গুগল এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার ব্যাপারে জানে না, পৃথিবীতে এমন মানুষ বিরল। আজকাল তো গুগল ছাড়া কোনো কাজই চলে না। গুগল সার্চ, জিমেইল, গুগল আর্থ, গুগল ম্যাপ, ইউটিউব, গুগল ড্রাইভসহ গুগলের আরও অনেক সেবার সঙ্গে আমরা নির্ভরশীল। গুগল পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের জীবন আরও সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তুলেছে।
সেই গুগলে কাজ করা কর্মীদের জীবন কেমন বা কতটুকু স্বাছন্দ্যময়?
পার্ক আপ ডট কমের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কিছু চমৎকার তথ্য। যেখানে দেখা যায় গুগলে কাজ করা কর্মীদের অবিশ্বাস্য সব সুযোগ-সুবিধার কথা। এ নিয়ে আজকের আয়োজন-
বলা হয়, কর্মীদের পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধাদানকারী প্রতিষ্ঠান হলো গুগল। এই ধারণাটিকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। অনেকের মতে, কর্মীদের দৈনন্দিন জীবনকে সবার থেকে আলাদা ও স্বাছন্দ্যময় করে তোলার ব্যাপারটি গুগলের সফলতার পেছনে একটি বিশেষ কৌশল হিসেবেও কাজ করেছে।
পৃথিবীর অন্যতম বড় ও সফল এই প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য হলো নিয়ম-শৃঙ্খলা, অনন্য কর্মপরিবেশ এবং দারুণ সব সুবিধাদি দিয়ে কর্মীদের জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে আরামদায়ক ও ইতিবাচক জায়গা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
গুগলে কাজ করা কর্মীদের একটি পরিচিত ডাকনাম হলো গুগলার্স। টেক জায়ান্ট বলে খ্যাত এই প্রতিষ্ঠানটি সবচেয়ে মেধাবী মানুষগুলোকে নিজেদের কর্মী বানাতে সদা তৎপর। এই মেধাবীদের কাজের উপযোগী করে তুলতে সর্বাধুনিক কর্মপরিবেশ গড়ে তুলেছে গুগল। মনে করা হয়, এতে প্রতিষ্ঠানেরই লাভ। গুগল বিশ্বাস করে, কর্মীদের পরিতৃপ্তির ভেতরেই অনেকাংশে প্রতিষ্ঠানের সফলতা নির্ভর করে।
প্রথমেই বলা যাক তাদের স্বাস্থ্য-সুবিধার কথা। কাজে যোগ দেয়ার পর প্রথমেই গুগল কর্মীদের ইনস্যুরেন্সের ব্যবস্থা করে। একজন মানুষের যে কোনো শারীরিক সমস্যারই নিশ্চয়তা দেয় এই ইন্স্যুরেন্স। সুবিধাটি শুধু কর্মীরাই নয়, তাদের পরিবারের সব সদস্যের জন্যও প্রযোজ্য। সাধারণ চিকিৎসা খরচের কথা চিন্তা করে যে কোনো পদমর্যাদার কর্মীকে প্রতিবছর আলাদা করে ১ হাজার ডলারও প্রদান করে গুগল। এমনকি সে পার্টটাইম কর্মী হলেও। এ ছাড়া তাৎক্ষণিক বিপদ এড়াতে গুগলের নিজস্ব মেডিক্যাল স্টাফ তো রয়েছেই।
কর্মীদের কাজ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যাপারে আরও দক্ষ ও কর্মপটু করে তুলতে গুগল নানা রকম শিক্ষা-কার্যক্রমের ব্যবস্থা করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কর্মঘণ্টার ২০ ভাগ সময় গুগলার্সরা নিজেদের আগ্রহের বিষয় বা কাজ নিয়ে নানা রকম গবেষণা ও পড়াশোনার কাজে ব্যয় করতে পারে। লার্নিং ল্যাঙ্গুয়েজ বা কোডিংসহ অন্যান্য পড়াশোনার কাজে যদি কোনো কর্মী কোথাও ভর্তি হয়, তবে সেই কর্মীকে বার্ষিক ১২ হাজার ডলার টিউশন ভাতা দেয়া হয়। বিভিন্ন বিভাগে বিশ্বসেরা ব্যক্তিদের এনে সেমিনারের আয়োজন করে প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যে কোনো কর্মী সামাজিক কাজ এবং রাজনীতিও করতে পারেন।
গুগলের আরেকটি অন্যতম সুবিধা হলো- মাতৃত্বকালীন ছুটি। যদি দেখা যায় কোনো কর্মী বা কর্মীর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, এ ক্ষেত্রে গুগলের পক্ষ থেকে পুরুষকে ৬ সপ্তাহ এবং নারীকে ১৮ সপ্তাহের ছুটি দেয়া হয়। এ সময় তাদের সাধারণ আর্থিক সুযোগ-সুবিধা চলমান থাকে।
