টিভিতে সপরিবারে পছন্দের নাটক অথবা খেলা দেখতে বসে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিংবা জন্মনিরোধক পিলের মতো যেকোনো কমার্শিয়াল চলা শুরু হলে রিমোর্ট নিয়ে যুদ্ধ একটা সাধারণ ব্যাপার। কারণ পরিবার নিয়ে আর যাই হোক এসব দেখা সম্ভব না। তবে দুই দিন পর বাচ্চার রুম গোছাতে যেয়ে অশালীন কিছু তোশকের নিচে পেলেই তখন চোখ আকাশে উঠে যায়। প্রশ্ন তখন একটাই, বাচ্চা এসব শিখল কীভাবে! নিশ্চয়ই সঙ্গ খারাপ! এরপর শুরু নানান রকম অযৌক্তিক আচরণ যা কিনা পরিস্থিতিকে হিতে বিপরীত করে তোলে। এ যেন স্বয়ং আগুনে ঘি ঢালছেন।
সব সময় আমাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে বাচ্চাদের যেকোনো যৌনসংক্রান্ত ব্যাপার থেকে দূরে রাখা। হোক সেটা যৌন সচেতনতামূলক ব্যাপার, তবুও না! এর কারণ একটাই, আমরা নিজেরাও ছোটবেলা থেকে ব্যাপারটাকে পজিটিভলি নিতে শিখিনি। কাজেই এখনও পর্যন্ত যৌনসংক্রান্ত যেকোনো বিষয় আমাদের কাছে নিষিদ্ধ বলেই মনে হয়। যেহেতু আমরাও নিজের মা-বাবার কাছে এই শিক্ষাটা পাইনি। তাহলে কোথায় পেয়েছি? কোনো না কোনোভাবে তো জেনেছি? হয়তো বন্ধুবান্ধব নাহয় নানা রকম ক্ষতিকর ভিডিও থেকে যা আমাদের মস্তিষ্কে যৌনতা নিয়ে নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর তথ্যই প্রদান করেছে। তাহলে আপনার বাচ্চা কেন যৌনতা সম্পর্কে বাইরে থেকে জানবে না বলে আপনার ধারণা? বরং এখন চা-মুড়ির মতো অ্যাভেইলেবল ইন্টারনেটের যুগে এগুলো থেকে লুকিয়ে ছাপিয়ে রাখা মানে আপনার বাচ্চাকে নিজ ইচ্ছায় অন্ধকারে ঠেলে দেয়ার মতো হবে। এখন প্রধান প্রশ্ন যেটা মাথায় আসে তা হলো, ‘তাহলে নিজের এতবড় বাচ্চাকে পাশে বসিয়ে এসব নিয়ে আলাপ করব?’
আসলে জরুরি নয় যে কিশোর বয়সেই কেবল যৌন শিক্ষা দিতে হবে। কিশোর বয়সে হুট করে এসব নিয়ে ফ্রি হতে গেলে আপনার এবং আপনার বাচ্চার দুজনেরই অস্বস্তি লাগবে। কাজেই ব্যাপারটা শুরু করতে হবে মস্তিষ্কের উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। অর্থাৎ হাতে খড়ি দিতে হবে অল্প বয়স থেকেই, ঠিক যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেয়ার আগে আমরা বাসায় শিশুদের হাতে খড়ি দিয়ে থাকি সেভাবে। একটা ছোট্ট শিশুর বোঝার ক্যাপাসিটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাকে শিক্ষাগুলো দিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাচ্চাদের দুই থেকে তিন বছরের পর থেকেই আস্তে আস্তে যৌনসংক্রান্ত শিক্ষা দেয়া উচিত। এতে করে ছোট বয়স থেকেই তারা ব্যাপারটাকে পজিটিভলি নিতে পারে। তাদের এটা বোঝাতে হবে যে এটাও আমাদের নিত্যজীবনের বাকি দশটা ব্যাপারের মতোই স্বাভাবিক। যেটা আসলেও স্বাভাবিক, কিন্তু আমরাই শিখিনি স্বাভাবিকভাবে নিতে।
সব বুঝলাম কিন্তু প্রথমে কী দিয়ে এবং কীভাবে শুরু করব?
