জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী হিসেবে কনডমের জনপ্রিয়তা পৃথিবীব্যাপী হলেও বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের কারণে এর স্বাস্থ্যঝুঁকিও রয়েছে। কনডমের পাশাপাশি আরও বেশকিছু যৌনসামগ্রীতে শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হন নারীরা। এমন অবস্থায় অনেক দেশেই জনপ্রিয় হচ্ছে অর্গানিক পণ্য। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এর ব্যবহার বাড়ছে। এমনকি সামাজিক ট্যাবু ও সমালোচনা উপেক্ষা করে অর্গানিক যৌনপণ্য উৎপাদক হিসেবে এগিয়ে আসছেন নারীরাও। কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ভিত্তিক সাইট ভাইস ভারতের তিন নারী উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে বিশ্লেষণ করেছে নারীদের জন্য বিশেষায়িত যৌন সুরক্ষা সামগ্রীর চাহিদা, ব্যবহার ও উপকারিতার বিভিন্ন দিক। প্রতিবেদনটি অবলম্বনে লিখেছেন রুবাইদ ইফতেখার।
কোমাল বালদওয়া বহুবার বাজারে প্রচলিত কনডম ব্যবহার করেছেন। তবে ব্যবহারের পরের ব্যথাটি তাকে স্বামীর সঙ্গে সময় কাটানো অন্তরঙ্গ মুহূর্তটিকে ভুলিয়ে দেয়।
৩৯ বছর বয়সী কোমাল বলেন, ‘সন্তান নেয়ার পরিকল্পনা করার সময় আমার স্বামী কনডম ব্যবহার করতেন না, তখন সব ঠিকঠাক থাকত। তবে এর আগে-পরের সময়গুলোতে কনডম ব্যবহারের পর যৌনাঙ্গে ব্যথা ও জ্বলুনি আমার পাগল করে তুলত।’
ভারতের হায়দরাবাদ শহরের বাসিন্দা ও দুই সন্তানের জননী কোমাল বাজারে সহজলভ্য কনডম সব শেষ ব্যবহার করেছেন অনেকদিন আগে। তবে এখনও ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোর শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে যৌনাঙ্গে চুলকানি, শুষ্কতা ও মূত্রনালীতে সংক্রমণ।
এসব জটিলতা নিয়ে কোমাল গাইনোকলজিস্ট ও চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়েছেন। তবে তাদের পরামর্শগুলো ছিল আপত্তিকর।
কোমাল বালদওয়া ভারতে প্রথম নারী হিসেবে অর্গানিক কনডম কোম্পানি গড়ে তুলেছেন
কোমাল বলেন, ‘আমাদের এক পারিবারিক চিকিৎসক এতোটা রক্ষণশীল ভাবে বিষয়টা দেখছিলেন যে, আমি তার কাছে যাওয়া বন্ধ করে দেই। একজন আমাকে এও বলেছেন, আমি আরেক শহর থেকে আসার কারণে নাকি বাবা-মাকে মিস করছি। আরেকজন আমাকে বলেছেন, আমার হেলুসিনেশন হচ্ছে, ব্যথাটি আসলে আমার মাথায়। অনেকে কনডম নিয়ে কথা বলতেই চাচ্ছিলেন না। তারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বা আরও সন্তান নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছিলেন।’
এটা ২০১৫ সালের কথা। চিকিৎসকদের অবজ্ঞার মুখে পড়া কোমাল এরপর পড়াশোনা করে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্গানিক কনডমের কথা জানতে পারেন।
তিনি বলেন, ‘আমি জানতে পারি, পাঁচ মিনিটের অতিরিক্ত আনন্দের জন্য আমাদের দেহে কেমিক্যাল প্রবেশ করানোর কোনো দরকার নেই।’
কোমাল এরপর ২০১৯ সালে ভারতে প্রথম পুরুষের জন্য ‘ব্লু’ নামের অর্গানিক কনডম তৈরি শুরু করেন।