এ ছাড়া অন্যসব ছুটি বা অসুস্থতার কারণে অফিস করতে না পারলেও বেতন অনুযায়ী গুগলার্সরা অর্থ পেতে থাকে। এ ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়- তারা কোন পদে কর্মরত, সাধারণত সপ্তাহে কয় ঘণ্টা কাজ করে এবং কদিন যাবৎ প্রতিষ্ঠানের কর্মী হিসেবে নিয়োজিত আছে সেসব।
যদি কোনো কর্মী কাজ ছেড়ে চলেও যায়, তখনও সে এককালীন একটা অর্থ পেয়ে থাকে। গুগল কর্মীদের কাজ করার পরিবেশকে এতটাই আরামদায়ক করে দিয়েছে যে কর্মীরা প্রতি সপ্তাহেই নির্দিষ্ট দুটি দিন ওয়ার্ক ফ্রম হোম বা ঘরে বসে কাজের সুবিধা পেয়ে থাকেন। এমনকি বছরে চার সপ্তাহ যেকোনো জায়গায় থেকে অফিশিয়াল কাজ করতে পারেন।
খাবার-দাবারের ক্ষেত্রেও গুগলের কর্মীরা অন্যান্য জায়গা থেকে অনেক বাড়তি সুবিধা পায় প্রতিষ্ঠানটিতে। এটি গুগলের সবচেয়ে জনপ্রিয় সুবিধাগুলোর মধ্যে অন্যতম। যেমন- প্রতিদিন দুপুরের খাবার খেতে কর্মীদের বাড়তি কোনো খরচ বা ঝামেলা পোহাতে হয় না। সবার জন্য রয়েছে ফ্রি লাঞ্চের ব্যবস্থা।
গুগলের নিজস্ব রেস্টুরেন্ট, ক্যাফেসহ বিভিন্ন খাবারের বুথ রয়েছে। গুগলার্সরা এসব জায়গা থেকে বিনা মূল্যে খাবার খেতে পারেন। মজার ব্যাপার হলো প্রত্যেক কর্মীর ২০০ মিটারের মধ্যে নানা রকম খাবারের ব্যবস্থা থাকে। যাতে কোনো কর্মীকে ক্ষুধাপেটে কাজ না করতে হয়। আর যদি এসব খাবার পর্যাপ্ত না হয়? সে কথা চিন্তা করে গুগলার্সদের রান্নাও শেখানো হয়ে থাকে। কেউ চাইলে নিজেই যে কোনো খাবার রান্না করে খেতে পারবে।
গুগলার্সদের ফিটনেস নিয়েও গুগলের ভাবনার অন্ত নেই। প্রতিটি অফিসের পাশেই রয়েছে ফিটনেস সেন্টার বা জিম। এই জিমগুলোতে উপযুক্ত সময় অনুযায়ী কর্মীরা গিয়ে শরীরচর্চা করতে পারে। প্রতিটি কর্মীর মেম্বারশিপ ফি গুগলের পক্ষ থেকে বহন করা হয়।
শুধু শারীরিকই নয়, কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও গুগল যথেষ্ট সচেতন। প্রতিষ্ঠানটি কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামের আয়োজন করে থাকে। তাদের জন্য মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বিভিন্ন সেমিনার এবং কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া যেসব কর্মী মানসিক সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য বিভিন্ন মেন্টাল হেলথ বিষয়ক অ্যাপে ফ্রি অ্যাকসেস দেয়া থাকে। তারা চাইলেই এসব অ্যাপ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণ করতে পারেন। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বর্তমান সময় বিবেচনায় এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, গুগল কর্মীদের লন্ড্রি সুবিধা পর্যন্ত দেয়। তারা মনে করে, সারা দিনের পরিশ্রম শেষে কর্মীরা নিশ্চয়ই ক্লান্ত থাকবে। যাতে বাসায় ফিরে আর কাপড় ধোয়ার ঝামেলা না পোহাতে হয়, সেদিকেও তাদের খেয়াল থাকে। এমনকি গুগলার্সদের জন্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই চুল কাটার ব্যবস্থাও করা হয়। কারণ প্রতিষ্ঠানটি মনে করে অন্য কোথাও চুল কাটতে যে বাড়তি সময়টি নষ্ট হয় সেটি কর্মীরা উৎপাদনশীল কাজে ব্যয় করতে পারবেন। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো- এসবের জন্য কোনো বাড়তি খরচ গুনতে হয় গুগলার্সদের।
কর্মীরা চাইলেই কাজের ফাঁকে গেম খেলা এবং সিনেমা দেখার মতো বিনোদনমূলক কাজেও নিজেদের সময় কাটাতে পারেন। এসব ব্যবস্থার কারণ হলো গুগলার্সদের মানসিকভাবে প্রফুল্ল রাখা। যাতে তারা কোনোভাবেই ক্লান্তি অনুভব না করে। গুগলের লক্ষ্য হলো প্রতিদিন কর্মীরা যেন হাসিমুখে অফিসে আসতে পারেন এবং সম্পূর্ণ দুশ্চিন্তামুক্তভাবে নিজেদের কাজে মনোযোগ দিতে পারেন।
এসবের জন্যই গুগল বর্তমানে পৃথিবীর বড় বড় টেক জায়ান্টদের পেছনে ফেলে সবচেয়ে উত্তম কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছে। বড় বড় কোম্পানিগুলো এ বিষয়ে গুগলকে নিজেদের আদর্শ মনে করে।