বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

তিন মাস ইন্টারনেট না থাকলে কী হবে?

  •    
  • ২৪ জানুয়ারি, ২০২২ ১৮:১৬

বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে আমরা যেভাবে পড়ি তা অনেকটা বুফে খাওয়ার মতো। প্লেটে প্লেটে নানা সুস্বাদু খাবার, কিন্তু এর কোনোটির স্বাদই আমরা পুরোপুরি নিতে পারি না।

২০১৮ সালের গ্রীষ্মে টানা তিন মাস ইন্টারনেট থেকে দূরে থাকার সংকল্প চেপে বসে ব্রিটিশ লেখক জোহান হ্যারির মনে। নিতান্ত খেয়ালের বশে হলেও এই অভিজ্ঞতা তাকে নতুন এক পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই অভ্যস্ত জীবনে হঠাৎ করে পরিবর্তন নিয়ে এলে মানুষ বেশ কিছু জটিলতার মুখোমুখি হয়। হ্যারির ক্ষেত্রে এই জটিলতা শুরু হয়ে যায় ইন্টারনেট ছেড়ে দেয়ার আগে- সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকেই।

কারণ ইন্টারনেট ফিচারবিহীন একটি মোবাইল ফোন খুঁজে বের করতেই তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। অবশেষে বোস্টনের এক দোকানি তাকে এমন একটি মোবাইল ফোন দেন যাতে ইন্টারনেটের গতি খুবই কম। দোকানি তাকে বললেন, ‘এই মোবাইল দিয়ে আপনি বড়জোর ইমেইল পড়তে পারবেন…।’

এ পর্যন্ত বলতেই হ্যারি দোকানিকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ইমেইল তো ইন্টারনেটেরই অংশ। আমি তিন মাসের জন্য একদম অফলাইনে চলে যেতে চাই।’

হ্যারির পরিকল্পনা শুধু যে দোকানির বুঝতে সমস্যা হয়েছে তা নয়, হ্যারির বন্ধুরাও তাকে নিয়ে শুরুতে বিভ্রান্ত হয়েছেন।

‘চুরি যাওয়া মনোযোগ: কেন আপনি মনোযোগ দিতে পারেন না- এবং কীভাবে আমরা আরও গভীর চিন্তা করতে পারি’ শিরোনামে নতুন একটি বইয়ে হ্যারি এসব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। গত ২৫ জানুয়ারি বইটি প্রকাশিত হয়েছে।

বইয়ে হ্যারি লিখেছেন, ‘শুরুতে আমার পরিকল্পনা অন্যদের কাছে এতটাই উদ্ভট মনে হয়েছিল যে বারবার তাদেরকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে হয়েছে।’

সে যা-ই হোক, কোনো প্রতিবন্ধকতাই হ্যারির পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। কারণ ইন্টারনেটময় জীবন থেকে যেভাবেই হোক কিছুদিনের জন্য তিনি মুক্তি চাইছিলেন।

গবেষণা সংস্থা ডিএসকাউট-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে একজন মানুষ অন্তত ৩ ঘণ্টা ১৫ মিনিট সময় ইন্টারনেটে ব্যয় করেন। আর প্রতিদিন গড়ে আমরা ২ হাজার ৬১৭ বার মোবাইলের টাচস্ক্রিন স্পর্শ করি। এই অবিরাম সংযোগ আমাদের জীবন উন্নত করার বদলে বরং খারাপের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে- এমনটাই মত গবেষকদের।

ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকদের মতে, ইন্টারনেটের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা আমাদের মনোযোগের ব্যাপ্তিকে অনেকাংশে কমিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে বেশির ভাগ মানুষ সর্বোচ্চ দুই মিনিট ১১ সেকেন্ড টানা মনোযোগ ধরে রাখতে পারছেন।

ইমেইল আর মেসেঞ্জারের আওয়াজ কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নোটিফিকেশন আমাদের মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। যে বিষয় থেকে আমরা মনোযোগ হারাচ্ছি সেখানে ফিরে যেতে আমাদের অন্তত গড়ে ২৩ মিনিট সময় লাগছে।

পরিকল্পনা বাস্তবায়নের শুরুতেই ম্যাসাচুসেটসের প্রিন্সটাউনে ছোট্ট একটি আবাস ভাড়া নেন ৪২ বছরের হ্যারি। এই জায়গাটি ছিল একেবারেই সঙ্গীবিহীন। ছিল না কোনো চাকরির যন্ত্রণা কিংবা বাচ্চাকাচ্চাও।

তাই হ্যারির এমন বিচ্ছিন্ন জীবন কারও ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি। শেষ পর্যন্ত তিনি একটি মোবাইল ফোনের খোঁজ পান, যাতে কোনো ধরনের ইন্টারনেট সংযোগ ছিল না। এ ধরনের মোবাইল খুব বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য তৈরি হয়, জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে যেন ব্যবহার করা যায়।

