অন্যের প্রতি ভালোবাসা কীভাবে জন্মায় তা এক রহস্য। একটু চোখের দেখা, একটা সাধারণ পরিচয়, সামান্য কথোপকথন কখন যে ভালোলাগা আর ভালোবাসায় রূপ নেয় বলা মুশকিল।
কোনো এক আশ্চর্য কারণে, একটু আগের অচেনা মানুষটির জন্যে একটু পর থেকেই শুভকামনা গড়ে ওঠে মনে। মনে হয়, সে যেন ভালো থাকে, সে যেন জানে তার জন্যে প্রতীক্ষায় আছে একজোড়া চোখ। সে যেন বোঝে কোথাও তার জন্য একটা চিকন চারুকষ্ট অতি ধীরে জন্ম নিচ্ছে।
ক্রমে নির্ভরতা বাড়ে। দায়িত্ব বোধ হতে থাকে। কিছুটা অধিকার জন্মায়। তারপর দুজনের প্রশ্রয় আর আশ্রয়ে এই মমতা আরও গাঢ় হয়ে নিটোল ভালোবাসায় রূপ নেয়। একদিন যে কেউ ছিল না, কিছুদিন পরে সে-ই ‘সব’ হয়ে দাঁড়ায়।
ভালোবাসার সম্পর্কগুলো তাই মনে হয় যেন নদীর স্রোতে কচুরিপানার ভেসে চলার মতো। কেউ কাউকে চেনে না, কিন্তু অমোঘ স্রোতের টানে একজন আরেক জনের সঙ্গে এসে মিশে যায়।
শেকড়ে, পাতায়, বর্ণে, গন্ধে সংযুক্ত হয়। তারপর যূথবদ্ধ আলিঙ্গনে একসঙ্গে ভেসে চলে। এই স্রোতের উপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। কখন কে কার সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে তার উপরেও নিয়ন্ত্রণ নেই। কেউ অনেক দিন একসঙ্গে থাকে, আবার কেউ কোনো এক দমকা বাতাসে বা আরেকটা কোনো স্রোতের টানে অন্যদিকে ভেসে যায়। কেবল রয়ে যায় একসঙ্গে থাকা সময়ের কিছু রঙিন রুমাল, কিছু স্মৃতির পালক, কিছু স্বপ্নীল মেঘ, আর মোহগন্ধী বৃষ্টির ছোঁয়া।
মানুষ আদর করে এসব রুমাল, পালক, মেঘ আর বৃষ্টির নানা নাম দেয়। তারপর, ‘বাঞ্ছা ঘোরে বাঞ্ছিতেরে ঘিরে’। ‘আলোর মতন, হাসির মতন, কুসুমগন্ধরাশির মতন, হাওয়ার মতন, নেশার মতন ঢেউয়ের মতো’ দুজনে ভেসে যায়।
এই ভেসে যাওয়াকে প্রেম, পরকীয়া, ভালোবাসা, রিলেশন যে নামেই ডাকা হোক না কেন, আহার নিদ্রা মৈথুনের আটপৌরে একঘেয়ে জীবনে এই সব সম্পর্ক অনন্ত মাধুর্যের জন্ম দেয়। কারণ, ভালোবাসাহীন জীবন তো কেবল দিনের সঙ্গে দিন বা বয়সের সঙ্গে বছর যোগ করা।
তবে এই মাধুর্য লাভ করা কিন্তু ঝাঁপ দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসার মতো না। এ রকম নিটোল সম্পর্কে পৌঁছানো অনেকটা নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে হিমালয়ের চূড়ায় উঠার মতো। সহজে ওঠা যায় না। আবার একবার উঠলে সহজে নামাও যায় না।
পরিচয়ের পর কিছুদিন চলে পরস্পরকে আবিষ্কার পর্ব। সব ভালো লাগার সময় এটা। একে একে আসে উচ্ছ্বাস পর্ব, মাধুর্য পর্ব, ভরপুর আনন্দের আশ্চর্য সব মুহূর্ত পর্ব পার হয়ে একদিন ঊর্ধ্বমুখে ছোটা আবেগের তীরের গতি শ্লথ হয়ে যায়।
