কোভিডের জন্য দায়ী করোনাভাইরাস সার্স কভ টু-এর নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ নিয়ে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে।
আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণের দেশ বতসোয়ানায় প্রথম শনাক্ত হওয়া এই ভ্যারিয়েন্টের শুরুতে নাম ছিল ‘বি.১.১.৫২৯’, তবে শুক্রবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর নাম দেয় ‘ওমিক্রন’।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্পাইক প্রোটিনে ৩০ বারের বেশি মিউটেশনের মধ্যে দিয়ে সার্স কভ টু ভাইরাসের নতুন ধরনটি তৈরি হয়েছে। সামগ্রিকভাবে এই ধরনটির মিউটেশন হয়েছে ৫০ বারের বেশি।
অত্যন্ত সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়েও ওমিক্রনের মিউটেশন হয়েছে চার গুণ বেশি। ফলে এটি দ্রুত মানুষকে আক্রান্ত করতে সক্ষম বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
তবে একই সঙ্গে তারা বলছেন, ভাইরাস দ্রুত সংক্রমিত হওয়া মানেই সেটি অন্য ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় বেশি প্রাণঘাতী- এমনটি বলার সময় এখনও আসেনি। ‘ওমিক্রন’ নিয়ে গবেষণা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
নতুন ধরনটি নিয়ে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। এর ভিত্তিতে ওমিক্রন নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব খুঁজেছে নিউজবাংলা।
নতুন ধরনটি কোথায়, কীভাবে প্রথম শনাক্ত হলো?
আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানায় ১১ নভেম্বর প্রথম ‘বি.১.১.৫২৯’ ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হয়, যাকে এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ওমিক্রন’ বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। করোনার নতুন এই ধরনটি এরই মধ্যে সাউথ আফ্রিকাতেও শনাক্ত হয়েছে। দেশটির জোহানেসবার্গ ও প্রিটোরিয়াতে এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১২০০।
মিশর থেকে বেলজিয়াম ভ্রমণে যাওয়া একজনের দেহেও করোনার এই ধরনটি শনাক্ত হয়েছে। ইউরোপে বেলজিয়ামই প্রথম দেশ, যেখানে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে।
সাউথ আফ্রিকা থেকে হংকং ভ্রমণে আসা এক ব্যক্তির দেহেও শনাক্ত হয়েছে ওমিক্রন। এ ছাড়া মালাউয়ি থেকে ইসরায়েলে যাওয়া একজনের দেহে পাওয়া গেছে এই ভ্যারিয়েন্টের ভাইরাস। আরও দুজনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
ডাচ সরকার শুক্রবার সাউথ আফ্রিকার সঙ্গে বিমান যোগাযোগে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর দেশটি থেকে দুটি ফ্লাইটে আমস্টারডাম পৌঁছানো কয়েক শ যাত্রী করোনা পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষায় বিমানবন্দরে আটকে পড়েছেন।
নতুন ধরনটি কতটা বিপজ্জনক?
সার্স কভ টু ভাইরাসের নতুন ধরনটি নিয়ে গবেষকদের উদ্বেগের মূল কারণ, এর অনেকবারের মিউটেশন। মিউটেশন হলো এমন এক অভিযোজন কৌশল যার মাধ্যমে ভাইরাস বিরূপ বা নতুন পরিস্থিতিতেও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে।
বিজ্ঞানীরা ওমিক্রনের স্পাইক প্রোটিনে ৩২টি মিউটেশন খুঁজে পেয়েছেন। অন্যদিকে অত্যন্ত সংক্রামক হিসেবে বিবেচিত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে মিউটেশন হয়েছে মাত্র আটবার।
স্পাইক প্রোটিনের বেশি মিউটেশন মানেই ভাইরাসটি বেশি প্রাণঘাতী, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, বহুবার মিউটেশনের কারণে ওমিক্রনের সঙ্গে মানুষের দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থার (ইমিউনিটি সিস্টেম) লড়াই করা কঠিন হতে পারে।
ওমিক্রনের স্পাইক প্রোটিন প্রচলিত করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের তুলনায় অনেকটা বদলে যাওয়ায় দেহের ইমিউনিটি সিস্টেম দ্রুত একে শনাক্ত করতে পারে না, ফলে এটি সংক্রমণের হার বাড়াতে পারে। যেকোনো করোনাভাইরাস এদের স্পাইকের সাহায্যেই শ্বাসতন্ত্রের কোষে যুক্ত হয়ে কোষের ভেতরে প্রবেশ করে।
প্রাথমিক গবেষণা অনুসারে, নতুন ভ্যারিয়েন্টটি টিকার কার্যক্ষমতা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে সক্ষম।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টের দুটি মিউটেশন- আর ২০৩কে এবং জি ২০৪আর ভাইরাসটির দ্রুত প্রতিলিপি তৈরি করতে সক্ষম। এ ছাড়া তিনটি মিউটেশন- এইচ৬৫৫ওয়াই, এন ৬৭৯কে এবং পি ৬৮১এইচ ভাইরাসটিকে আরও সহজে মানব কোষে প্রবেশে সাহায্য করে। তারা বলছেন, শেষ দুটি মিউটেশনের একসঙ্গে উপস্থিতি বিরল ঘটনা এবং এর ফলে ওমিক্রন টিকা প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে।
অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার ইনস্টিটিউট অফ মলিকুলার বায়োটেকনোলজির আণবিক জীববিজ্ঞানী ডা. উলরিচ এলিংয়ের মতে, প্রাথমিক লক্ষণ থেকে মনে হচ্ছে করোনার নতুন রূপটি ডেল্টার চেয়ে ৫০০ শতাংশ বেশি সংক্রামক হতে পারে।
অবশ্য নতুন ভ্যারিয়েন্টটি সার্স কভ টুর আগের ধরনগুলোর তুলনায় বেশি প্রাণঘাতী- এমন কোনো প্রমাণ এখনও মেলেনি। তবে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সক্ষমতার কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নতুন করে চাপে ফেলতে পারে।
নতুন ধরনটি কীভাবে তৈরি হলো?