এক বন্ধু হ্যারিকে একটি ল্যাপটপ ধার দিয়েছিলেন, যার মধ্যে কোনো ওয়াইফাই সংযোগ ছিল না। ব্যাপারটা এমন যে, কোনো কারণে রাত ৩টার সময়ে ঘুম ভেঙে গেলে তিনি চাইলেও তখন ইন্টারনেটে প্রবেশ করতে পারবেন না।

তিন মাস ইন্টারনেটবিহীন কাটিয়েছেন ব্রিটিশ লেখক জোহান হ্যারি

ইন্টারনেটবিহীন জীবনের প্রথম সপ্তাহটি হ্যারির খুব বিক্ষিপ্ত আর ধোঁয়াশায় কেটেছিল। এ সময় তিনি মাঝে মাঝে স্থানীয় ক্যাফেতে বসে বই পড়েছেন, কখনও অপরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। আর বেশির ভাগ সময় কেটেছে নিজের চিন্তার ভেতরে ডুব দিয়ে। আরেকটি বিষয় তিনি অনুভব করেছেন তা হলো- নীরবতা! বছরের পর বছর এই নীরবতা তার জীবনে ছিল অনুপস্থিত।

হ্যারির মনে হলো, ইন্টারনেটসহ মোবাইল ফোন আর ল্যাপটপ আনাড়ি বাচ্চাদের মতো, সারাক্ষণ শুধু চিৎকার চেঁচামেচি করে। ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মনে হয়, বাচ্চাগুলোকে একজন প্রতিপালকের দায়িত্বে দেয়া হয়েছে। ফলে তাদের চিৎকার আর বমির দৃশ্য চোখে পড়ছে না।

কিছুটা উদ্বেগও অবশ্য কাজ করছিল হ্যারির মধ্যে। মনে হচ্ছিল, না জানি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইমেইল তিনি মিস করছেন কিংবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ টুইট। কোনো গুরুত্বপূর্ণ লেখা হয়তো তার পড়ার অপেক্ষায় বসে আছে। এমনও কয়েক দিন গেছে, অবচেতনেই পকেটে থাকা মোবাইলে হাত চলে গেছে।

২০২১ সালে পিউ রিসার্চের এক জরিপ অনুযায়ী, আমেরিকার ৩১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিরবচ্ছিন্নভাবে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ২০১৫ সালের জরিপে এই হারটি ছিল ২১ শতাংশ।

মজার ব্যপার হলো, ১৯৮৬ সালে একজন মানুষ টেলিভিশন, রেডিও এবং পড়াশোনার মধ্য দিয়ে এক দিনে গড়ে যে পরিমাণ তথ্যের মুখোমুখি হতেন তা ৪০টি সংবাদপত্রের সমপরিমাণ। তবে ২০০৭ সালের হিসাবে একজন মানুষ গড়ে প্রতিদিন ১৭৪টি পত্রিকার সমান তথ্যের মুখোমুখি হতেন। অর্থাৎ প্রতি আড়াই বছরে দ্বিগুণ পরিমাণ তথ্যের মুখোমুখি হয়েছে মানুষ। চমকপ্রদ এই তথ্যটি ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক মার্টিন হিলবার্টের।

সেই হিসাবে আজকের দিনের মানুষ গড়ে ৭০০ পত্রিকার সমান তথ্যের মুখোমুখি হচ্ছেন প্রতিদিন।

হিলবার্টের মতে, কোনো জৈবিক মস্তিষ্কের জন্য এক দিনে এ পরিমাণ তথ্যের মুখোমুখি হওয়া একটু বেশিই হয়ে যায়। এর ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ শুধু কোনো বিষয়বস্তুর সারমর্মটুকুতে চোখ বুলায়। তথ্যের আধিক্যের জন্যই টুইট করা শিরোনামের ৭০ শতাংশই অপঠিত থেকে যায়। এমনকি যারা এগুলোকে রিটুইট করেন, তারাও ভেতরের খবরটুকু পড়ে দেখেন না।

বর্তমান ইন্টারনেট যুগে আমরা যেভাবে পড়ি তা অনেকটা বুফে খাওয়ার মতো। প্লেটে প্লেটে নানা সুস্বাদু খাবার, কিন্তু এর কোনোটির স্বাদই আমরা পুরোপুরি নিতে পারি না।

এর ফলে মানুষের বই পড়ার অভ্যাসও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। ১৯৯২ সালের হিসাবে শুধু আনন্দের জন্য বছরে অন্তত একটি বই পড়তেন আমেরিকায় এমন মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৬১ শতাংশ। ২০১৭ সালের হিসেবে এই সংখ্যাটি ৫৩ শতাংশে নেমে এসেছে।