প্রচলিত কনডম ব্যবহারের কারণে ভারতে কত নারী অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হন তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই, তবে কোমালের মতো অসংখ্য নারীর অভিজ্ঞতা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে আছে। পুরুষদের ক্ষেত্রেও কনডম ব্যবহারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে। এর ফলে ডার্মাটাইটিস (চর্মরোগ) এমনকি গ্যাংগ্রিন বা পুরুষাঙ্গে পচনও ধরতে পারে।
ভারতের মতো একটি দেশ মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা তেমন নেই। এমন একটি দেশে কোমালের একটি কনডম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি অনেকের কাছেই ছিল চমক, বিশেষ করে তার কাছের মানুষের জন্য।
তিনি বলেন, ‘সবাই অস্বস্তিতে ছিলেন। সবাই আমাকে সমাজকে উচ্ছন্নে নেয়ার জন্য দায়ী ভাবছিল, কিন্তু আমি পিছু হটিনি।’
কনডমের ইতিহাস বেশ আকর্ষণীয়, তবে সমস্যা জর্জরিত। পাঁচ হাজার বছর আগে ক্রিটের রাজা মিনোসকে ধরা হয় কনডমের প্রথম ব্যবহারকারী। কথিত আছে, তার কনডমটি এতোটাই বিষাক্ত ছিল যে এর কারণে তার অনেক উপপত্নী মারা যান। পরে দেখা যায়, দোষটি ক্রিটের নয়, বরং ছাগলের মূত্রনালীতে তৈরি কনডমের কারণেই এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
কনডম প্রযুক্তি এখন অনেক উন্নত। বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার কোটি আধুনিক কনডম বিক্রি হয়েছে। এর কারণে সামাল দেয়া গেছে এইডসের মতো অনেক যৌন রোগের মহামারি।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতে, কনডমকে সাধারণত সরকারি পরিবার পরিকল্পনার সঙ্গে বা বাণিজ্যিকভাবে আনন্দদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাণিজ্যিক পর্যায়ে এর প্রচারের ক্ষেত্রে অনেকটা পর্নো সিনেমার মতো বানানো বিজ্ঞাপন চিত্রের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
ব্যবহার বাড়ানোর প্রচার চললেও, ভারতে এখনও কনডমের ব্যবহার ভয়াবহ মাত্রায় কম। মাত্র ৫.৬ শতাংশ মানুষ এটি ব্যবহার করেন। চলতি বছরের শুরুতে করা ভারতের প্রথম কনডমোলজি রিপোর্টে দেখা গেছে, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৮০ শতাংশ পুরুষ শেষবার তাদের সঙ্গীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কের সময় কোনো ধরনের জন্মনিরোধক ব্যবহার করেননি।
বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে মাত্র সাত শতাংশ নারী ও ২৭ শতাংশ পুরুষ কনডম ব্যবহার করেছেন। নারীদের তিন শতাংশ ও পুরুষের ১৩ শতাংশ সবসময়ই কনডম ব্যবহার করেন।
ভারতে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ ও যৌন পরিবাহী সংক্রমণের হার অনেক বেশি। কনডমোলজি রিপোর্টে দেখা গেছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ পণ্য কেনা ও ব্যবহার করার প্রধান বাধা হলো অ-বৈবাহিক পরিস্থিতিতে যৌনতা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এবং সামাজিক রক্ষণশীলতা।
