গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে ছড়িয়েছে অচেনা এক প্রাণীর হামলার ভয়। আতঙ্কে উপজেলার কয়েকটি গ্রামের লোকজন অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকেই বের হচ্ছেন না। যারা বের হচ্ছেন, তারা সুরক্ষার জন্য সঙ্গে লাঠি রাখছেন।
গ্রামবাসীর দাবি, অচেনা সেই প্রাণীর হামলায় একজন এরই মধ্যে মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ১০ জন।
এসব গ্রামের কয়েকজন জানান, আতঙ্কে তারা এরই মধ্যে চারটি শিয়াল পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন।
পলাশবাড়ীর হরিনাথপুর, তালুকজামিরা, কিশামত কেঁওয়াবাড়ি ও কেঁওয়াবাড়ি গ্রামে ওই প্রাণীটি দেখা গেছে বলে দাবি গ্রামবাসীর।
কেঁওয়াবাড়ি গ্রামের নাজিম উদ্দিন জানান, গত ২৪ অক্টোবর সকালে তার ছেলে রাব্বী শেখ ও স্ত্রী রুমি বেগমের ওপর হামলা করে ওই প্রাণী। রাব্বী কেঁওয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।
রাব্বী জানায়, পাশের গ্রামের দাদার বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে ফেরার সময় প্রাণীটি তার মুখে ও শরীরের বিভিন্ন অংশে আঁচড় দেয়। চিৎকার শুনে তার মা রুমি এগিয়ে গেলে তিনিও হামলার শিকার হন।
রাব্বীর দাদা সাইদুর রহমান বলেন, ‘সকাল সাড়ে সাতটার দিকে রাব্বীকে ওই পশুটা কামড় দিছে। এটাকে কেউ বলে শিয়াল, কেউ বলে নিগ্রো; আবার কেউ বলে হায়েনা।’
এটা দেখতে কেমন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হায়েনার মতো নম্বা (লম্বা)। নেশটা (লেজ) নম্বা-মোটা। পাচা-ঠ্যাং (পেছন ও পা) খাটো; মুখটে নম্বা, কালো কালো। এটা শিয়েল না; কুকুরও না।’
অচেনা প্রাণীর হামলার শিকার হয় বলে জানায় শিশু রাব্বীশিশু রাব্বী শেখ বলে, ‘হামি গেছিলাম হামার দাদার বাড়িত। আসপের ধরি (আসার সময়) ঝাপদে উঠি (ঝাঁপ দিয়ে উঠে) হামার এটি কামড় দিছি (আমার মুখে কামড় দিয়েছে)। এটি (বুক দেখিয়ে) কামড়াছে; এটি (পা ও পিঠ দেখিয়ে) কামড়াছে। পড়ে আম্মু নাটি (লাঠি) নিয়ে দাবাড় (ধাওয়া) মারছে। পরে আম্মুকেও ধরছিল।’
প্রাণীটা দেখতে কেমন? উত্তরে শিশুটি বলে, ‘কুকুরের মতো লেজ মোটা। ঠ্যাংগুলো খাটো; লাল। তল সাদা। মুখটে লম্বা।’
প্রায় একই রকম বর্ণনা দিয়েছেন প্রাণীটির হামলার শিকার দাবি করা আমরুল, হামিদ মিয়া, আফছার আলী, সুমি বেগম, মনজিলা বেগম, পারভীন বেগম, শেফালি বেগম, মুক্তা বেগমসহ অন্তত ১০ জন।
তারা আরও জানান, প্রাণীটার গায়ের রং লাল, সাদা ও ধূসর। শরীরে একধরনের ডোরাকাটা দাগ আছে। সামনের দুই পা আকারে ছোট ও মুখমণ্ডল লম্বা। লেজ আকারে বড় ও মোটা।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর হরিনাথপুর গ্রামের উত্তরপাড়া জামে মসজিদের ইমাম ফেরদৌস সরকার রুকু বাড়ির পাশে ঘাস কাটতে গিয়ে ওই প্রাণীর হামলার শিকার হন বলে জানা গেছে। তাকে স্থানীয়রা আহত অবস্থায় উদ্ধার করে জেলা সদর হাসপাতালে নেন। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়িও ফেরেন।
গত ১৭ অক্টোবর অবস্থার অবনতি হলে তাকে নেয়া হয় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেই পরদিন তিনি মারা যান।
তার ভাই সাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, ‘ঘাস কাটপের যায়া আমার ভাইকে কামড়াছে। পশুটা কুকুরের মতো দেখতে আর হিংস্র। রুকুকে কয়েক জায়গায় কামড় দিয়েছে।’
