বিশ্বের সবচেয়ে বিস্তৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এবং এর জনপ্রিয় সার্ভিস হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার ও ইনস্টাগ্রাম অচল ছিল প্রায় ছয় ঘণ্টা। কোম্পানিটির ইতিহাসে নজিরবিহীন এই বিপর্যয়ের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন একেকজন একেকভাবে। ষড়যন্ত্রতাত্ত্বিকদের একাংশের দাবি, হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছিল প্রতিষ্ঠানের ডেটাবেস ও ডিএনএস সার্ভার। আবার অনেকেই ফেসবুকের এক হুইসলব্লোয়ারের টিভি সাক্ষাৎকারের দিকে আঙুল তুলছেন। এসব বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছে নিউজ ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সভিত্তিক সাইট ভাইস। নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন রুবাইদ ইফতেখার।
বেশ কয়েক ঘণ্টার জন্য ইন্টারনেট জগৎ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম।
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা বিষয়টি নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলেন। এ বিষয়ে পরিষ্কার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি ফেসবুক, তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন বিপর্যয়টি ঘটেছিল ডিএনএস বা বিজিপির মতো অবকাঠামোগত কোনো সমস্যার কারণে।
ডিএনএস বা ডোমেইন নেইম সিস্টেম সার্ভিস ফেসবুক ডটকমের মতো কোনো ডোমেইনের নামকে আইএসপি ও আইএসপিকে ডোমেইনের নামে পরিবর্তন করে ইন্টারনেটে সচল রাখতে সাহায্য করে। আর বিজিপি বা বর্ডার গেটওয়ে প্রোটোকল ঠিক করে দেয়- ডেটার কোনো প্যাকেটকে কোন পথে পাঠানো সবচেয়ে ভালো হবে। সোমবার কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ফেসবুকের ডিএনএস ও বিজিপি রেকর্ডগুলো ইন্টারনেট থেকে মুছে গিয়েছিল।
এই ‘তথ্য-শূন্য’ অবস্থার মধ্যে ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকেরা বিভিন্ন প্রচারে নেমেছেন। তাদের অনেকের অনুমান, ঘটনাটি আসলে একটি বিশাল হ্যাক, যার সঙ্গে আমেরিকান নিউজ ম্যাগাজিন শো ‘সিক্সটি মিনিটস’-এর রোববারের পর্বের কোনো সম্পর্ক আছে।
জনপ্রিয় টিভি শোটিতে ফেসবুকের একজন হুইসল ব্লোয়ার জানান, ফেসবুক ইচ্ছাকৃতভাবে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও ভুল তথ্য রোধ করার ক্ষেত্রে জনগণ ও সরকারের প্রচেষ্টায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। অথবা সোমবারের বিপর্যয়টি নানা সময়ে সংবাদের শিরোনাম হওয়া ফেসবুকের বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত।
একটি মিউজিক স্টুডিও ও রেকর্ডিং কোম্পানি টুইটারে একগাদা ডিএনএস অ্যাড্রেসের একটি স্ক্রিনশট পোস্ট করে প্রচার করে বলেছে, ফেসবুক একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো ধরনের প্রেক্ষাপট ছাড়াই পোস্টটি ভাইরাল হয়। তবে পরে জানা যায়, স্ক্রিনশটটি আসলে KillFearNY নামের একটি ক্রিয়েটিভ ও স্পোর্টস এজেন্সির আরেকটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে চুরি করা।
সবচেয়ে জনপ্রিয় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের একটি হলো, ফেসবুকে হ্যাক করার পর কোনো একটি হ্যাকিং ফোরামে ১৫০ কোটি ফেসবুক রেকর্ড বিক্রি হয়েছে। এই ধারণার উৎপত্তি ২২ সেপ্টেম্বর X2Emails নামের এক কোম্পানির করা পোস্ট থেকে। সেখানে বলা হয়, ‘ফেসবুকের দেড় শ কোটির বেশি ডেটাবেস এই বছর বাতিল করা হয়েছে এবং এগুলোতে ১০০% ই-মেইল ও ফোন অন্তর্ভুক্ত আছে।’
এই পোস্টকেও সোমবার রাতের গোলযোগের সঙ্গে জড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
তবে এই তত্ত্ব কোনো যুক্তিতেই খাটে না। যিনি বিজ্ঞাপনটি পোস্ট করেছেন তিনি কখনও বলেননি, ফেসবুক থেকে ডেটা চুরি হয়েছে। পোস্টটিতে কেবল ডেটা ‘বাতিল’-এর বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে শুধু এটুকু বলা আছে, ‘আমাদের কাছে ই-মেইল, জেন্ডার, অবস্থান, শহর, জন্মতারিখ, ফোন নম্বর, নাম, ইউনিআইডি রয়েছে।’
প্রকৃতপক্ষে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বাতিল হওয়া ডেটাবেস অত্যন্ত সহজলভ্য আর এর সঙ্গে হ্যাকের কোনো সম্পর্ক নেই।
নামসর্বস্ব হ্যাকারদের হ্যাকিং ফোরামে সবার জন্য উন্মুক্ত বাতিল ডেটার বিজ্ঞাপন দেয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। এটি প্রতি সপ্তাহে ঘটে। কখনও কখনও হ্যাকারদের সত্যিকারের হ্যাক করা ডেটা থাকে। সেটি দিয়ে তারা মাঝেমধ্যে অন্য ব্যবহারকারীদের সঙ্গে প্রতারণার চেষ্টা করে।
বিপর্যয়ের কারণ সম্পর্কে ফেসবুকের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এ কারণে শুধু অনলাইন নয়, অফলাইনেও ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। যেমন, নিউ ইয়র্ক টাইমসে বলা হয়েছে, ফেসবুককর্মীরা নির্দিষ্ট ভবনে প্রবেশ করতে পারছিলেন না। ফেসবুক কর্মচারীদেরও ডিসকর্ড ও জুমের মতো সেকেন্ডারি মেসেজিং সার্ভিস ব্যবহার করে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়েছে।
এ বছরের জানুয়ারিতে, ভাইসের প্রযুক্তিবিষয়ক পেইজ মাদারবোর্ড একটি বাস্তব ঘটনার প্রতিবেদন করে, যেখানে বলা হয় হ্যাকাররা ফেসবুককে আক্রমণ করে ৫০ কোটি অ্যাকাউন্টের একটি ডেটাবেস পেয়েছে। সেই ডেটাবেসে এমন ব্যক্তিদের ফোন নম্বর অন্তর্ভুক্ত ছিল যারা সচেতনভাবে সেই তথ্য গোপন রাখার চেষ্টা করেন। দুই মাস পরে কেউ হ্যাকিং ফোরামে ডেটাবেসটি দিয়ে দেয়।
সব মিলিয়ে এখনও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না যে ফেসবুকে কী ঘটেছে। এত ব্যাপক ও দীর্ঘ গোলযোগ ফেসবুকের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এই গোলযোগের খুব ভালো ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব, কিন্তু সেটি দেয়ার জন্য যথেষ্ট তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত যে, ষড়যন্ত্রতত্ত্বগুলি ফেসবুক ছাড়াই ইন্টারনেটে বেশ জোরালোভাবে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম।