বান্ধবী নীতু কয়েক দিন ধরে খাবারের ছবি পোস্ট দিচ্ছিল। বুধবার সকালে ফেসবুকে তার এমন এক পোস্টে চোখ আটকে গেল।
শেয়ার করা সে পোস্টে ছিল রসগোল্লার পাঁচটি ছবি, কিন্তু এ রসগোল্লা সে রসগোল্লা নয়।
রসে নিমগ্ন হলেও এর চারপাশে কাঁচা মরিচের কুচি আর বিচি। রং সবুজ। আকার আর দশটা মিষ্টির মতোই।
জীবনে এত রসগোল্লা খেলাম, কিন্তু এমন সবুজাভ রসে ভাসা বস্তুর দেখা পেলাম না। মরিচের এমন সমারোহও চোখে পড়েনি কখনো।
নীতুর ওয়াল ঘেঁটে দেখলাম, রসগোল্লার ছবিগুলোর আদি পোস্টদাতা সঙ্গীতা ঘোষ সাহা। উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম নামের পাবলিক গ্রুপে ছবিগুলো শেয়ার করেছিলেন তিনি।
সে গ্রুপ থেকে ঢুকলাম সঙ্গীতার প্রোফাইলে। পেশার জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘ঘরে তৈরি করা কেক ও খাবার সেল দিয়ে থাকি।’
বুঝতে দেরি হলো না সবুজ রসগোল্লাও তৈরি হয় সে ঘরেই। কীভাবে সেটি হয়, তা জানতে শুরু করি যোগাযোগ।
ওই দিন সন্ধ্যা ৬টা ২৪ মিনিটে সঙ্গীতা ঘোষ সাহার ইনবক্সে লিখলাম, ‘শুভ সন্ধ্যা। আমি আজহার। নিউজবাংলায় কাজ করি। আপনার সঙ্গে ঝাল মিষ্টি নিয়ে কথা বলতে চাই।’
উত্তর এলো বরাবর পৌনে ৯টায়। সঙ্গীতা বললেন, ‘কী বলবেন, বলেন।’ আমি তখন মোবাইলে ইন্টারনেট বন্ধ করে বাসে বাসায় যাচ্ছিলাম। তিনি সাড়াশব্দ না পেয়ে লিখলেন, ‘??’
রাত ১০টার পর তার সে মেসেজ দেখে শুরু হলো আলাপ। সোজাসাপ্টা কিছু প্রশ্ন করে তার কাছ থেকে জানা গেল ঝাল রসগোল্লা বা ঝালগোল্লার ইতিকথা।
কীভাবে এলো ঝালগোল্লা
ঘরে বসে মিষ্টান্ন তৈরির উদ্যোক্তা সঙ্গীতার কাছে আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘জগতে এত কিছু থাকতে আপনার মাথায় ঝাল মিষ্টির আইডিয়াটা কেন এলো?
উত্তরে তিনি বললেন, ‘সত্যি বলতে আমার রান্না বিষয়টা খুবই পছন্দ, কিন্তু একঘেয়েমি খাবার আমার একদমই পছন্দ না, সেটা যেমনই হোক। তাই খাবার নিয়ে খুব এক্সপেরিমেন্ট করি। ওই খাবারগুলো খেয়ে সবাই ভালো বলে। তাতে করে আমার কনফিডেন্স বেড়ে যায়।
‘গত বছর শীতে একটা গ্রুপ প্রতিযোগিতায় ইউনিক রেসিপিতে তন্দুরি চিকেন ভাপা পিঠা বানিয়ে বিজয়ী হয়েছি। আমার মিষ্টি খুব পছন্দ, কিন্তু ওজন বেড়ে যাওয়ায় মিষ্টি খেতে না করেছে ডাক্তার। তাই মাথায় এলো পছন্দের খাবার যদি অন্যভাবে খাই তবে কেমন হয়!’
