সাহায্য চাইতে বয়স্কদের অনেকেই সংকোচে ভোগেন। মনে হয়, এতে করে যেন নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাবে। অথবা মনে হতে পারে, কোনো কাজে সাহায্য চাওয়ার অর্থ কাজটি আপনি করতে পারছেন না।
বড়দের মতো শিশুরাও ভোগে এমন মানসিক দ্বন্দ্ব ও ভয়ে। নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা স্কুলে ঠিক এ কারণেই প্রয়োজনের সময়ে সাহায্য চায় না।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত মনোবিজ্ঞানীরা মনে করতেন, অন্তত ৯ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত শিশুরা তাদের মর্যাদা নিয়ে খুব একটা সচেতন নয়। কাছের বন্ধুরা তাদের নিয়ে কী ভাবছে সে বিষয়ে খুব একটা পরোয়া নেই অল্প বয়সী শিশুদের। তবে নতুন গবেষণা বদলে দিয়েছে এই ধারণা।
দেখা গেছে, পাঁচ বছর বয়সী শিশুও তার বিষয়ে অন্যের চিন্তাভাবনাকে খুব গভীরভাবে গুরুত্ব দেয়। আর এ কারণে নিজেকে অন্যের চোখে বুদ্ধিমান প্রমাণের জন্য শিশুরা ছল-চাতুরির আশ্রয়ও নিয়ে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ডেভেলপমেন্ট সাইকোলজি বিভাগের পিএইচডির ছাত্রী কেয়লা গুড ও ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর মনোবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক অ্যালেক্স শ গবেষণাটি করেছেন। এ বিষয়ে তারা একটি প্রতিবেদন লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী সায়েন্টিফিক আমেরিকান-এ। নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি অবলম্বনে লিখেছেন রুবাইদ ইফতেখার।
গবেষণায় দেখা গেছে, সাত বছর বয়সী শিশুরাও অন্যদের কাছে সাহায্য চাওয়ার সঙ্গে নিজেদের ‘অক্ষমতার’ অনুভূতিকে বিবেচনায় নিতে শুরু করে।
গবেষকেরা বলছেন, নিজের মর্যাদা সম্পর্কে শিশুদের উদ্বেগ তাদের শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। প্রতিটি শিশুই ক্লাসরুমে পড়াশোনায় সংগ্রাম করে। এ পরিস্থিতিতে সহপাঠীদের টিপ্পনীর ভয়ে তারা সাহায্য চাইতে ভয় পেলে শেখার ক্ষতি হতে পারে।
প্রতিবেদনে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে শিক্ষকদের আরও যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে, যাতে করে শিশুদের সাহায্য চাওয়ার বিষয়টি সহজ করা যায়।
শিশুরা নিজেদের মর্যাদা সম্পর্কে কীভাবে চিন্তা করে তা জানতে গবেষকরা ডেভেলপমেন্টাল সাইকোলজির একটি পুরোনো কৌশল প্রয়োগ করেছেন। তারা বলছেন, চারপাশের জগৎ সম্পর্কে শিশুদের যুক্তি বেশ পরিশীলিত হতে পারে, তবে মনের ভেতর কী ঘটছে সেটা তারা সব সময় ব্যাখ্যা করতে পারে না। গবেষণায় কেয়লা ও শ কিছু সাধারণ গল্প তৈরি করে সেগুলো নিয়ে শিশুদের ভাবনা জানতে কিছু প্রশ্ন করেছেন।
তারা চার থেকে ৯ বছর বয়সী ৫৭৬ শিশুকে গল্পের দুই শিশু চরিত্রের আচরণ অনুমান করতে বলেন। ওই দুই চরিত্রের একটি সত্যিকার অর্থেই বুদ্ধিমান হওয়ার চেষ্টা করছিল, আর আরেকটি চাচ্ছিল অন্যদের কাছে নিজেকে বুদ্ধিমান প্রমাণ করতে।
গবেষকরা শিশুদের বলেন, ক্লাসে একটি পরীক্ষায় ওই দুই শিশু চরিত্রই খারাপ করেছে। এ ক্ষেত্রে গল্পের দুই শিশুর মধ্যে কে আগে ক্লাসরুমে শিক্ষকের কাছে সাহায্য চাইবে?