এইপর্বে এসে মনে হয়, বুঝি তাল কেটে যাচ্ছে। একজন হয়ত চায়, পাখিটা সারাক্ষণ আমার ডালে বসে থাকুক। আরেক জন ভাবে, কেবল দিন শেষে ক্লান্ত ডানা আর শ্রান্ত মন নিয়েই সে প্রিয়তম ডালে এসে বসবে। একজনের মনে হয়, আগের মতো আর গুরুত্ব পাচ্ছে না; বন্দিত্বের আশংকায় তখন আরেক জনের দমবন্ধ লাগে।
এই পর্বে একটু থেমে, খানিকটা দূর থেকে অনেকে নিজেদেরকে দেখতে শুরু করে। তারা বোঝে দুটো রেললাইন কিছুটা দূরে থাকে বলেই তাদের উপর ভর করে সম্পর্কের ভারী ওয়াগনগুলো তর তর গড়িয়ে যেতে পারে। মানুষ যে সবাই আলাদা, একজন যে আরেক জনকে তার মতো করে গড়তে পারে না, এই সত্য তখন স্পষ্ট হয় দুজনের কাছে।
‘যে যেমন তাকে তেমন রেখেই’ তার প্রতি নিবিষ্ট থাকা শেখা হয় এই পর্বে। তারা বোঝে আগলে রাখা আর আটকে রাখা এক নয়। এভাবে অনেক দ্বিধা-সংকোচ-ঈর্ষা-সন্দেহ ইত্যাদি চড়াই উৎরাই পার হয়ে ভালোবাসার সম্পর্কটি অবশেষে ঝড় থেমে যাওয়ার পর শান্ত দিঘির মতো একটা শান্ত সমাহিত পরিণীতি লাভ করে।
এই পর্বে বিশ্বাস, নির্ভরতা আর অধিকার জমাট বেঁধে ওঠে। আগে এক মিনিট দেরি সইত না যার, এই পর্বে সে দীর্ঘসময় অপেক্ষায় থাকতে পারে। এবং হয়ত একই স্কেলে দুজনে গায় না, কিন্তু আবার তালে ফিরে আসে। কারণ তারা আদিতে দুজনই যে সুরেলা মানুষ!
এই শান্ত সমাহিত গভীর পর্বটিই হলো দুজন মানুষের মধ্যে একটি আদর্শ ভালোবাসার সম্পর্ক। মানবজীবনের শ্রেষ্ঠতম আশীর্বাদ। এই পর্বে পৌঁছানোটা কঠিন, কিন্তু একবার পৌঁছে গেলে দুজনের মনই অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে থাকে। তারা অজান্তেই ‘চলতে ফিরতে গুনগুন’ করে, তারা পরস্পরের জন্য আরও যোগ্য, উন্নত আর সুন্দর হয়ে ওঠে। চারা লাগিয়ে প্রচুর যত্নের পরেও অনেক গাছ যেমন ভালো ফল দেয় না, তেমন অনেক ভালোবাসার পরেও কিছু সম্পর্ক টেকে না। কোনো এক অজানা কারণে কিছু পাখি অন্য কোনো আকাশে উড়ে অন্য ডালেই বসতে চায়। তখন?
তখন পোষা পাখি ছেড়ে দেয়ার আনন্দ উপভোগ করতে হয়। এ হচ্ছে উদারতার আনন্দ। যে মুক্তি চাচ্ছে তাকে মুক্ত করার আনন্দ। বন্দীর মুক্তিতে আনন্দিত হওয়ার আনন্দ। যদিও শূন্য খাঁচার দিকে তাকালে মন ভরে ওঠে বিষাদে, তবু এই বিষাদ নির্ভার। সব শূন্য করে দিয়েও যদি ‘ভিক্ষামাঝে’ কোনো ‘সোনার কণা’ না থাকে তাহলে তো বলাই যায়, ‘আমার হৃদয় দুই হৃদয়ের সমান বড়শুধাব না সত্যি ভালোবাস কি না’ভালোবাসা ‘পেলাম না’র চেয়ে ‘দিলাম না’র মূল্য যেদিন বেশি উপলব্ধি করতে পারি; সেদিনই বুঝতে পারি, ভালোবাসার যোগ্যতা অর্জন করেছি। পাখিকে ভালোবাসলে তার উড়ে যাওয়ার ক্ষমতাকেও ভালোবাসতে হয়।
লেখক: জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর দপ্তরের হিউম্যান রাইটস অফিসার