আরেকটি গবেষণায় দেখে গেছে, বিশ্বের ৭৭০ কোটি জনসংখ্যার ৪.৩ শতাংশের রাবারজাতীয় পদার্থে অ্যালার্জি আছে। এমন প্রেক্ষাপটে, কনডমের ব্যবহারজনিত স্বাস্থ্যগত জটিলতা, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব বিভিন্ন দেশে আলোচিত হচ্ছে।
কোমাল বালদওয়া ২০১৯ সালে ভারতে এই খাতে একজন পথিকৃত হয়ে ওঠেন। তিনি শুধু নারী স্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করার বিষয় তুলে ধরেননি, একইসঙ্গে পুরুষ-শাসিত এই খাতে নারীর জন্য বাধাও ভেঙে দিতে চেয়েছেন।
কোমাল বলেন, ‘আমি দেশের সব কনডম প্রস্তুতকারকের কাছে গিয়েছি। তারা বিষয়টি নিয়ে একেবারেই স্বস্তিতে ছিলেন না। আমাকে তারা বলেছেন, এই পণ্যটি আমার জন্য নয় এবং এই শিল্পে নারীদের কোনো জায়গা নেই।’
তবে তিনি শেষ পর্যন্ত এক প্রস্তুতকারক খুঁজে পান, যারা তাকে সাহায্য করতে রাজি হয়। তারপর থেকে এগিয়ে যাচ্ছেন কোমাল, তার কোম্পানির গ্রাহক এখন প্রায় ৩০ হাজার।
তবে কোমালের এই বিপ্লব ভারতে ১ হাজার ৫২১ কোটি রুপির (প্রায় ১ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা) কনডম শিল্পের সাগরে এক ফোঁটা জলের মতো। তিনি শুরু করার পর আরও অনেকে চেষ্টা করছেন এবং সফলতার মুখও দেখছেন।
নয়া দিল্লির কনজিউমার সাইকোলজি ও আইনের পড়াশোনা করা অরুনা চাওলা কয়েক মাস আগে অর্গানিক কনডম কোম্পানি ‘সালাদ’ চালু করেন। শুধু স্বাস্থ্যগত কারণ নয়, চাওলার এই উদ্যোগে যুক্ত হওয়ার প্রধান কারণগুলোর একটি হল, বেশিরভাগ নারী কনডম কেনেন না।
২৬ বছর বয়সী চাওলা বলেন, ‘আমার মা কখনও কেনেননি। আমার পরিবারের কোনো নারী কখনও কেনেননি।’
তিনি বলেন, “কনডমের বাণিজ্যিকীকরণের পুরোটাই আনন্দদানকে ঘিরে। বিজ্ঞাপনগুলো মজার ও বুদ্ধিদীপ্ত হলেও এগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি এখনও পুরুষের ‘শক্তিমানতাকেন্দ্রিক’। কনডমকে এখানে জরুরি বা গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হিসেবে দেখা হয় না। এটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত পুরুষের হাতে, কিন্তু বিরূপ প্রতিক্রিয়ার অধিকাংশই পড়ে নারীর ওপর।"
চাওলা ও কোমাল দুজনেই নিশ্চিত করেন, তাদের পণ্য সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি, যা সরাসরি এসেছে বনাঞ্চল থেকে। এতে অপচয় হয়েছে খুব কম এবং কোনো প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা করা হয়নি।
সাচি মালহোত্রা দ্যাট স্যাসি থিং নামের একটি ভেষজভিত্তিক যৌনতার পণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের মালিক। তার প্রতিষ্ঠান লিউব, পিউবিক হেয়ার অয়েল ও সব লিঙ্গের জন্য আন্ডারওয়্যার ধোয়ার ডিটারজেন্ট তৈরি করে।
ভেষজভিত্তিক যৌনতার পণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের মালিক সাচি মালহোত্রা
৩০ বছর বয়সী মালহোত্রা বলেন, ‘পুরুষতান্ত্রিক ভারতীয় ব্র্যান্ডগুলো নারীর জন্য পণ্য তৈরির দাবি করলেও, সেগুলো শেষ পর্যন্ত পুরুষকে তুষ্ট ও নারীর নিরাপত্তা ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়। আনন্দের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটছে।