ওমিক্রনের একসঙ্গে এত বেশি মিউটেশন নিয়ে বিস্মিত বিজ্ঞানীরা। কেউ কেউ বলছেন, কোভিড আক্রান্ত কোনো রোগীর বিশেষ শারীরিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ভাইরাসটির একসঙ্গে এত মিউটেশন ঘটতে পারে।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের কম্পিউটেশনাল বায়োলজি সিস্টেম বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ফ্রাঁসোয়া ব্যালোক্স মনে করেন, এমনটি হতে পারে, ভাইরাসটি বিশেষ কোনো ব্যক্তির দেহে দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের সুযোগ পেয়েছিল। ওই ব্যক্তি হয়তো এইচআইভি/এইডসে আক্রান্ত ছিলেন এবং চিকিৎসা না করানোর কারণে তার ইমিউন সিস্টেম বেশ দুর্বল ছিল। তবে বিষয়টি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ বিশেষজ্ঞদের হাতে নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিক্রিয়া কী?
সার্স কভ টু-এর নতুন ধরনটি কতটা সংক্রামক বা বিপজ্জনক, সেটি সুনিশ্চিতভাবে বলার মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত এখনও বিজ্ঞানীদের কাছে নেই। বিষয়টি নিয়ে শুক্রবার জরুরি বৈঠক করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
ওই বৈঠকে ‘বি.১.১.৫২৯’ ভ্যারিয়েন্টকে ‘উদ্বেগজনক ধরন’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করে ডাব্লিউএইচও। এ ছাড়া গ্রিক বর্ণমালার ওপর ভিত্তি করে এর নাম দেয়া হয় ‘ওমিক্রন’, যেমন এর আগে ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ নামকরণ হয়েছিল।
বেটা ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে নতুন ধরনটির কি কোনো সংযোগ আছে?
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পুরো আফ্রিকা মহাদেশ, বিশেষ করে সাউথ আফ্রিকাকে বিপর্যস্ত করেছে। দেশটিতে এরই মধ্যে ৩০ লাখ মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন, এর মধ্যে মারা গেছেন প্রায় ৯০ হাজার মানুষ।
সাউথ আফ্রিকায় কোভিডে মৃত্যুর উচ্চ সংখ্যার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় সি.১.২ বা বেটা ভ্যারিয়েন্টকে। সি.১.২ ভ্যারিয়েন্ট অত্যন্ত সংক্রামক এবং টিকাকে অনেকটা অকার্যকর করতে সক্ষম বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে ‘উদ্বেগজনক ধরন’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে।
তবে এরপর বেটার চেয়েও বেশি সংক্রামক হিসেবে এসেছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। এটি সারা বিশ্বের পাশাপাশি সাউথ আফ্রিকাতেও বেটার চেয়ে বেশি সংক্রমণ ঘটিয়েছে।
ওমিক্রনের বিস্তার কি রোধ করা সম্ভব?
বাস্তবে সীমান্ত আটকে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকানো প্রায় অসম্ভব। তবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে বিস্তারের গতি ধীর করা যেতে পারে। হংকং ও ইসরায়েলে যে দুজনের দেহে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে তারা সাউথ আফ্রিকা থেকে এসেছিলেন। এ কারণে অনেক দেশ সাউথ আফ্রিকাসহ আফ্রিকার বেশ কিছু অঞ্চলের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ সদস্য দেশ শুক্রবার সাউথ আফ্রিকাসহ আফ্রিকার দক্ষিণের সাতটি দেশ থেকে ইউরোপে সাময়িক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিতে সম্মত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সোমবার থেকে সাউথ আফ্রিকা এবং অন্য সাতটি দেশ থেকে আমেরিকান নন, এমন নাগরিকদের ভ্রমণ সীমিত করেছে।
এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা ভাইরাসের নতুন ধরনটির বিস্তার ধীর করতে সাহায্য করতে পারে। তবে মনে রাখা দরকার, বতসোয়ানায় ওমিক্রনের সংক্রমণ ধরা পড়ে নভেম্বরের মাঝামাঝিতে। এরপর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। ফলে এখন ফ্লাইট বন্ধ করলেও ধরে নেয়া যায়, ওমিক্রন এতদিনে আর আফ্রিকার সীমানায় আটকে নেই।