‘আজি কি তোমার মধুর মূরতি/ হেরিনু শারদ প্রভাতে!/ হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ/ ঝলিছে অমল শোভাতে।’
-রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতোই এক মধুর মূর্তি নিয়ে আসে শরৎ।
বৃষ্টি হবে বটে, তবে তার মাত্রাজ্ঞান থাকবে তীক্ষ্ণ, বর্ষার মতো অবিরাম নয়। গরমও আছে, তবে তা অসহনীয় নয়। আর শহরের ঠাসা বুনোটের ভেতরে ঢুকতে না পারলেও শহরের বাইরে কিন্তু শীতের গন্ধ ও হাওয়া ঠিকই বইতে শুরু করছে। ভোরের দিকে পড়ে কুয়াশা।
প্রকৃতির এই তিন রূপের এক অপূর্ব আর পরিমিত সমন্বয়ের নামই শরৎ, যার আয়ুষ্কাল ভাদ্র-আশ্বিন নিয়ে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতের মতো তেজদীপ্তভাবে নয়, শরতের আগমন বড় কোমল। সে আসে ধীরে, চুপিসারে। কোনো বাড়াবাড়ি নেই।
গ্রীষ্মের গা-জ্বালা ধরা গরম ও বর্ষার জল-কাদার জঞ্জাল আর হুলুস্থুলের পর শরৎ আসে স্থিরতার বার্তা নিয়ে। বর্ষার উন্মাতাল গর্ভে তার জন্ম। পরে ছড়িয়ে দেয় মধুর আবেশ।
সবকিছুই কেমন যেন উলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবী, মানুষ, সময়- সব। সবচেয়ে বেশি বোধ হয় পাল্টাচ্ছে প্রকৃতি। যার কেতাদুরস্থ নাম জলবায়ু পরিবর্তন।
যে বাংলা ছিল ষড়ঋতুর, স্বরলিপির মতো ভিন্ন ছয়টি ছন্দের, তাতেও পড়েছে প্রভাব। গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীত ছাড়া বাকি ঋতু এখন আর তেমন দৃশ্যমান নেই। যেন এই তিন ঋতুর পেটে চলে গেছে অপর তিনটি। ফলে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর মতো শরৎ, হেমন্ত আর বসন্ত এখন অস্থিত্ব সংকটে।
বসন্তের কবিরা তবু আছেন। কাব্য কথায় তারা গেয়ে চলছেন ঋতুরাজের প্রশস্তি। এই দলে আছেন প্রেমিক-প্রেমিকরাও। চৈত্রের দাবদাহেও তাদের জীবনে ‘মধুর বসন্ত’ আসে।
হেমন্তেরও আছেন একজন জীবনানন্দ। শরতের জন্য কে আছে?
শরতের আছে কাশফুল। নদীর তীরে যা বকের মতো পাখা মেলে দোল খায়। শিউলিও ফোটে তখন। বিরহী প্রেমিকের সব ব্যথা বুকে নিয়ে সকাল হতেই ঝরে পড়ে সে। আর শরতে বাংলার আকাশের তো জুড়ি মেলা ভার! কী সুনীল, কী মুগ্ধ করা তার রূপ! নীল দেয়ালে আঁকা সাদা ফুলের মতো করে কখনও-সখনও আকাশে ভেসে বেড়ায় মেঘের দল। যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনো ছবি।
শরতে বংলার এমন আকাশের প্রেমে পড়েই তো কবির সুমন গেয়েছেন- ‘গান তুমি হও বাংলাদেশের আকাশ শরৎকালে, এই আকালে দোলাও আমায় তোমার তালে তালে’।
এই কাশফুল, শিউলি, সাদা মেঘের ভেলা- সবকিছু মিলিয়ে একটা শুভ্রতার প্রতীক হয়ে আসে শরৎ। আসে শুভ্রতা আর কোমলতার বার্তা নিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও উঠে এসেছে শরতের কাশ, শিউলি আর সাদা মেঘের প্রসঙ্গ- ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা/নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা/এসো গো শারদলক্ষ্মী তোমার শুভ্র মেঘের রথে’।