বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

প্রতিবাদের টিপে ভাসছে ফেসবুক

  •    
  • ৩ এপ্রিল, ২০২২ ১৫:৩৭

কপালে টিপ পরা এক নারী হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগের জেরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে তীব্র প্রতিবাদ। ঘটনাটির প্রতিবাদে কপালে টিপ পরা ছবি পোস্ট করছেন অসংখ্য নারী। প্রতিবাদের এই ধরন রাঙিয়ে তুলেছে ফেসবুককে।

বাঙালি নারীর সৌন্দর্য ধারণার সঙ্গে বহুকাল ধরে মিলেমিশে আছে কপালের টিপ।

‘বহুদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হলে ঝর্ণার জলের মতো

হেসে উঠবে, কিছুই না জেনে।

নীরা, আমি তোমার অমন

সুন্দর মুখে বাঁকা টিপের দিকে চেয়ে থাকবো।

কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘নীরার জন্য কবিতার ভূমিকা’ কবিতায় এভাবেই বিশেষায়িত করেছেন টিপকে। দ্রোহের কবি কাজী নজরুলের ইসলামও ‘প্রিয় এমন রাত’-এ ‘চাঁপা ফুলের শাড়ি খয়েরি টিপ’-এর বন্দনা করেছেন।

সেই টিপ হয়েছে আক্রোশের শিকার। কপালে টিপ পরে শনিবারের নিজ কর্মস্থলের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক ড. লতা সমাদ্দার। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় লতা সমাদ্দারকে উদ্দেশ করে কটূক্তি করেন একজন পুলিশ সদস্য।

প্রতিবাদ করতে গেলে ওই পুলিশ সদস্য তাকে হত্যার চেষ্টা করেন বলেও অভিযোগ করেছেন থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দার। থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন তিনি।

জিডির সেই কপি ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আর ঘটনাটির প্রতিবাদে কপালে টিপ পরা ছবি পোস্ট করছেন অসংখ্য নারী। প্রতিবাদের এই ধরন রাঙিয়ে তুলেছে ফেসবুককে।

তিন নারী সহকর্মীকে নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে ছবি পোস্ট করেছেন ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের নির্বাহী প্রযোজক পিয়া রহমান।

বিদ্রূপের ভঙ্গিমায় তিনি লিখেছেন, ‘আসুন, সবাই টিপ পরি আর দলে দলে ইভটিজিংয়ের শিকার হই! ইভটিজিংকে এনজয় করা শিখি😄!’

সংবাদকর্মী খাদিজাতুল কোবরা ইভা নিজের ফেসবুকে টিপ দেয়া ছবি পোস্ট করেছেন অন্তত ২৯টি।

সঙ্গে লিখেছেন, ‘একটা রাষ্ট্র টিপ পরতে পারবে না/ এই ঘোষণা দিয়াই আমারে মাইরা ফেলতে পারবে।/ আমি লোনলি হয়া যাবো, শূন্য হয়া যাবো।’

ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে নিজের প্রোফাইলে টিপ পরা ছবি দিয়েছেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ফারহা তানজীম তিতিল। ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘কপাল আমার, টিপ পরা না পরার সিদ্ধান্ত আমি নেব। আপনি নিজেকে নিয়ে মগ্ন হোন। অন্যকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হবেন না বন্ধু।’

বাহারি রঙের টিপ পরা নয়টি ছবি পোস্ট করেছেন ট্রান্সজেন্ডার অ্যাক্টিভিস্ট ও সংবাদপাঠক তাসনুভা আনান। ক্ষোভের সুরে ক্যাপশন লিখেছেন, ‘টিপ পরবই,/ যত খুশি ততবার।/ কি করবি কর।’

সঙ্গে #justiceforlota, #stopjudging, #mybodymychoice এই হ্যাশট্যাগও যুক্ত করেছেন তাসনুভা।

টিপ নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক সাদিয়া আফরিন। মা ও ছেলের টিপের ছবি পোস্ট করেছেন তিনি। নিজের কৈশোর বয়সের ঘটনা তুলে ধরে সাদিয়া লিখেছেন, “টিপ পরছোস ক্যান? এই চিন্তার সাথে আমার যোগাযোগ হয় ১৯৯৫ সালে। আমাদের ক্লাস টিচার আপা একদিন জানালেন ‘টিপ পরা হারাম’, কারণ আমাদেরই এক সহপাঠী ক্লাসে টিপ পরে এসেছিল।”

