বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘এলেম আমি কোথা থেকে’

  •    
  • ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৮:০৯

আমরা বলতে যতটা লজ্জা পাই, শিশুরা শুনতে অতটা লজ্জা পায় না। কারণ, সমাজ তার নির্ধারিত ছাঁচে ইতিমধ্যেই আমাকে ‘লজ্জিত ও আড়ষ্ট’ করে গড়ে তুলেছে, আমরা অলরেডি ‘স্পয়েল্ড’। তবে শিশুর মন এখনও স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ।

‘এলেম আমি কোথা থেকে’- এ প্রশ্ন সব শিশুই করে। তবে প্রায় সবাই জীবনের এই প্রথম সরল প্রশ্নের গরল উত্তর পেয়ে আটকে যায় বিভ্রান্ত ধারণায়।

শিশুদের এই প্রশ্নের ক্ষেত্রে বাবা-মা কী করতে পারেন তা নিয়ে এই নিয়ে লেখা।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, প্রশ্ন এড়িয়ে না যাওয়া এবং ভুলভাল উত্তর না দেয়া। মনে রাখতে হবে যৌনতা বা শরীর নিয়ে আলোচনার অস্বস্তি আমাদের বড়দের, শিশুদের নয়।

আমরা বলতে যতটা লজ্জা পাই, শিশুরা শুনতে অতটা লজ্জা পায় না। কারণ, সমাজ তার নির্ধারিত ছাঁচে ইতিমধ্যেই আমাকে ‘লজ্জিত ও আড়ষ্ট’ করে গড়ে তুলেছে, আমরা অলরেডি ‘স্পয়েল্ড’। তবে শিশুর মন এখনও স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ। তাছাড়া তারা মোটেই বোকা নয়। তাদের সঙ্গে সিরিয়াস আলোচনা করা চলে।

সুতরাং মিথ্যা, অবৈজ্ঞানিক তথ্যে তাদের বিভ্রান্ত করার চেয়ে সত্যটি জানিয়ে দেয়াই আমাদের কর্তব্য। অবশ্য তাই বলে সঙ্গম, বীর্যপাত, শুক্রাণু, ডিম্বস্ফোটন ইত্যাদি শব্দও তারা বুঝতে পারবে না। তবে শিশুদের আমরা কতটা বলব, কীভাবে বলব, কতটা শুনলে তারা বিশ্বাস ও সহ্য করতে পারবে, সেটি বিবেচনায় রাখাও দরকার।

বিদেশে দেখেছি বাচ্চাদের জন্য ‘how we were born’ বা ‘what makes a baby’ ধরনের শিশুতোষ বই পাওয়া যায়। বাংলাদেশেও কিছু কিছু পাওয়া যায়। সমস্যা হলো, প্রথমত সেগুলো বয়সভেদে উপযুক্ত নয় এবং দ্বিতীয়ত সেগুলো পড়ার পরেও বাচ্চাদের প্রশ্ন থাকে। সুতরাং শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রতি পরিবারে যৌন-প্রশ্নোত্তরের সহায়ক পরিবেশ থাকা দরকার। সে ক্ষেত্রে নিচের উপায়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে-

শিশুর বয়স, ধারণক্ষমতা ও প্রশ্নের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা: তিন বছরের বাচ্চা আর ছয় বছরের বাচ্চা একই প্রশ্ন করলে একই রকম উত্তর হবে না।

‘আমি কোথা থেকে এলাম’- এই প্রশ্নে একজন হয়তো বুঝিয়েছে কীভাবে পেটের ভিতর থেকে বের হলাম। আরেকজন হয়তো জানতে চাচ্ছে কীভাবে পেটের মধ্যে ঢুকলাম। অতএব, আগে প্রশ্ন বুঝে নেয়া দরকার।

চমকে না যাওয়া: চমকে না গিয়ে বরং এমন ভাব করা যেন এমন প্রশ্ন আর ‘জামাটা কোথায়’ এমন প্রশ্নও একই রকম। এরপর পাল্টা প্রশ্ন করে আলোচনা এগিয়ে নেয়া যেতে পারে।

ধরা যাক বাচ্চা জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কোথা থেকে এলাম?’ আমরা জবাবে বলতে পারি, ‘তোমার কী মনে হয় বলো তো? কোথা থেকে এসেছ তুমি?’

ইতিমধ্যে তার মাথায় কোনো ভুল ধারণা চেপে বসে আছে কি না, সেটি এভাবে বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। অথবা সে আসলে কী এবং কতটুকু জানতে চায়, সে সম্পর্কেও আমরা ধারণা পেতে পারি।

এরপর সিরিয়াসলি জবাবটি শুনে এটা-সেটা না বুঝিয়ে শিশুকে সত্যটি বলা উচিত। যেমন, ‘তুমি এসেছ তোমার মায়ের পেট থেকে।’

এরপর একটু অপেক্ষা করে দেখা সে পাল্টা প্রশ্ন করে কি না। না করলে এই সেশনে আপাতত এটুকুই। এক সেশনে তাকে সব বুঝিয়ে দেয়ার দরকার নেই।

তবে সে যদি জিজ্ঞেস করে, ‘পেট থেকে কীভাবে বের হয়েছি?’- তাহলে বলা যেতে পারে, ‘ডাক্তার পেট থেকে বের করে ছোট্ট পুতুলের মতো বেবিটাকে গোলাপি একটা নরম তোয়ালের মধ্যে করে আমার হাতে দিয়েছিল (আলোচনাটি ডাক্তার, তোয়ালে, গোলাপি, পুতুল ইত্যাদির মধ্যে একটু ডাইভার্ট করে পরের সেশনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা আরকি!)।

