিনতে পারেন।
কোথায় কেমন দাম সাধারণত সারা দেশের খুচরা বিক্রেতারাই পাইকারি মার্কেটের ক্রেতা। স্থানীয় ক্রেতাদের কাছে বিক্রির উদ্দেশ্যে রাজধানীসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিক্রেতারা পাইকারি দামে পাঞ্জাবি কেনার জন্য আসেন এসব পাইকারি মার্কেটে।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, এবার পাইকারি মার্কেটে পাঞ্জাবির সর্বনিম্ন দাম ২৫০ টাকা। সর্বোচ্চ ১৩ হাজার টাকা দামের পাঞ্জাবিও পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ পাইকারি দামই ৪৫০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
পাইকাররা জানান, পাইকারি দরে ৪৫০ টাকায় যে পাঞ্জাবি তারা বিক্রি করছেন, সেটা রাজধানীর নিউ মার্কেটে খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায় এবং যমুনা ফিউচার পার্ক-বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের বিভিন্ন শোরুমে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকার ওপরে।
ঈদ কেনাকাটায় পাঞ্জাবির বেচাকেনা চলছে জমজমাট। ছবি: নিউজবাংলা
বর্তমানে রাজধানীর মৌচাক, মালিবাগ, ইস্টার্ন প্লাজা, নিউ মার্কেট, সায়েন্সল্যাব, এলিফ্যান্ট রোড, মিরপুর, রাজধানী সুপার মার্কেটে মানভেদে দেড় হাজার টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকার পাঞ্জাবিই বেশি চলছে। তবে নামিদামি ব্র্যান্ডের শোরুমে কাপড়ের মানভেদে ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা দামের পাঞ্জাবিও বিক্রি হচ্ছে।
পীর ইয়েমেনি মার্কেটের পাইকারি বিক্রেতা মো. আজাদুর রহমান জানান, ৩০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা দামের পাঞ্জাবি বেশি চলছে।
একই মার্কেটের আল হাবিব পাঞ্জাবি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. মৃণাল জানান, সর্বনিম্ন ৬০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত খুচরা দামে তারা পাঞ্জাবি বিক্রি করছেন।
তরুণদের পছন্দ ফিটিং পাঞ্জাবি এবার ঈদে বাজারে এসেছে তুলা, রেশম, লিনেন, সিল্ক বিভিন্ন রকম সুতার তৈরি পাঞ্জাবি। আছে সলিড সাদা রঙের পাঞ্জাবিও।
বাজারে আসা এসব পাঞ্জাবির নামও বাহারি। যেমন ডিজিটাল প্রিন্ট, বঙ্গবন্ধু ধুতি, কটন প্রিন্ট, সফট কটন, সুলতানের কটন, টিজি মটকা, শাহজাদা, অরবিন্দ, কারচুপি কাজ, মসুরি প্রিন্ট, পেঁয়াজ কটন, ইন্ডিয়ান অরেঞ্জ ক্রাশ, টিস্যু কাতান নেট, ইয়াগ রোলেক্স, কাশ্মীর সিল্ক, দুলহান, টু পিস, থ্রি পিস, ফোর পিস, বম্বে সিল্ক, অল বডি কারচুপির কাজ, কারচুপির নকশা, রাজশাহী সিল্ক এবং তসর।
এ ছাড়া লাল ও কালো রঙের কনট্রাস্ট সুতি, নেভি ব্লু অল ওভার স্ক্রিন, রেড স্ক্রিন প্রিন্টেড, ধুপিয়ান সিল্ক মেনজ পাঞ্জাবিও রয়েছে। দোকানিদের তথ্য অনুযায়ী, সর্বাধিক বিক্রি হওয়া পাঞ্জাবির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ডিজাইনের সেমি লং সুতির প্রিন্ট করা একরঙা সাদা পাঞ্জাবি। তবে তরুণরা বেশি কিনছে নিয়মিত ফিট লম্বা পাঞ্জাবি, স্টাইলিশ পাঞ্জাবি, ফ্যাশনেবল সিল্ক পাঞ্জাবি।
মালিবাগ আয়েশা কমপ্লেক্সের কোয়ালিটি ফ্যাশনের মালিক মো. ফররুখ আহমেদ বলেন, ‘গরম বেশি। ক্রেতারা আরামদায়ক পাঞ্জাবি চান। এ কারণে তারা বিভিন্ন রঙের প্রিন্টেড ও এমব্রয়ডারি করা সুতি পাঞ্জাবিই বেশি কিনছেন। তবে তারা ফিটিং চাচ্ছেন।’