সবাই আমরা (ব্লেস, অর্পণ, অঞ্চিত, অমিত, বৃষ্টি আর আমি) পৌঁছে গেছি কমলাপুর রেলস্টেশনে। ট্রেন ছাড়ার কথা রাত পৌনে ১১টায়। যেকোনো সময় প্ল্যাটফর্মে ট্রেন এসে পড়তে পারে। সময় ঘনিয়ে আসছে অথচ প্রিমার দেখা এখনও নেই। আমরা অস্থির অপেক্ষায়। অন্যদিকে প্রিমা রাইড শেয়ারের মোটরবাইকে অলিগলি, চিপাচাপার ফাঁক গলে প্রাণান্ত চেষ্টায় আসছে। বৃহস্পতিবারের যানজটও একটা ব্যাপার মনে হয়। যারপরনাই প্রিমা এলেও ট্রেন এলো ১১টা ৫০-এ, ছাড়ল ১২টা ২০-এ। পঞ্চগড় এক্সপ্রেস।
আমরা যাচ্ছি সর্ব-উত্তরের জেলায়। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেলে দেখব, না হলে নাই। ঢাকায় থেকে শরীর ও মনে যে ক্লেদ জমেছে, তা ঝেরে ফেলতে চাই। এই তো কয়েক সপ্তাহ আগেই নাপিত্তাছড়া ট্রেইলে ট্রেকিং করলাম। মনে হয় এক যুগ পর আরামের ভ্রমণ দিতে চলছি আমি। রাতভর বিচিত্র সব ঘটনা ঘটল।
ট্রেনে উঠে অমিতের কুম্ভকর্ণের ঘুম। বিমানবন্দর স্টেশন থেকে আবু নামে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এক কিশোর উঠল। সেকি কাণ্ডকীর্তি তার। সবার সঙ্গেই তার কুশল বিনিময় করতে হবে। সঙ্গে থাকা খাবার ভাগ করে খাবে। তার বোচকার বিভিন্ন জিনিস একাধিক সিটের নিচে রাখতে হবে, আরও কত কী!
আর ট্রেনের সিটের কথা নাই বলি। কোনোটা লক্কড়ঝক্কড়, কোনোটা পিছে হেলানো যায় না। কোনোটা একবার হেলে গেলে সোজা হয় না। সিটের ওপরের ফ্যানগুলো ধুলাজমা, ঘোরে তো ঘোরে না। টয়লেট একটা ভালো তো দুইটা খারাপ। পানি নেই। সিটের পাশের জানালা খোলে না, খুললে বন্ধ হয় না। আসলেই রেল খাত খুব অবহেলিত এ দেশে।
যমুনা নদী! বর্ষা শেষের মৌসুম হলেও অকালেই বুড়িয়ে যাওয়া খটখটে কলেবর তার। মানুষ এমন এক প্রাণী, যে প্রকৃতির ক্ষতি বৈ ভালো কিছু করে না। এই প্রাণীর ক্রমশ যান্ত্রিক আর প্রকৃতি-দূরবর্তী আচরণ এর জন্য দায়ী।
এসব ভাবতে ভাবতে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। বাইপাসের অন্তর্বর্তী সময় পার হয়ে ট্রেন ছাড়ার সময় এক কিশোর বাইরে থেকে লাফ দিয়ে জানালা দিয়ে যাত্রীদের মোবাইল ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টায় তৃতীয়বার ও তৃতীয় যাত্রীর বেলায় সফল হলো। শুরু থেকেই সব যাত্রী উচ্চবাচ্য করলেও ট্রেনে থাকা পুলিশ সদস্যদের এমন ভাব, যেন কিছুই হয়নি।
প্রায় ভোর। বাকি সব ঘুমে। আমরা এখন নাটোর স্টেশনে। কৃষ্ণপক্ষের হলদে বাঁকা চাঁদ ডুবি ডুবি করছে। সকাল পর্যন্ত দরজায় দাঁড়িয়ে কয়েকজন গল্পের ঝাঁপি খুলে বসলাম। বিষয়? ভ্রমণ, প্রকৃতি, রাষ্ট্র, সমাজ, উন্নয়ন- এসব আর কি। পথ আরও বাকি, তাই ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। বেড়ানোর সময় সঞ্চিত শক্তিই ভরসা, তবে মনের জোর শয়ে শয়ে।
সকাল ১০টা ২০। বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম স্টেশন, পঞ্চগড়। স্টেশনের কাউন্টারে ফিরতি টিকিট কাটার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। পরে শুনলাম চাহিদা ও সিন্ডিকেটের কারণে এ হাল। দেরি না করে একটা ভ্যান নিয়ে শহরের মৌচাক হোটেল ও রেস্তোরাঁয় নাশতার অর্ডার দিয়ে আমি আনিস ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম বাইরে। আনিস ভাই তেঁতুলিয়ায় তার বন্ধু কাজী মোকসেদের গেস্ট হাউস স্বপ্নতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোতে জায়গা হয়নি, আগে থেকেই ভিআইপিদের বুকিং।
যাই হোক, আমাকে দেখে আনিস ভাই অবাক। শুধালেন, ‘আপনি এখানে কেন? মজুমদার জুয়েল ভাই কই?’