সহজ শব্দ বেছে নেয়া: কোনো শব্দ শিশুর অপরিচিত হলে সেই শব্দের মানে বলে দেয়া। তার নিজের ইন্টারপ্রিটেশনের সুযোগ কমিয়ে দেয়া। যেমন: নরমাল ডেলিভারির ব্যাপারটা এড়াতে এমন না বলা যে, ‘মায়ের পেট কেটে বের করেছে তোমাকে।’

এতে সে ভয় পেয়ে যেতে পারে। কারণ, সিজারিয়ান ব্যাপারটা আমরা যেমন বুঝি শিশুরা তেমন বোঝে না। তাই বেলি আর ইউটেরাস বা ওম্ব যে আলাদা তা বুঝিয়ে দেয়া দরকার। নইলে সে ভাবতে পারে পেটের ভিতর খাবার, পানি, মলমূত্রের মধ্যে সে বোধহয় একটা খারাপ অবস্থায় ছিল। এর পরিবর্তে সে যেন বোঝে, তার জন্য মায়ের পেটের মধ্যে একটা বিশেষ আরামদায়ক ও ‘সম্মানজনক’ বাসস্থানের ব্যবস্থা ছিল।

তাড়াহুড়া না করা: প্রশ্নের জবাবে তাড়াহুড়া এড়াতে হবে, তবে ‘পরে বলব’ বলে ঝুলিয়ে রাখাও ঠিক নয়। প্রয়োজনে সময় চেয়ে নেয়া যেতে পারে এবং নিজে থেকেই আবার আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।

সৎ থাকা: মনে রাখতে হবে, পুরো ব্যাপারটি অস্বস্তিকর মনে হলেও শেষ বিচারে এখানে শুধু দুটি মানুষ- আমি আর আমার সন্তান। আমার সৎ আচরণ, বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন ও তার ব্যাখ্যা আমার সন্তানকে আশ্বস্ত করবে। সমাজ নয়, ট্যাবু নয়, প্রথাবদ্ধ সংস্কার নয়; দিন শেষে জীবন আমাদের দুজনের। অতএব সব ধরনের অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে সন্তানকে সত্যটি জানানো উচিত। নইলে সে কিন্তু হকারের কাছ থেকে, চটি থেকে, পাকনা বন্ধুদের কাছ থেকে ‘জেনে’ নেবে। আর সেটা মোটেই ভালো হবে না। উদাহরণের সাহায্য নেয়া: প্রাণীর জন্ম প্রক্রিয়ার সঙ্গে মানুষকে রিলেট করে গল্প করা যেতে পারে। প্রাণীকুলে যাদের বাচ্চা হয় তার ভিডিও একসঙ্গে বসে দেখা যেতে পারে। এ-সংক্রান্ত শিশুতোষ বই পড়ে শোনানো যেতে পারে। এভাবেই আস্তে আস্তে তৈরি করা যায় সন্তানকে।

নেটফ্লিক্সে ‘বেবিজ’ নামে একটা সিরিজ আছে। সুইডিশ ফটোজার্নালিস্টের ফটোবুক A Child Is Born বা আমেরিকান লেখক জোয়ানা কোলের When You Were Inside Mommy বই দুটি বাচ্চার সঙ্গে বসে পড়া যেতে পারে। এতে কাজ সহজ হয়ে যাবে।

এ ছাড়া কারও দ্বিতীয় সন্তান গর্ভে এলে ‘তোমার ভাই বা বোন আসছে, সে কেমন আছে, কবে আসবে, কীভাবে আসবে, তোমার দায়িত্ব কী হবে’ ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত আপডেট দেয়া যেতে পারে।

শেষ কথা হলো বাবা-মা হিসেবে নিজেদের জানার পরিধিও বাড়ানো প্রয়োজন। আমাদের নিজেদের যৌনজ্ঞান সঠিক কি না সেটি যাচাই করে নেয়াও জরুরি। আমার ভুলের শিকার যেন আমার সন্তান না হয়। শেখার কোনো বয়স নেই, শেখায় লজ্জাও নেই। সুখী যৌন ও পারিবারিক জীবন উপভোগ করা প্রতিটি মানুষের মানবাধিকারের অন্তর্গত।

রবীন্দ্রনাথ ‘জন্মকথা’ নামের এক কবিতায় একটি উপায় বাতলে দিয়েছেন। একটু বড় বাচ্চার সঙ্গে এটা এস্তেমাল করতে পারেন-

‘খোকা মাকে শুধায় ডেকে-

এলেম আমি কোথা থেকে,

কোন্‌খানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে।

মা শুনে কয় হেসে কেঁদে

খোকারে তার বুক বেঁধে-

ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে।’

সন্তান গর্ভে আসার আগে বাবা-মায়ের ‘ইচ্ছে’ হয়ে মনের মাঝে লুকিয়ে থাকে। সেই ‘ইচ্ছে’র পরিণতিতে নারী-পুরুষের যৌনমিলন এবং তার ফলেই সন্তানের আগমন।

সুতরাং প্রিয় সন্তানকে বলুন, ‘বাজার থেকে কিনে না’, ‘জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে না’, ‘হাসপাতাল থেকে চেয়ে না’; তুমি আমাদের ‘ইচ্ছে’র মধ্যে ছিলে। আমরা ভালোবেসে আদর করে সেই ইচ্ছেকে (মানে তোমাকে) নিয়ে এসেছি এই দুনিয়ায়। তুমি আমাদের দুজনের ভালোবাসার, আদরের আর ইচ্ছের যোগফল।

জিভের আর কানের জড়তা ভাঙুক। চলুন বাচ্চাদের সঙ্গে আমরাও বড় হই।

লেখক: জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর দপ্তরের হিউম্যান রাইটস অফিসার

এ বিভাগের আরো খবর