ক্লাসশিক্ষকের বলা ধর্মীয় ঘটনার উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘ইসলামের ইতিহাসে এই তথ্যের সত্যতা যাচাই করিনি আমি। তবে একজন পছন্দের শিক্ষকের মুখে এই গল্প শুনে আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। আমার পাশে বসা হিন্দু বন্ধুটির মনের অবস্থা কী হয়েছিল আমি জানি না। তবে ওর দিকে তাকাতে কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। তারপর অনেক দিন আমি টিপ পরি নাই। ভয়ে। আগুনের ভয়ে। অপবিত্রতাবোধ থেকেও....।’

তিনি আরও লেখেন, ‘বাঙালি নারীর সাজসজ্জার সাথে টিপ কখন, কীভাবে যুক্ত হয়েছিল আমার জানা নেই তবে এইটুকু জানি টিপ আমার ভালবাসা। আরও জানি মাসিকের লাল রক্তও আমার ভালবাসা (পেইনটুকু বাদে) কারণ যে মাসিকের রক্তে আমি জন্ম দেই আমার সন্তান, যে রক্ত প্রাণপূর্ণ করে তোলে ঊষর এক পৃথিবীরে সেই মাসিকের রক্ত অপবিত্র নয়, বরং আমার শক্তি....আমি তাই টিপ পরি...পরবোও।’

বাসন্তীরঙা শাড়ির সঙ্গে লাল টিপ পরা একটি ছবি নিজের প্রোফাইলে দিয়েছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক নেত্রী আফরিন নুসরাত। সঙ্গে লিখেছেন, ‘টিপ দেখলেই নাকি কাদের জ্বলে উঠছে! তাদের জন্য...।’

তিনি আরও লেখেন, ‘রক্ষক যখন ভক্ষক হয় তখন তাদের শাস্তিটাও দৃষ্টান্তমূলক হওয়া উচিত। পুলিশ কর্মকর্তার শুধু চাকরি থেকেই বরখাস্ত নয়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। যাতে আরো কেউ নারীর প্রতি এমন নিপিড়নের চিন্তাও করতে পারে না।’

পুলিশের বিরুদ্ধে ইভটিজিং ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনা লতা সমাদ্দারের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন গণমাধ্যমকর্মী মৌসুমী আচার্য্য। টিপের ছবি পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, ‘একরাশ ঘৃণা ঐ নরপশুর জন্য যে টিপ পরার অপরাধে একজন নারীকে আহত করতে, আক্রমণ করতে দুবার ভাবেনি। ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়ে জনগণের আয়করের টাকায় বেতন পাওয়া, প্রজাতন্ত্রের স্বার্থে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীর দুঃসাহস দেখে ঘৃণায়, লজ্জায়, অপমানে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি। এ লজ্জা আসলে কার??’

মৌসুমী আরও লেখেন, ‘টিপ ছাড়া তো কোনদিনই আমার মতো অনেক সাধারণ নারীর সাজ সম্পূর্ণ হয় না, তাহলে কি এরপর আমাদের পালা??’

শহীদ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদও টিপ পরে নিজের একটি ছবি ফেসবুকে দিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘টিপ কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি?/ ছবিতে উত্তর দেয়া আছে।‘

পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শুধু নারীরা সরব হয়েছেন, তা নয়। পুরুষেরাও এর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। তাদের মধ্যে কিছুটা আলাদা ছিল সংগীতশিল্পী ও সমাজচিন্তক অরূপ রাহীর প্রতিবাদের ভাষা।

নিজের কপালে টিপ পরেছেন তিনি। সেই ছবি ফেসবুকে দিয়ে ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন এই শিল্পী।