দেখা গেছে, চার বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে উভয় চরিত্রকেই সমানভাবে বেছে নেয়ার উত্তর এসেছে। এর মানে তারা ‘বুদ্ধিমান হওয়ার চেষ্টা’ বা ‘বুদ্ধিমান দেখানোর চেষ্টা’র মধ্যে কোনোটিকেই এগিয়ে-পিছিয়ে রাখেনি।
তবে সাত বা আট বছর বয়সী শিশুদের ধারণা, গল্পের যে শিশুটি নিজেকে অন্যদের সামনে বুদ্ধিমান দেখাতে চাইছে তার সাহায্য চাওয়ার সম্ভাবনা কম। এর ভিত্তিতে গবেষকেরা বলছেন, সাত বা আট বছর বয়সে পৌঁছানো শিশুরা ‘মর্যাদাবোধকে’ গুরুত্ব দিতে শিখেছে।
প্রশ্নের জবাব দেয়ার সময় এ বয়সী শিশুরা চিন্তা করছিল, সহপাঠীদের সামনে গল্পের শিশুর আচরণ কেমন হওয়া উচিত! গবেষণায় অংশ নেয়া এই শিশুদের ধারণা ছিল, গল্পের যে শিশুটি নিজেকে বুদ্ধিমান দেখাতে চাইছে সে সাহায্য হয়তো চাইবে, তবে সেটা ঘটবে সবার আড়ালে (হতে পারে এটা কম্পিউটারের মাধ্যমে)।
গবেষকেরা অন্যান্য পরিস্থিতি তুলে ধরেও শিশুদের প্রশ্ন করেছেন। তারা দেখেছেন, শিশুরা ‘ব্যর্থতা স্বীকার করা’ বা ‘সফলতাকে কম করে দেখানোর’ মতো আরও কয়েকটি আচরণ চিহ্নিত করতে সক্ষম। আর এসব আচরণ সহপাঠীদের সামনে ‘কম বুদ্ধিমান’ হিসেবে তুলে ধরতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করে। এ জন্য আচরণগুলো সম্পর্কে তারা বিশেষ সচেতনতা বজায় রাখে।
কেয়লা ও শয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, মর্যাদা নষ্ট হবে ভেবে যেসব শিশু সমস্যায় ভোগে, তারা সাহায্য চাওয়া এড়িয়ে যেতে পারে। এর ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে মারাত্মক বাধা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে কীভাবে শিশুদের সাহায্য করা সম্ভব- তাও অনুসন্ধান করেছেন গবেষকেরা। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত পদ্ধতির কিছু দুর্বলতা পাওয়া গেছে।
অনেকেই শিশুদের সাহায্য চাওয়ার শিক্ষামূলক দিকটির ওপর জোর দেন। তবে দুই গবেষক বলছেন, এর ফলেও শিশুরা নিজেদের ‘অযোগ্য’ ভাবতে পারে। এর পরিবর্তে শিশুদের মর্যাদাবোধ অক্ষুণ্ন রেখে সমাধানের তাগিদ দেয়া হয়েছে গবেষণায়।
এতে বলা হয়েছে, সাহায্য চাওয়ার ‘সামাজিক ঝুঁকি’ কমানো উচিত বড়দের। যেমন, সহপাঠীরা যখন গ্রুপের কাজ সামলাতে ব্যস্ত, তখন শিক্ষকরা একান্তে কথোপকথনের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে নিজেকে সহজলভ্য করে তুলতে পারেন। শিক্ষকদের এমন পদক্ষেপ নেয়া উচিত, যাতে করে অন্যের সামনে প্রশ্ন করাকে স্বাভাবিক, ইতিবাচক আচরণ হিসেবে শিক্ষার্থীরা ভাবতে পারে।
এ ছাড়া শিক্ষকরা এমন কার্যক্রম তৈরি করতে পারেন যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থী একটি ভিন্ন বিষয়ে ‘বিশেষজ্ঞ’ হয়ে ওঠে। সে ক্ষেত্রে শিশুদের সবগুলো বিষয় আয়ত্ত করতে একে অপরের কাছে অবশ্যই সাহায্য চাইতে হবে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, শিশুদের সাবলীল করতে পরিবারেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। শিশুর একটি প্রশ্ন নিয়ে পুরো পরিবার একসঙ্গে আলোচনাকে উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে দেখানো যেতে পারে, সাহায্য চাওয়া কেবল সাহায্যপ্রার্থীকেই নয় বরং একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হওয়া অন্যদেরও উপকার করে। প্রাপ্তবয়স্করা সহায়তা চাওয়ার জন্য বাচ্চাদের প্রশংসাও করতে পারেন।