যৌন শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই বাচ্চাকে শরীরের প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ প্রতিটা অঙ্গের সঠিক নাম জানাতে হবে। বাংলা শব্দ যদি শ্রুতিকটু শোনায় তাহলে ইংরেজিতে শেখানো যেতে পারে। তবে সঠিক শব্দ শেখাতে হবে। এই সময় শরীরের কোন পার্টগুলো আমাদেরকে গোপন করে রাখতে হয় এবং কেন তা বুঝিয়ে বলতে হবে। সঙ্গে ভালো স্পর্শ এবং খারাপ স্পর্শ সম্পর্কেও যথাযথ ধারণা দিতে হবে। যাতে অস্বাভাবিক কোনো আচরণ সে নিজেই বুঝতে পারে এবং তাৎক্ষণিক বাবা অথবা মাকে জানাতে পারে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (BSAF) রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৯ সালে কমপক্ষে ১ হাজার ৩৮৩টি বাচ্চা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। কাজেই ছোট থেকেই যৌন শিক্ষা দেয়া বর্তমানে আবশ্যিক হয়ে উঠেছে।
এরপর কেন ছেলে আর মেয়েদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন সেটার সুন্দর এবং সত্য ব্যাখ্যা দিতে হবে। শেখানোর দরুন যা যা প্রশ্ন করবে প্রতিটা প্রশ্নেরই শালীন এবং সঠিক উত্তর দিতে হবে। যদি কোনো প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে না পারেন তাহলে সময় চেয়ে নিন। একটু গুগল সার্চ করুন, তারপর উত্তর দিন। মনে রাখতে হবে, ওদের কোনো প্রশ্নকেই দমিয়ে রাখা যাবে না। নাহলে পরবর্তীতে প্রশ্নের উত্তরের জন্য অন্য কোনো আশ্রয়স্থল খুঁজবে এবং এটাই সব থেকে বিপজ্জনক।
একটি শিশুর চার-পাঁচ বছরের মধ্যে এই শিক্ষাগুলো আস্তে আস্তে দেয়ার চেষ্টা করতে হবে এবং পরবর্তী সময়ে এভাবেই পিরিয়ডসহ আরো নানা প্রাসঙ্গিক ব্যাপারগুলো বুঝিয়ে বলতে হবে। অবশ্যই প্রত্যেকবার ব্যাখ্যা দেয়ার সময় এটা মাথায় রাখতে হবে যাতে ওদের কাছে জিনিসগুলোর পরিচিতি খুবই স্বাভাবিক হয় এবং শব্দগুলো ওদের বোধগম্য হয়। প্রয়োজনে ইন্টারনেটে প্রাসঙ্গিক নানা ভিডিওর সাহায্য নেয়া যেতে পারে। এই প্রসঙ্গে বাচ্চাদের জন্য অনেক বই আছে সেগুলো একসঙ্গে পড়া যেতে পারে। আসলে এই পুরো ব্যাপারটা দীর্ঘমেয়াদি। হুট করে এক দিনে কিংবা মাসে নির্দিষ্ট এক দিন এটা নিয়ে আলোচনা করলে আশানুরূপ ফল পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। হয়তো রান্নাঘরে রান্নারত অবস্থায় কিংবা কোনো ফ্যামিলি গ্যাদারিংয়ে হুট করে অপ্রস্তুত কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারেন। তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর দেয়া জরুরি নয়। জরুরি হলো পরিস্থিতিটাকে স্বাভাবিক করে নেয়া। আবারো সময় চেয়ে নিন, মানুষ প্রশ্নবোধক চাউনি নিয়ে আপনার দিকে তাকালে বাচ্চার আড়ালে তাদের বোঝান আপনি কী দারুণ প্যারেন্টিং করছেন। আপনাকে দেখে তারাও উৎসাহিত হতে পারেন কিংবা বিব্রতও হতে পারেন। তবুও নিজেকে এবং পরিস্থিতিকে সামলে নেয়া আপনার দায়িত্ব। কারণ আপনার বাচ্চার সঙ্গে খুব সেনসেটিভ একটা বিষয় নিয়ে আলোচনায় গিয়েছেন, হরেক রকম প্রশ্ন থাকবেই। এর মধ্যে সব গুরুদায়িত্ব আপনার, খুব খেয়াল দিয়ে তাদের জিনিসগুলো জানাতে হবে যাতে যৌনতাকে কোনোভাবে ভুলেও উসকে না দেয়া হয়।
যখন আপনার বাচ্চা যৌনসংক্রান্ত বিষয়গুলোকে নিত্যদিনের সঙ্গে একদম ডাল-ভাতের মতো বুঝে নেবে, তখন তাকে প্রশ্ন করুন। তার জানার পরিধি বুঝুন। তার কী ধারণা বাচ্চারা পৃথিবীতে কীভাবে আসে। তার জ্ঞানের পরিধি অনুযায়ী আবার তাকে কারেকশন করে দিন। ভিডিও দেখান এবং আপনার মতামত বলুন, আপনার বাচ্চারও মতামত গ্রহণ করুন। খোলামেলা আলোচনাকে সব সময়ই প্রাধান্য দেয়া হয়। এতে করে আপনার বাচ্চার মধ্যে নতুন বিষয়কে গ্রহণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। আস্তে আস্তে দেখবেন কত সহজেই আপনার বাচ্চা যৌনসংক্রান্ত যে বিষয় যা আমাদের কাছে এখনও শ্রুতিকটু, তা কি সুন্দর আর সাবলীল করে গ্রহণ করে নেয়। প্রয়োজন শুধু একটু ধৈর্য আর মানসিক পরিবর্তনের।
সবশেষে এতটুক মাথায় রাখবেন, যৌন শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে ছেলে বা মেয়ে আলাদা কোনো বিষয় নয়। দুজনকেই একইভাবে বোঝানো প্রয়োজন। একজন ছেলে যখন তার মায়ের কাছ থেকে পিরিয়ড সম্পর্কে জানবে তখন স্বাভাবিকভাবেই রাস্তায় অন্য কোনো মেয়েকে অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখলে সম্মানের সঙ্গে সাহায্য করবে। কারণ সে জানবে এটা একদম নিত্য একটা ব্যাপার। সুস্থ সমাজের জন্য অবশ্যই একটা সুস্থ পারিবারিক পরিবেশ প্রয়োজন। বাবা-মায়ের চিন্তাভাবনার সামান্য পরিবর্তনই কিন্তু সমাজের বড় রকম পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট। হোক সেটা ভালো কিংবা খারাপ। নতুন প্রজন্মের গুরুদায়িত্ব সফলভাবে পালন করলেই একটা সুস্থ সমাজ এবং একটা সুরক্ষিত দেশ কামনা করা সম্ভব।