তা ছাড়া ২০০৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে আমেরিকানদের প্রাত্যহিক বই পড়ার সময় ২৮ মিনিট থেকে কমে ১৬ মিনিটে এসে ঠেকেছে।

২০১৮ সালের মধ্যে অবসরে গেম খেলা কিংবা কম্পিউটার ব্যবহারের সময় বেড়ে হয়েছে প্রতিদিন প্রায় ২৮ মিনিট।

হ্যারি লিখেছেন, ‘বই পড়া মানুষের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই অভ্যাস মানসিক চাপ কমানোর পাশাপাশি জীবনকেও দীর্ঘায়িত করতে পারে। প্রতিদিন ৩০ মিনিট বই পড়া মানুষের আয়ুষ্কাল অন্তত দুই বছর বাড়িয়ে দিতে সক্ষম।’ তা ছাড়া এই বিষয়টি কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে মনোযোগী হওয়ার প্রশিক্ষণও দেয় মানুষকে।

হ্যারিকে নরওয়ের গবেষক অ্যান ম্যাঙ্গেন বলেছিলেন, ‘টাচস্ক্রিনে আমরা শুধু দেখি আর সারাংশে মনোযোগ দিই। অনেকটা চেরি ফল কুড়ানোর মতো। মানের চেয়ে পরিমাণকেই অগ্রাধিকার দিই।’

ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতার শুরুর দিকেও এ ধরনের মানসিকতায় আটকে ছিলেন হ্যারি। তিনি পাগলের মতো চার্লস ডিকেন্সের বিষয়ে কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই পড়তে শুরু করেছিলেন।

তবে সেই তড়িঘড়ি অবস্থা থেকে হ্যারি শিগগিরই বেরিয়ে আসেন। প্রতিদিন সকালে তিনি তিনটি পত্রিকা কিনতেন এবং পড়তেন। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ জানার জন্য তাকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো।

হ্যারির বিচ্ছিন্ন সময়ে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ডের একটি পত্রিকা অফিসে পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করেন এক বন্দুকধারী। অন্য সময় হলে এই খবরটি সবার আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই পেতেন হ্যারি। বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাটিং করে ঘটনার আদ্যোপান্ত জেনে নিতেন। তবে আলোচিত সেই খবরটি পরদিন সকালে পেয়েছিলেন তিনি।

এ বিষয়ে হ্যারি লিখেছেন, ‘আমার যা জানার প্রয়োজন ছিল তা একটি মৃত গাছে (পত্রিকা) মাত্র ১০ মিনিট পড়েই জেনে গেলাম।’

সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হ্যারির উপলব্ধি হলো, তার জীবনে ইন্টারনেটের প্রয়োজন নেই বললেই চলে। ছয় বন্ধুর নম্বর তার ফোনে সেভ করা ছিল, যাতে জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ করা যায়। আর জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তিনি ৯১১ নম্বরে ফোন করতে পারতেন।

এ ছাড়া কোনো বিষয়ে আগ্রহ হলে তিনি স্থানীয় লাইব্রেরিতে গিয়ে অনুসন্ধান করতেন। পরদিনের আবহাওয়ার খবর জানতে চাইলে তিনি শহরতলিতে আড্ডারত মানুষের কাছেই জেনে নিতেন।

ইন্টারনেট-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় হ্যারি সবচেয়ে বেশি যা মিস করেছেন তা হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

২০১৮ সালে আগস্টের শেষ সপ্তাহে তিন মাসের ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতা শেষ করে আবারও বাকি পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত হন হ্যারি। তিনি ভেবেছিলেন, এ সময়ের মধ্যে তার ইমেইল হয়তো উপচে পড়ছে কিংবা বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতরা তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। যদিও প্রত্যেক ইমেইলের জন্য স্বয়ংক্রিয় একটি উত্তর তিনি সেট করে রেখেছিলেন। যেখানে বলা হয়েছিল, পুরো গ্রীষ্মকাল তিনি যোগাযোগের বাইরে থাকবেন।

যা ভেবেছিলেন, তার কিছুই হয়নি শেষ পর্যন্ত। বলা যায়, ওই সময়টিতে কেউই তার খোঁজ নেননি। ইমেইল আর ইনবক্সে তিন মাসের যত বার্তা ছিল, তা দুয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পড়ে শেষ করে ফেলেন তিনি।

হ্যারি লিখেছেন, ‘পৃথিবী আমার অনুপস্থিতি খুব সহজেই মেনে নিয়েছে!’

ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতার অভিজ্ঞতা নিয়ে আজকের দিনে হ্যারি পুরোপুরি বদলে গেছেন, বিষয়টি এমন নয়। তবে এটা ঠিক, তিনি নিজের মনোযোগকে ইন্টারনেট বিনোদনে ভাসিয়ে দিতে এখন দ্বিতীয়বার ভাবছেন।

এ বিভাগের আরো খবর