অরূপ রাহী লেখেন, “না, পুরুষ হইয়া টিপ পড়লেই বুঝা যাবে না ভিন্ন লিংগের উপর ‘৯৯ ভাগের দেশে’ চলা পুরুষতান্ত্রিক পুলিশি। এই পুলিশি সমাজের ‘পুরুষরা’ খালি আত্মীকরণ করে না, নিজেরাও ভুগতে থাকে পুরুষ পারফর্ম করতে গিয়া, অবশ্য সেটা সবাই টের পায় না বা বুঝে না- কেন কীভাবে তারা পুরুষতন্ত্রে ভুগতেছে। তাদের ‘ভালোবেসে’ ঠিক করার দরকার নাই। তাদের প্রতি দরকার আক্কেল গজায়ে দেয়া আচরণ। আমার ক্ষেত্রে হইলেও। ভালোবাসা, প্রেম নিজেদের রূপান্তরের সাধনা, সমাজ রুপান্তরের সাধনা।’

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং ম্যানেজার মাঝহারুল ইসলাম ওয়াসিম তার মেয়ের ছবি পোস্ট করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘টিপ আমার খুব পছন্দের আত্মজা, জায়া বা জননী যার কপালেই হউক।’

#ধর্মেরনামেঅসভ্যতাবন্ধহোক হ্যাশট্যাগ যুক্ত করেছেন তিনি।

ঘটনার বিশ্লেষণ করতে গয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একটি ঘটনার ওপর প্যাটার্ন দাঁড় করানো যায় না। তবে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার মানসিকতা এবং সাইকোলজিক্যাল স্টেট কিন্তু পুলিশের মাঝে বিরাজ করছে।’

পুলিশ বাহিনীকে কার্যকর সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিণত করা যায়নি, এই ঘটনা তারই একটা উদাহরণ বলে মনে করছেন এই অধ্যাপক।

অপরাধবিজ্ঞানী জিয়া রহমান বলেন, ‘পুলিশ ফোর্স এটা ছিল ব্রিটিশ আমলে। কিন্তু সারা পৃথিবীতে এখন বলা হয় পুলিশের সার্ভিস। এই সার্ভিসের ফিলোসফিটা যে পুলিশের মাঝে এখনও ডেভেলপ করেনি সেটা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে।’

তবে সব পুলিশ সদস্যকে এক পাল্লায় ফেলতেও রাজি নন জিয়া রহমান।

তিনি বলেন, ‘যারা এ ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এটি একটি রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ। ভুক্তভোগী একজন নারী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ এবং শিক্ষক। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আমি মনে করি পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে সিরিয়াস পানিশমেন্টের আওতায় আনা উচিত। তার চাকরি থাকা কোনোভাবেই উচিত না।’

এ ঘটনাকে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখছেন ‘আমরাই পারি’-এর নির্বাহী সমন্বয়কারী জিনাত আরা হক।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়েও টিপ নিয়ে বিরোধিতা ছিল। পূর্ব বাংলার নারীরা কেন টিপ পরে, তা নিয়ে পশ্চিমা শাসকরা ক্ষুব্ধ ছিল। কারণ তারা এটাকে ভাবত হিন্দুয়ানি প্রথা হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ তারা আমাদের সংস্কৃতিকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিল।

‘সেই প্রেতাত্মা এখনও মরেনি। বরং দিনকে দিন আরও শক্তিশালী হচ্ছে।’

ঘটনাটি কে ঘটিয়েছে, কার মাধ্যমে হয়েছে, সেই বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন এই অধিকারকর্মী। তিনি বলেন, ‘এটা করেছে রাষ্ট্রের একজন পোশাকধারী কর্মচারী। সে পুলিশের পোশাক পরা, সে কোনোভাবেই এটা করতে পারে না। যখনই আমি রাষ্ট্রীয় আইডেনটিটি নিই বা ইউনিফর্ম পরি তখন কিন্তু আমার কিছু রেসপনসিবিলিটি থাকে- কী করতে পারব, কী পারব না।’

অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য একাধারে ওই কলেজশিক্ষককে যৌন হয়রানি করেছেন, সাংস্কৃতিকভাবে এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির জায়গা থেকেও আঘাত করেছেন বলে জানান জিনাত আরা হক।

তিনি বলেন, ‘তিনি আমাদের সংবিধান পরিপন্থি কাজ করেছেন, আইনের পরিপন্থি কাজ করেছেন। তাকে অবশ্যই বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর