ভারতীয় উপমহাদেশে তান্ত্রিক যৌনতার ইতিহাস বহু পুরোনো। বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে আধুনিক সময়ে এ ধরনের যৌনাচার নিয়ে বিতর্কের অভাব নেই। আধ্যাত্মিকতার আড়ালে ধর্মগুরু বা তান্ত্রিক সাধকেরা এই যৌনতাকে নিজের উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহার করেন- এমন অভিযোগ অসংখ্য।
এর পরও তান্ত্রিক যৌনতা নিয়ে আগ্রহ আছে অনেকের। পশ্চিমা দেশে এটি নিয়ে গবেষণা-অনুসন্ধান চলছে নিয়মিত। কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সভিত্তিক সাইট ভাইস সম্প্রতি এই তান্ত্রিক যৌনতার বিভিন্ন দিক নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। সেটি অনুবাদ করেছেন রুবাইদ ইফতেখার।
তান্ত্রিক যৌনতার জগতের সঙ্গে প্রেম ভিসমাইয়ের পরিচয় বছর দশেক আগে। ভারতের রহস্যের রাজধানী হিসেবে খ্যাত ঋষিকেষে এক ট্র্যান্স পার্টিতে তিনি প্রথম এ সম্বন্ধে জানতে পারেন। ৪৫ বছরের এ তন্ত্র শিক্ষক বলেন, “ওখানে আমাকে একজন মা আনন্দ সারিতার বই ‘ডিভাইন সেক্সুয়ালিটি: দ্য জয় অফ তন্ত্র’ সম্পর্কে জানান। আমার জন্য ওটাই ছিল টার্নিং পয়েন্ট।”
সে সময়টিতে দ্রুত বীর্যপাত নিয়ে ভিসমাই হতাশায় ভুগছিলেন।
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমার প্রচণ্ড হতাশা ছিল। তবে তন্ত্র চর্চার পর আমি এই সমস্যা কাটিয়ে উঠি এবং নিজের যৌন জীবনকে উপভোগ করতে শুরু করি। তান্ত্রিক যৌনতায় বহুগামিতা ও উদ্দাম অর্জির (সংঘবদ্ধ বুনো যৌনাচার) বিষয়টি থাকলেও এগুলোই শেষ কথা নয়। আদতে এটি নিজের পথ খুঁজে পেতে নিজের ওপরেই ভরসা রাখার অন্যতম উপায়।’
পশ্চিমে অনেকের কাছে ‘তন্ত্র’ শব্দটি ৭-৮ ঘণ্টা অবিরত যৌনাচারের ধারণা তুলে ধরে। তবে এই চর্চা হাজার বছর ধরে হিন্দু ও বৌদ্ধ মতাদর্শে চলে আসছে এবং এর আরও অনেকগুলো দিক রয়েছে।
অক্সফোর্ড রিসার্চ এনসাইক্লোপিডিয়া অফ রিলিজিয়নের মতে, তন্ত্র এমন একটি পদ্ধতি যার মাঝে নানা ধরনের গূঢ়, আধ্যাত্মিক ও যৌন শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত। এতে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের মিশেল রয়েছে এবং আমাদের মুক্তির উপলব্ধি থেকে আনন্দ, হেডোনিজম (আনন্দকে উচ্চমার্গে পৌঁছানো সংক্রান্ত বিদ্যা) ও মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছুর সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। তন্ত্রের বিশাল জগতে যৌনতা একটি বিশেষ অংশ।
৪০ বছর বয়সী তন্ত্র শিক্ষক মোহিনী শ্রীসতীর মতে, প্রচলিত ধারণার বাইরে বেরিয়ে তান্ত্রিক যৌনতাকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘এটা আসলেই জাদুকরী ও পরমাকাঙ্ক্ষিত (এক্সোটিক)। তান্ত্রিক যৌনতা হচ্ছে ধ্যানমূলক যৌনতা। এতে শ্বাস-প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ, বিছানায় নিজের সৃষ্টিশীলতা, শিশুকাল থেকে শিখে আসা যৌনতা ও ধর্মীয় বিষয়গুলো ভুলে যাওয়া এবং নিজের যৌন শক্তিকে ঐশ্বরিক শক্তির সঙ্গে যোগাযোগের একটু মাধ্যম হিসেবে শ্রদ্ধা করার মতো বিষয়গুলোর চর্চা করা হয়।’