ভয় কাটাতে হবে শিশুদের
প্রশ্ন করতে শিশুদের ভয় পাওয়া নিয়ে নিউজবাংলা কথা বলেছে রাজধানীর সানিডেল স্কুলের কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট নাজিয়া হোসেনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘জন্মের পর থেকে বাচ্চাদের ভেতরে এ ধরনের ভয়গুলো কাজ করে। জন্মের পরে আট থেকে নয় মাস পর্যন্ত শিশুদের স্ট্রেঞ্জার ফোবিয়া কাজ করে, যেখানে তারা অপরিচিত কোনো চেহারা দেখলেই ভয় পায় ও পছন্দ করে না। ১০ মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত তাদের মধ্যে কাজ করে সেপারেশন অ্যাংক্সাইটি। এ সময়ে তারা যার কাছে বড় হয়েছে, মা-বাবা বা বিশেষ করে যাদের সঙ্গে অ্যাটাচমেন্টটা বেশি; তাদেরকে ছেড়ে দিতে হবে এ ভয়টা কাজ করে। এ জিনিসগুলো সঠিকভাবে সামাল দেয়া না গেলে ও সঠিকভাবে চিহ্নিত করা না হলে ভয়টি থেকে যায়।’
তিনি বলেন, “সামাজিকভাবে বাচ্চাদের ভয়টা তৈরি হয়, যখন তারা কোনো কিছু জানতে চেয়ে বা কিছু জিজ্ঞেস করে সেটার বিপরীতে ধমক শোনে। অথবা তাদের বলা হয় যে ‘এখন বাইরে যাওয়া যাবে না, বাইরে গেলে ভয়ের কিছু আছে বা মারবে।’ সেটা শুনে ওরা চুপ করে যায় এবং নিজে থেকে খাপ খাইয়ে নেয়। এরপর যখন আপনি ওদের বাইরে নিয়ে যেতে চান বা কারও সঙ্গে মিশতে বলেন তখন তারা আর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না।”
শিশুদের সাবলীল করার পরামর্শ দিয়ে নাজিয়া হোসেন বলেন, ‘কোনো কিছুতে যদি শিশুরা ভয় পায়, সেটা তাদের সামনে তুলে ধরা ঠিক না। যেমন, ভয়ের গল্প করা, ঝগড়াঝাঁটি করা। বিশেষ করে বাচ্চাদের সামনে মা-বাবার সম্পর্কটা ঠিক রাখতে হবে। এটা বড় ব্যাপার।
“বাচ্চাদের বিভিন্ন সময়ে বাইরে নিয়ে গিয়ে সবার সঙ্গে মেশার ব্যাপারটা বোঝাতে হবে। যেমন কাউকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে, ‘উনি তোমার এই হয়’, ‘ওনার সঙ্গে আমার এ সম্পর্ক’, ‘সালাম দাও’ বা ‘তুমি তার সঙ্গে কথা বলো’ এমনটা বলা যেতে পারে। এটা বলে চলে যাওয়া যাবে না। তাদের সঙ্গে থাকতে হবে, যাতে শিশুরা বোঝে- আমি এ মানুষটার সঙ্গে নিরাপদ কারণ আমার মা-বাবা নিরাপদ।”
স্কুলের পরিবেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শিশুরা থাকে। স্কুলে শিক্ষকরাই বাচ্চাদের বাবা-মা। শিক্ষকদের শুরুতে সেটাই জিজ্ঞেস করা উচিত যেটা শিশুরা পারে। যেমন, একটা ছড়া যেটা ওই শিশু পারে সেটাই জিজ্ঞেস করা উচিত। আর তখন শিক্ষক যদি সঙ্গে থাকেন বা একসঙ্গে আবৃত্তি করেন, তাহলে পরে শিশুটির মধ্যে না পারার ভয়টা আর কাজ করবে না।’