এ কথা শুনে আমিও অবাক হয়ে হাসলাম কিছুক্ষণ। আনিস ভাই ভেবেছিলেন, তার সাবেক সহকর্মী মজুমদার জুয়েল ভাইয়ের যাবার কথা পঞ্চগড়ে। নাশতা চা-পর্ব সেরে চৌরাস্তার মোড় থেকে তেঁতুলিয়াগামী বাসে ওঠার আগে আমার বর্তমান সহকর্মী লুৎফর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। ঘণ্টাখানেকেরও কম সময়ে তেঁতুলিয়ার বিখ্যাত তেঁতুলগাছের (যার নামে তেঁতুলিয়া নামকরণ) সামনে নামলাম। মোকসেদ ভাইয়ের পাঠানো ভ্যানচালক শহীদুল আমাদের নিয়ে গেল স্বপ্নতে। কোনো রকমে ফ্রেশ হয়েই ছুট।
ডাকবাংলোতে ঢোকার মুখে গিটার হাতে একটা ব্যাঙের ভাস্কর্য, অর্পণ বলছিল এটা নাকি স্বপ্নীল (স্বপ্নীল গিটার বাজিয়ে গান করে, ভাল গায়, এবার সে আসতে পারেনি)। ভেতরে সম্মানিত পর্যটকরা পদধূলি দিচ্ছেন। দ্রুত পা চালিয়ে মহানন্দায় নামলাম। ওপাশে ভারত, কাঁটাতার আর বিএসএফের সতর্ক পাহারা স্পষ্টত দৃশ্যমান। আমরা দেখলাম আর ভাবলাম এই আন্ত নদী নিয়ন্ত্রণের জটিল রাজনীতির ব্যাপার-স্যাপার, নদীদূষণ, যথেচ্ছাচারী অথচ পেট-সংসার চালানো পাথরজীবীদের।
এই যখন অবস্থা ততক্ষণে বিকেল, আলোকচিত্রী অমিতের ক্যামেরার চোখও খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। ওদিকে কবির আকন্দ ভাই কল দিচ্ছিলেন বারবার। আমার ক্যাম্পাসের (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) বড় ভাই। তিনি কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটের সহকারী ব্যবস্থাপক। ওনাদের প্রতিষ্ঠানের অবকাশ যাপন কেন্দ্র আনন্দধারায় যেন বেড়িয়ে যাই।
এবার সারথি অটোচালক সোহেল। সে সব চেনে। বাপ-দাদার বাড়ি ফরিদপুরে ছিল। পরে এখানে এসে বসতি করে। আনন্দধারা বৈচিত্র্যময়! হরেক জাতি-প্রজাতির পাখপাখালি। বিভিন্ন উপমহাদেশের নিজস্ব ধাঁচের একেকটা বাড়ি। নালার ওপর দিয়ে সেতু। নালার কিনারা ধরে পাকা বাঁধাই (পানিপ্রবাহ কি ক্ষতিগ্রস্ত হলো?)। এই কেন্দ্রে সহজে থাকা যায় না। সম্ভব তবে বেশ ওপর মহলের তদবির লাগে। শুধু দেখতে চাইলেও ভেতরের উচ্চপদস্থ কারও পরিচিত হতে হয়। ফেরার সময় মহানন্দার পাড়ে কাশফুলের সমাহার দেখে অমিত ভাবছিল, পরদিন সকালে ছবি তুলবে, তোলা হয়নি পরে অবশ্য।
সকালে নাশতার পর সারা দিন কিছু খাওয়া হয়নি। সন্ধ্যা সন্ধ্যায় তেঁতুলিয়া বাজারে পেটচুক্তি খাই। রেস্ট হাউসে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ছাদে উঠে তুমুল আড্ডা, গান, হাসাহাসি, আনন্দের ফোয়ারা। রাত আরও গভীর হলে মহানন্দার হাতছানিতে সম্মোহিতের মতো সাড়া দিই। আরামে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নদীর পাড়ে, পোলাপান ডেকে তুললে ফিরে আসি বিশ্রামঘরে।
বেলা করে ঘুম ভেঙে সবার মাথা খারাপ। দ্রুত পরিষ্কার হয়ে নাশতা সেরে সোহেলের অটোতে চড়ে প্রথমে শিশুস্বর্গ বিদ্যানিকেতন। স্কুলটি প্লেগ্রুপ থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত। কবির ভাই দেখাশোনা করেন। তার বন্ধুর মায়ের নামে এই প্রতিষ্ঠান। ভিন্ন ধাঁচের অবকাঠামোতে তৈরি, ‘ফুলের বাগানে শিশুরাই ফুল’ স্লোগানসমেত স্কুলটার শিশু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমরা কিছুক্ষণ সময় কাটাই। তারাও আনন্দিত। করোনায় শিক্ষাজীবনের বেশ ক্ষতি হয়ে গেল!
