শিশুরা কী করে বোঝে প্রিয়জনের ভালোবাসা? মাতৃগর্ভে মাসের পর মাস কাটানোর সুবাদে মায়ের সঙ্গে শিশুর আত্মিক সম্পর্কের বিষয়টি অনেকটাই পরিষ্কার, কিন্তু বাবা, ভাই-বোন অথবা অন্য স্বজনের ভালোবাসা কীভাবে আলাদা করে বুঝতে পারে নবজাতক?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিস্ময়কর এক সূত্র আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা দেখেছেন, মুখের লালা এ ক্ষেত্রে পালন করছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (এমআইটি) ডেভেলপমেন্ট সাইকোলজিস্ট অ্যাশলি থমাস ও তার সঙ্গীরা চালিয়েছেন এ-সংক্রান্ত গবেষণা। তাদের নিবন্ধ ছাপা হয়েছে বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল সায়েন্স-এ
গবেষক দলটি বলছে, শিশুরা আসলে ভালোবাসা নামক অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হয় লালার মাধ্যমে!
অ্যাশলি বলেন, ‘আমাদের লালা তখনই আদান-প্রদান হয়, যখন ঘনিষ্ঠজনকে চুম্বন করি অথবা তার সঙ্গে আইসক্রিমের মতো খাবার ভাগাভাগি করি। অনুকরণপ্রিয় শিশুরা এই ঘটনাকে কাছের সম্পর্ক হিসেবে ধরে নেয়। এসব ঘনিষ্ঠ মানুষ হতে পারে বাবা-মা, ভাই-বোন অথবা কাছের কোনো প্রিয়জন।’
গবেষণায় আট মাস বয়সী বেশ কিছু শিশুকে একটি ভিডিও দেখানো হয়েছে। ভিডিওতে একটি পুতুলকে কাঁদতে দেখা যায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে হতচকিত বেশির ভাগ শিশু এমন প্রাপ্তবয়স্কদের দিকে সাহায্যের আর্জি নিয়ে তাকিয়েছে, যারা এর আগে ওই শিশুদের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করেছেন। অর্থাৎ আধ-খাওয়া খাবারের মাধ্যমে লালা বিনিময় হয়েছে। আর যাদের সঙ্গে এ ধরনের বিনিময় ঘটেনি তাদের দিকে ফিরেও তাকায়নি শিশুরা।
কান্নারত পুতুল দেখে শিশুদের মনে কী ঘটছিল সেটা অবশ্য বের করতে পারেননি গবেষকরা। তবে এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাহায্য চাইতে শিশুরা প্রথমেই কার ওপর নির্ভর করে- গবেষণায় সে বিষয়ে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
অ্যাশলে বলেন, ‘আমাদের ধারণাটি ছিল, দুঃখভারাক্রান্ত পুতুল দেখে বাচ্চারা এমন কারও সহায়তা চাইবে যার সঙ্গে পুতুলটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকতে পারে বলে তারা আশা করছেন।’
আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেছে গবেষক দলটি। এসব ক্ষেত্রে ৮-১০ মাস বয়সী শিশুদের এবং ১৬-১৮ মাস বয়সীদের দুটি ভিডিও দেখানো হয়।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একজন নারী পুতুলের সঙ্গে একটি কমলার টুকরা ভাগ করছেন। দ্বিতীয় ভিডিওতে দেখানো হয়, আরেক নারী পুতুল সঙ্গে নিয়ে বল খেলছেন। দুটি দৃশ্য শেষে দেখা যায়, ওই দুই নারীর মাঝে থাকা পুতুলটি বিমর্ষ।
এই পরীক্ষায় দেখা গেছে, বিমর্ষ পুতুলটিকে দেখামাত্র শিশুদের চোখ সেই নারীর দিকে গেছে, যিনি পুতুলটিকে কমলার টুকরা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তারা ধরে নিয়েছে ওই নারীই পুতুলটির ঘনিষ্ঠ।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক নারী তার আঙুল মুখে ঢুকিয়ে তারপর সেই আঙুল পুতুলের মুখে পুরে দিচ্ছেন। এরপর ওই নারী নিজের কপালে আঙুল ছুঁইয়ে আরেকটি পুতুলের কপাল স্পর্শ করেন। এ ক্ষেত্রে শিশুরা সেই পুতুলটির দিকেই বেশি সময় ধরে তাকিয়ে ছিল, যেটির মুখে লালা লাগিয়েছিলেন ওই নারী।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৫-৭ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রেও লালা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্র হিসেবে কাজ করে। গবেষকেরা বলছেন, যেসব শিশু আধ-খাওয়া খাবার ভাগ করে খায় তারা নিজেদের একই পরিবারভুক্ত মনে করে। আর যারা খেলনা বা পুরো খাবার ভাগাভাগি করে, বড়জোর তারা নিজেদের বন্ধু মনে করে।
এই ফলাফল শিশুদের দৈনন্দিন জীবন বুঝতে সহায়তা করবে বলে মনে করছে গবেষক দল।