রসগোল্লায় মিষ্টির সঙ্গে ঝালের মিশ্রণ নিয়ে এ রন্ধনশিল্পী বলেন, ‘আমি শুনেছিলাম ঝাল রসগোল্লা আছে, কিন্তু রেসিপি জানা নেই। তাই নিজের রেসিপিতে বানানোর পদক্ষেপ নিই। বানানোর আগে একটা পোস্ট করেছিলাম ঝাল রসগোল্লা বানাব। ১২ কেজি মিষ্টি বানিয়েছি।’
উপকরণ
ফেসবুক কথোপকথনেই সঙ্গীতা জানালেন ঝালগোল্লা বানানোর উপকরণগুলোর নাম। তার ভাষ্য, এ ধরনের রসগোল্লা বানাতে লাগবে ১ কেজি বিশুদ্ধ ছানা, বিচিসহ ৪ চা চামচ কাঁচা মরিচের পেস্ট, আধা কাপ ময়দা, শিরার জন্য ৫ কেজি চিনি।
তিনি জানান, কাঁচা মরিচের পেস্টের কারণেই রসগোল্লার রং হয় সবুজ।
বানানোর প্রক্রিয়া
ঝাল রসগোল্লা বানানোর প্রক্রিয়া নিয়ে ঢাকার সাভারের বাসিন্দা সঙ্গীতা বলেন, ‘গরুর দুধ সংগ্রহ করে জাল দিয়ে তাতে ভালো ছানার পানি মিশিয়ে ছানা কাটা হয়। এই ছানা বাসি করা যাবে না। বাসি ছানায় পারফেক্ট টেস্ট আসবে না। তাই ছানা কাটার সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি বানালে পারফেক্ট টেস্ট আসবে।
‘ছানা বানিয়ে ভালো করে জল ঝরিয়ে নিতে হবে। ছানা একটি পাত্রে নিয়ে তার সঙ্গে স্বাদ অনুযায়ী কাঁচা মরিচের পেস্ট মেশাতে হবে। ছানা ভালো করে মিশিয়ে মথে নিয়ে তার সঙ্গে ময়দা মিশিয়ে ডো বানিয়ে নিতে হবে। মিষ্টিটা হাফ স্পঞ্জ হবে আর শিরাটা হবে পাতলা। মণ্ড থেকে মিষ্টি বানিয়ে নিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কড়াইতে পাতলা চিনির শিরা বানিয়ে তাতে মিষ্টিটা ফুটিয়ে নিতে হবে। শিরা থেকে মিষ্টি উঠিয়ে অন্য পাত্রে নিয়ে শিরা দিয়ে নিতে হবে। মিষ্টি মোটামুটি ঠান্ডা হয়ে গেলে কাঁচা মরিচ কুচি দিয়ে সারা রাত ভিজিয়ে নিতে হবে। পরের দিন মরিচের রসে টইটম্বুর হয়ে যাবে ঝাল রসগোল্লা।’
কোন ধরনের মরিচ ব্যবহার করতে হবে, তা নিয়ে এ রন্ধনশিল্পী বলেন, ‘ছানার সঙ্গে যখন কাঁচা মরিচ পেস্ট মেশানো হয়, তখন মিষ্টির ভেতরে হালকা সবুজ সুন্দর কালার আসে।
‘মরিচটা অবশ্যই সবুজ মরিচ হতে হবে। কেউ চাইলে হালকা সবুজ ফুড কালার মেশাতে পারেন।’
দাম কেমন
ঝালগোল্লার স্রষ্টা সঙ্গীতা জানান, এ ধরনের এক কেজি মিষ্টান্নের দাম ৪০০ টাকা। এ দামটা ন্যায্য কি না, তা জানতে চাওয়া হয় তার কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, ‘নরমাল এক কেজি রসগোল্লা কিনতেও ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা লাগে। আর এটা নতুন একটি মিষ্টি। এর স্পেশালিটি বোঝাতে হবে। তাই এর দাম নির্ধারণ করেছি ৪০০ টাকা।
‘যেহেতু এটা হোমমেড খাবার, তাই এটাতে খরচটা বেশি পড়ে। আর আমার মিষ্টির কোয়ালিটি বিশুদ্ধ হওয়ায় এর খরচও বেশি হয়। আর বাজারের সবকিছুর দাম বেশি।’
মিষ্টির দামের একটা ব্যাখ্যা দিয়ে সঙ্গীতা বলেন, ‘একটা খরচের হিসাব করা যাক। এক কেজি ফ্রেশ ছানা বানাতে ৭ থেকে ৮ কেজি দুধ প্রয়োজন হয়। অল্প পরিমাণে বানানোর জন্য আমার খুচরা দামে কিনতে হয়। রেডি ছানা ব্যবহার করলে খরচ আরও কম পড়ত। যেহেতু রেসিপিটা সম্পূর্ণ আমার নিজের, তাই রেসিপি কোয়ালিটি বিশুদ্ধ হওয়ার গ্যারান্টি আমাকেই দিতে হবে।
‘আমাদের এখানে দুধের প্রতি কেজি ৯০ থেকে ১০০ টাকা। ৮ কেজি দুধ ৭২০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা। ৫ কেজি চিনি ৮০ থেকে ৯০ টাকা ধরলে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। কাঁচা মরিচ ১০০ গ্রাম ৪০ টাকা; প্যাকেজিং ৬০ টাকা। এবার দেখুন ৭২০+৪৫০+৪০+৬০= ১২৭০ টাকা। আমার পরিশ্রম আমি ধরিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক কেজি ছানা থেকে ৫ কেজি মিষ্টি হয়, যার মূল্য আসে ২ হাজার টাকা। একটা খাবার বানিয়ে তার থেকে ১০০ টাকা আমি কি লাভ করব না?
‘আবার নির্ধারিত দাম থেকে কিছু গ্রাহক কমাতেও বলে। তখন কমাতেও হয়। জিনিস যেটা ভালো, দাম তার একটু বেশি, তবে যখন বড় পরিসরে করব, তখন দামটা কমানোর চেষ্টা করব।’
ঝালগোল্লায় সাড়া কেমন পাচ্ছেন জানতে চাইলে সঙ্গীতা বলেন, ‘আমি ১২ কেজি মিষ্টি বানিয়ে ৪০০ টাকা করে কেজি বিক্রি করেছি যাদের কাছে, তারা সবাই আমাকে ৫০০ টাকা কেজি দিয়েছে আর বলেছে এটা ৬০০ করে বিক্রি করতে। সবার কাছে এতই ভালো লেগেছে।’