মননশীলতার চর্চা থেকে শুরু করে সঙ্গীর সঙ্গে খোলামেলা যোগাযোগের মাধ্যমে ইন্দ্রিয় সম্পর্কে সচেতন হওয়া পর্যন্ত, যৌনতায় ধ্যানশীল, ধীরগতি আনার ধারণাটি তান্ত্রিক যৌনতার কেন্দ্রীয় নীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম।
ভারতীয় উপমহাদেশে তান্ত্রিক যৌনতার ইতিহাস বহু সহস্রাব্দের ও প্রাচীন বৌদ্ধ এবং হিন্দু গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্রিটেনের ইন্ডোলজিস্ট (ভারত বিশেষজ্ঞ) জেফ্রি স্যামুয়েল তার বই ‘অরিজিনস অফ ইয়োগা: ইন্ডিজ রিলিজিয়নস টু দ্য থার্টিন্থ সেঞ্চুরি’তে তান্ত্রিক যৌনতাকে ‘সেক্সুয়াল ইয়োগা’ বলে অভিহিত করেছেন, যা তৃতীয় ও পঞ্চম শতাব্দীতে বহুল প্রচলিত ছিল। হিন্দুদের অন্যতম গ্রন্থ উপনিষদেও এ সম্বন্ধে বলা হয়েছে।
তিব্বতের লামা থুবটেন ইয়েশে তার লেখা ‘ইন্ট্রোডাকশন টু তান্ত্রা: দ্য ট্র্যান্সফরমেশন অফ ডিজায়ার’ বইয়ে বলেছেন, তান্ত্রিক যৌনতার মূল ধারণাটি হলো, ‘আকাঙ্ক্ষাগুলোকে পরিপূর্ণ রূপ দেয়া।’
তার মতে, দ্বিতীয় শতাব্দীতে তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মের অন্তর্ভুক্ত একই ধরনের ভাবনা থেকে এর জন্ম।
ভাইসের প্রতিবেদনে তান্ত্রিক যৌনতার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
নকল গুরু থেকে সাবধান
অন্যান্য রহস্যময় ও উত্তুঙ্গ বিষয়ের মতো তান্ত্রিক যৌনতা নিয়েও ব্যবসার পরিমাণ কম নয়। অনেক ‘গুরু’ আছেন যারা বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত অর্থ হাতাতে আগ্রহী। দিল্লির ৩৯ বছর বয়সী যৌনতার প্রশিক্ষক পল্লভি বার্নওয়াল জানান, তান্ত্রিক যৌনতা শিখতে গিয়ে তিনি প্রায় যৌন হয়রানির মুখে পড়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘খুব জনপ্রিয় একজন গুরু ছিলেন। তিনি প্রথম অনলাইন অডিও সেশনে আমাকে আত্ম-সুখের পদ্ধতি হিসেবে বিশেষ এক ধরনের মাস্টারবেশন শেখাতে চান। কয়েক মিনিট পরই আমার অবস্থা জানতে ক্যামেরা অন করতে বলেন।’
বার্নওয়ালের মতে, ভারতের মতো দেশ যেখানে যৌনতা নিয়ে কথা বলা এখনও সহজ নয়, সেখানে এ ধরনের চর্চার ক্ষেত্রে কারও দুর্বলতার সুযোগ নেয়ার মতো অনেকেই আছেন।
তিনি যোগ করেন, ‘একজন সত্যিকারের গুরু কখনোই আপনাকে নগ্ন হয়ে নিজেকে সমর্পণ করতে বলবে না। তান্ত্রিক যৌনতা বোঝার জন্য কোনো গুরুর শয্যাসঙ্গী হতে হবে না।’
ধীরস্থির ও সৃষ্টিশীল হোন
এক দশক ধরে তান্ত্রিক যৌনতার চর্চা করা শ্রীসতীর মতে, দ্রুত সবকিছু করে আপনাকে অর্গাজম অনুভব করতে হবে- এমন ধারণা তন্ত্রর আদর্শের বিপরীত।
তিনি বলেন, ‘তান্ত্রিক যৌনতায় জোর করে বীর্যপাত বা অনুপ্রবেশের কোনো ধারণা নেই। একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকিয়ে বীর্যপাত না ঘটিয়েই অর্গাজমের অনুভূতি পেতে পারেন। মূল বিষয়টি হচ্ছে শুধু যৌনাঙ্গ দিয়ে নয়, ভিন্ন ভিন্ন অর্গাজমের শীর্ষবিন্দুগুলোকে উপভোগ করা।’