এবার গন্তব্য বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। পর্যটকদের ভিড়, কেউই শূন্য বিন্দুতে যেতে পারছেন না। জেলা পুলিশ সুপার এসেছেন, কী সব করছেন। সময়টা কাজে লাগিয়ে আমরা পাশেই কাঁচা রাস্তা ধরে মহানন্দার পাড়ে শতবর্ষী বটগাছ দেখতে যাই। বিশাল দেহের বিশাল সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মেলে শতবর্ষব্যাপী গাছ আগলে রেখেছে সময়, প্রাণিকূল। গাছেরও কি সীমানা হয়? হয়তো। অন্য প্রাণীদেরও হয়, কিন্তু মানুষের মতো প্যাঁচালো হয় না। বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে চলে আসি শূন্য বিন্দুর কাছে। এবার যাওয়া যাবে। ভিসা ছাড়া দাগের ওপাশে অর্থাৎ ভারতে যতটুক যাওয়া যায়, ততটুক গিয়েও কী বিপুল উচ্ছলতা মানুষের!
আমরা ফিরি। যাচ্ছি কবির ভাইয়ের দায়িত্বের আওতাধীন চা-বাগান দেখতে, যা নাকি ভারতে পড়েছে। বাগান দেখার আগে কবির ভাই আমাদের লেমন গ্রাস টি দিয়ে আপ্যায়ন করেন।
উদরপূর্তি সেরে আরেক দফা ডাকবাংলোর কাছে মায়াময়ী মহানন্দার পাড়ে। একটু পরই দলের ৪ জন চলে যাবে ঢাকায়। চলেও যায়। আমরা বাকিরা সোহেলকে নিয়ে আবারও মহানন্দার পাড়ে, তবে এবার পুরোনো বাজারের কাছে। ভারতের কাঁটাতারের ওপর স্থাপিত আলোতে দৃষ্টি ঘোলা হয়। আমরা পরিত্যক্ত ভাঙা এবং অনেক পুরোনো একটি মন্দির ঘুরে দেখি। সেখানে যাবার সময় স্থানীয় এক মধ্যবয়স্কা বলছিলেন যে, রাত করে মেয়েদের ওই মন্দিরে যেতে বারণ। আমরা শুনিনি। শুনব কেন?
রাতে খেয়ে রেস্ট হাউসে ফিরে এসে বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি সবাই। কথা ছিল আরেকবার মহানন্দার পাড়ে যাব, হলো না। সকালে তুমুল বৃষ্টি। তাকে সঙ্গী করেই পঞ্চগড় শহরে যাই। ঢাকাগামী বাসের টিকিট কেটে, সুজানাদির বাড়িতে ব্যাগ রেখে, পাগলুতে (তেলচালিত ত্রিচক্রযান) চড়ে যাই বড়শশী, গন্তব্য বোদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দির। এই মন্দিরও অনেক আগের।
মোট ৫১টি মহাপীঠের মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ৮টি। তার মধ্যে একটি এই বোদেশ্বরী। আরেকটি আমি সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথে দেখেছি। মহাপীঠের বর্ণনা পাঠক আপনারা গুগল থেকেই জানতে পারবেন। পীঠের মূল মন্দিরটা পার্বতীর (দুর্গা), সাথে পরে নতুন করে আরও দুটি মন্দির (শিব ও বিষ্ণুর) হয়েছে। সেগুলোর গায়ে মন্দিরগুলোর উন্নয়নে অর্থদাতাদের নাম উল্লেখ করা। সীতাকুণ্ডেও দেখেছি সিঁড়িগুলোতে দাতাদের নাম।
বেশ জায়গা নিয়ে গাছপালা ও পুকুরসমেত এই বোদেশ্বরী মন্দির। দেখভালে পূজারি ও ভক্তরা থাকেন প্রাঙ্গণে। রয়েছে মন্দিরভিত্তিক শিশু ও বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম কেন্দ্র। দেখলাম পাশেই নতুন প্রতিমা রাঙানো হচ্ছে। ক’দিন বাদেই দুর্গাপূজা। মানুষ মেতে উঠবে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যতা আর উৎসবে। একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিষফোঁড়ার আতঙ্ক তো রয়েছেই। আমরা বের হয়ে আসি। ফিরতি পথে ঐতিহ্যবাহী কাজলদিঘিতে থামি। স্থানীয়রা জানান, তারা এটা ছুঁতেই পারেন না, সরকারি নিলামে প্রভাবশালীরা মাছচাষ করেন।
পঞ্চগড় শহরে ফিরে লো ব্লাড প্রেসারে প্রিমা অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তাকে সুজানাদির বাড়িতে নিয়ে গেলে বাড়ির লোকজন যত্নআত্তি বাসের সময় এসে যায়। রাত ৮টায় বাস ছাড়ে। যানজট ঠেলে ঢাকায় পৌঁছাই ১৪ ঘণ্টা পর। ফেরার সময় মনটা বেশ খারাপ হয়। আমার এখনও কোথাও বেড়াতে গেলে ফেরার সময় মন খারাপ হয়।