‘নারীর যৌনাঙ্গের সুস্থতার বিষয়টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। যেসব লিউব ব্যবহার করা হয় সেগুলোর অধিকাংশ ফ্লেভারযুক্ত, আঁঠালো এবং ঘন ও কৃত্রিম চিনি জাতীয় দ্রব্য মেশানো। যেটি যৌনাঙ্গের পিএইচ লেভেলকে নষ্ট করে এবং চুলকানি, র্যাশ ও ইস্ট ইনফেকশনের জন্ম দেয়।’
১৫ বছর বয়স থেকে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমে (পিসিওএস) আক্রান্ত নারী হিসেবে মালহোত্রা ভালো করেই জানতেন, এসব শারীরিক সমস্যা নিয়ে কথা বলাটা কতটা অস্বস্তিকর। তিনিও যৌনাঙ্গের শুষ্কতা, পিরিয়ডের সময় তীব্র ব্যথা ও শারীরিক মিলনের সময় ব্যথা অনুভব করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমার শরীরের জন্য ভালো ও উপকারী পণ্য খুঁজতে গিয়ে দেখি, সে ধরনের কিছু নেই। অধিকাংশ যৌনতাভিত্তিক পণ্যের ব্র্যান্ডগুলো পুরুষ দ্বারা পরিচালিত। এ কারণে তারা শুধু পুরুষের উপভোগের জন্য পণ্য তৈরি করে। আমি জানি না, নারীর যৌনাঙ্গের জন্য কোনটি ভালো সেটি পুরুষ কীভাবে ঠিক করে!’
ভারতের মতো একটি দেশে নারীর মুখ থেকে এ ধরনের কথা বের হওয়া খুব সহজ ঘটনা নয়।
কোমাল জানান, ব্লু উদ্বোধন করার পরের কয়েক মাসে অনলাইনের তার ওপর অবিশ্বাস্য আক্রমণ চালানো হয়েছে। তিনি তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলো একপর্যায়ে ‘প্রাইভেট’ করে দিতে বাধ্য হন।
তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু আক্রমণ আমাকে ভেঙে দিয়েছিল। তবে পরিবার ও সমর্থকদের কাছ থেকে বরাবরই সমর্থন পেয়েছি।’
চাওলাকেও তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলো ‘প্রাইভেট’ করতে হয়েছে। তিনি যোগ করেন, এই ২০২১ সালেও অনেক ভারতীয় মনে করেন, কনডমের মতো বিষয় নিয়ে কথা বলা মানে যৌনসঙ্গী পাওয়ার অনুরোধ জানানোর মতো কোনো বিষয়।
তিনি বলেন, ‘আমি যদি যৌনতা নিয়ে কথা বলি তাহলে নিশ্চিতভাবেই ইনবক্সে পুরুষাঙ্গের কিছু ছবি পাব। নারী হিসেবে এই বাড়তি লড়াইটুকুও আমাকে করতে হচ্ছে।’
অন্যদিকে মালহোত্রা বলেন, ‘পুরুষতান্ত্রিকতা ও সহজাত নারী বিদ্বেষ আমাদের সমাজের অত্যন্ত গভীরে চলে গেছে। অধিকাংশ নারীকে বিশ্বাস করানো হয়েছে, ব্যথা পাওয়া যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি স্বাভাবিক বিষয় অথবা পুরুষ সঙ্গীর উপভোগের জন্য নিজের আনন্দকে ত্যাগ করতে হবে।’
তবে এই তিন নারীই সমাজ বদলানোর বিষয়ে আশাবাদী। চাওলা জানান, তিনি একজন পরামর্শককে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে যৌন শিক্ষা শুরু করার জন্য কাজ করছেন।
কোমালও আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘আমার কয়েকজন গ্রাহক বলেছেন, তারা পর্নো সিনেমা থেকে যৌনশিক্ষা পেয়েছেন। তবে এখন তারা তাদের সঙ্গীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভালো কোনো বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ করতে চান।’