অনেকেই ভাবেন, তান্ত্রিক যৌনতার উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্গাজম দীর্ঘায়িত করা, তবে সেটা ঠিক নয়।
শ্রীসতীর বলেন, ‘তেমন হলে বিষয়টি দাঁড়ায় যে দেরিতে অর্গাজম করানোটাই মূল চ্যালেঞ্জ, আর এই চ্যালেঞ্জে আপনাকে জিততে হবে। সে ক্ষেত্রে আপনার দেহ একেবারে অনমনীয় হয়ে পড়বে।’
ভিসমাইয়ের মতে, যে স্থানে আপনি ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন তাকে ‘শক্তি ও নিরাময়ের ঐশ্বরিক স্থান’ হিসেবে বিবেচনা করাও গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টিকে আরও চটকদার করে তোলার জন্য তিনি পরামর্শ দেন মোমবাতি, ফুল ও হালকা মিউজিক ব্যবহার করতে।
তিনি বলেন, ‘সাদা ও জ্বলজ্বলে লাইট, মোবাইল চার্জার, বিপ করা ঘড়ি বা টাইমার ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। তন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আপনার সমস্ত চেতনাকে যৌনতায় নিয়ে আসা এবং এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের উপদ্রব যেন না আসে।’
সঠিক শক্তি নির্বাচন করা
২৯ বছর বয়সী তন্ত্র শিক্ষক আলেসান্দ্রো দি বেনেদিত্তো বলেন, ‘নিজের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং নিজের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একাত্ম হওয়াটাই তান্ত্রিক যৌনতার মূলমন্ত্র। কারও সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগে আপনার তার সঙ্গে সংযুক্ত হতে হবে। তার চোখের দিকে তাকান, তাকে বোঝার চেষ্টা করুন ও হাত ধরুন।’
কারও সঙ্গে দেখা হওয়ার পর যদি মনে হয় ছন্দ মিলছে না, তাহলে বেনেদেত্তোর পরামর্শ হলো, সময় নষ্ট না করে এগিয়ে যাওয়া।
তিনি বলেন, ‘ওই ব্যক্তি আপনার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করলে এবং একই সঙ্গে অগ্রসর হতে চাইলে আপনি সম্পর্কটি নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে পারেন।’
নিঃশ্বাস ও শব্দ নিয়ে পরীক্ষা করা
তান্ত্রিক যৌনতা শক্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করে। আর তাই শ্রীসতীর পরামর্শ, অভিজ্ঞতার সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য নিঃশ্বাস ও শব্দ নিয়ে খেলতে।
তিনি বলেন, ‘এর অনেক উপায় আছে। কান্না হোক, হাহাকার হোক বা ভিন্ন ভিন্ন পজিশন হোক, নিজেকে ওই মুহূর্তে একেবারে উন্মুক্ত করে দিয়ে অভিজ্ঞতা নিতে হবে। অবস্থান, নিঃশ্বাস ও শব্দ নিয়ে নিরীক্ষা করতে হবে।’
শ্রীসতীর মতে, তান্ত্রিক যৌনতায় শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে নিঃশ্বাস খুব গুরুত্বপূর্ণ এক অস্ত্র।