অচেনা প্রাণীর হিংস্রতার বর্ণনা মুখে মুখে ছড়িয়েছে গোটা উপজেলায়। লোকজন আতঙ্কে হাটবাজারে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। অভিভাবকরা সন্তানদের স্কুলেও পাঠাচ্ছেন না। খুব প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হলে সবাই লাঠি বহন করছেন।
শিশু রাব্বীর গায়ে ও মুখে পাওয়া যায় এই ক্ষতচিহ্নকেঁওয়াবাড়ির শাহনাজ বেগম বলেন, ‘লাঠি নিয়ে আসার লাগতেছে। যখন তখন বের হয়। ঘর থাকি বাহির হবার পাচ্ছি না। ভাইরাসেও মানুষ এত ভয় পায় নাই, কিন্তু এটাক (প্রাণী) ভয় পাতিছে।’
ওই গ্রামের সোহেল মিয়া বলেন, ‘বাজারত যাবার পাচ্ছি না। ছোলপোল ভয়ে স্কুলত যাচ্ছি না। ধানের জমিত যাবার পাচ্ছি না আমরা। খুব সমস্যায় পড়ছি। পশুটা হুট করে কামড় দিয়ে পলায় জন্যি চেনা যায় না (পশুটা হঠাৎ করে কামড় দিয়ে পালিয়ে যায় বলে ঠিকমতো চেনা যায় না)।’
যারা পশুটির হামলার শিকার হয়েছেন তারা বলছেন, প্রত্যেকে একটি পশুকেই দেখেছেন। দল বেঁধে আসতে দেখেননি। তারা ধারণা করছেন, একটি পশুই বারবার আসছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মাফুজার রহমান সরকার বলেন, ‘জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত শিয়ালজাতীয় প্রাণী লোকালয়ে ঢুকতে পারে। বন-জঙ্গল উজাড় হওয়ায় খাদ্যাভাবে এমনটা হতে পারে।
‘শিয়াল বা কুকুর পাগল হলে খুবই হিংস্র প্রকৃতির হয়। সামনে যাকে পাবে তাকেই কামড়ানোর চেষ্টা করবে। আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।’
স্থানীয়দের সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করার পরামর্শ দিয়ে জেলা প্রশাসক আবদুল মতিন বলেন, ‘এ নিয়ে মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে ইউএনও ও বন বিভাগকে বলা হয়েছে।’
পলাশবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুজ্জামান নয়ন বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে পাগলা শিয়াল এটি। আহতদের সরকারিভাবে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সরেজমিন পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
আতঙ্কে চারটি শিয়াল পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে বলে জানিয়েছে গ্রামবাসীপ্রাণীটি শিয়াল হতে পারে বলে মত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ মনিরুল এইচ খানেরও।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি জেনেছি এবং বিভিন্ন জনের মুখে প্রাণীর বিবরণ শুনেছি। তাতে মনে হয়েছে এটি একটি শিয়াল। কুকুর যেভাবে পাগল হয় এটিও সেভাবে পাগল হয়েছে। যে জায়গায় ঘটনাটি ঘটেছে এমন জায়গায় সাধারণত শিয়াল বসবাস করে। তবে প্রাণীটির ভালো ছবি এবং ভিডিও দেখতে পারলে শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যেত।’
তবে শিয়াল সাধারণত দল বেঁধে চলে। তাহলে সেখানে হামলার শিকার গ্রামবাসী একটি পশু দেখার যে দাবি করছেন, তাতে সেটি শিয়াল হতে পারে কি না?
এ প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক ও মাংসাশী প্রাণীর গবেষক মুনতাসির আকাশ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোনো একটা শিয়াল পাগল হয়ে দলছুট হয়ে এমনটা করে থাকতে পারে।
‘শিয়াল কি না, সেটা শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। এই প্রাণীটি দেখলে বা তার দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা না করলে বলা কঠিন। আপাতত সাধারণ মানুষকে সতর্ক হয়ে চলা এবং এই প্রাণীটিকে ধরতে বন বিভাগের উদ্যোগ নেয়া উচিত।’
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন মৌলভীবাজার থেকে রিপন দে।