তিনি বলেন, ‘নারীদের কল্পনা করতে হবে, আপনি আপনার যৌনতার চক্র থেকে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন এবং হৃদয় চক্র দিয়ে তা ছাড়ছেন। পুরুষদের জন্যও ঠিক একই ব্যাপার। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে যৌন শক্তির প্রতিটি ক্ষুদ্রাংশকে আপনার ভেতরে প্রবাহিত করা। আপনার দেহের প্রতিটি বিন্দু ভালোবাসার কাজে নিযুক্ত, আর তাই এটি আপনার পূর্ণ দৈহিক অর্গাজমে সাহায্য করে।’
তান্ত্রিক যৌনতায় বলা হয়ে থাকে, যৌনতা বা পবিত্রতার চক্র নাভির নিচে অবস্থিত, আর হৃদয় চক্র অবস্থিত হৃৎপিণ্ডে। নিজের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসকে এ চক্রগুলোর ভেতরে প্রবেশ করা ও বের হওয়ার কল্পনা আপনার অভিজ্ঞতাকে পূর্ণতা দেবে।
শৈশবের শিক্ষাকে ভুলে যাওয়া
২৮ বছর বয়সী বিজনেস অ্যানালিস্ট আনন্দ কুমার বছর দুয়েক ধরে তান্ত্রিক যৌনতার চর্চা করছেন। তিনি জানান, লজ্জা ও আত্মসম্মান বিষয়ে পাওয়া শৈশবের শিক্ষা ভুলতে গুরুর সঙ্গে তাকে বাড়তি কাজ করতে হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় আমার দেহকে একটা রাজনৈতিক ক্ষেত্র হিসেবে দেখে এসেছি, যার সঙ্গে অসংখ্য শর্ত জড়িত ছিল। আমার দেহের রোমশভাবের কারণে ছোট ভাইবোনেরা আমাকে খ্যাপাত। আমি বহু বছর এ নিয়ে বিরক্ত ছিলাম। তবে তান্ত্রিক যৌনতা আমাকে নিজ দেহকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে।’
শ্রীসতী বলেন, ‘ছোটকালে নিজের যৌনাঙ্গ স্পর্শ করলেও মা-বাবারা লজ্জা দেন। যে কারণে অনেকেই বড় হওয়ার পর মাস্টারবেশন বা আত্ম-সুখের অন্য কোনো প্রক্রিয়ার পরই অপরাধবোধে ভোগেন।’
শ্রীসতীর মতে, তান্ত্রিক যৌনতার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে মানসিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা বিষয়গুলোকে ভুলে যাওয়া।
আসন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা
বার্নওয়াল তান্ত্রিক যৌনতার সময় ‘ইয়াব-ইউম’ আসন পছন্দ করেন। এ অবস্থানে নারী তার সঙ্গীর কোলে বসে পা দিয়ে পুরুষকে শক্তভাবে পদ্মফুলের মতো আঁকড়ে ধরেন। ঐতিহ্যগতভাবে এটাই এ আসনের বর্ণনা, তবে যেকোনো লিঙ্গের সঙ্গীর সঙ্গেই এটি করা যেতে পারে।
বার্নওয়াল বলেন, ‘এ আসনে আপনার সঙ্গীর চক্রের সঙ্গে আপনার চক্র একেবারে মিলে যায়। শারীরিকভাবে আপনারা একে অপরের কপাল, হৃদয় ও যৌনাঙ্গ স্পর্শ করছেন। এ ঘনিষ্ঠ সংযোগ সারা শরীরে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে।’
ভিসমাই যোগ করেন, তান্ত্রিক যৌনতায় কোনো ধরনের ‘অ্যাক্রোবেটিক পজিশন’ নেই। পুরো প্রক্রিয়াটাই নিজের মনের হাত থেকে মুক্ত হয়ে দেহের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার বিষয়।
তিনি বলেন, ‘ওশোকে (বিতর্কিত আধ্যাত্মিক গুরু) এক আলোচনায় বলতে শুনেছি যে শরীর তার পছন্দের অবস্থান নিজেই খুঁজে নেবে। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভালোবাসার মধ্যে শান্তি ও প্রার্থনার ধারণা নিয়ে আসা। এটা এমন কোনো যান্ত্রিক বিষয় নয় যে সবগুলো শর্ত পূরণ করতেই হবে।’