স্বজন বলতে কেউ নেই। স্বামীর মৃত্যুর পর ছিল কেবল দুই ছেলে। তাদের একজন মারা যায়, আরেকজন যায় হারিয়ে। এরপর প্রায় ২০ বছর ধরে একেবারেই একা ফরিদা বেওয়া।
তবে একাকিত্বের কাছে হার মানেননি নীলফামারীর সৈয়দপুরের ৫৮ বছর বয়সী এই নারী। হতাশা বা বিষণ্নতা তাকে কখনোই পেয়ে বসেনি; বরং একাকী জীবনকে তিনি উজাড় করে দিয়েছেন পথের বিড়াল-কুকুরের জন্য। এখন এই পথপশুরাই তার পরিবার। তাদের জন্যই যেন ফরিদার বেচে থাকা।
ফরিদার উপার্জন হয় দিনমজুরি করে। যে টাকা পান, তা দিয়ে নিজের মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা রাস্তার কুকুর-বিড়ালদের খাবারে খরচ করেন তিনি। প্রতিদিন খাবার রান্না করে ২০ থেকে ৩০টি কুকুর-বিড়াল খাওয়ান তিনি।
ফরিদা থাকেন সৈয়দপুরের হাতিখানা মহল্লার রেললাইনের ধারে, জরাজীর্ণ একটি ঘরে। বিভিন্ন হোটেলে টুকটাক কাজ করেন। প্রতি রাতে শহরের ক্যান্টনমেন্ট সড়কে গিয়ে কুকুর-বিড়াল খাওয়ান তিনি।
সেই সড়কে গত শনিবার রাত ১১টায় গিয়ে দেখা যায়, ফরিদাকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে কয়েকটি কুকুর। দূর থেকে তার কণ্ঠ শুনেই ছুটে আসছে আরও কিছু।
কয়েক ব্যাগভর্তি খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছেন ফরিদা। কুকুরগুলোর সামনে কাগজ বিছিয়ে তাতে সে খাবার পরিবেশন করছেন। কুকুরগুলোও যেন পরম তৃপ্তি নিয়ে চেটেপুটে সেগুলো সাবাড় করছে। ২০ বছর ধরে এভাবেই তিনি এই পথপশুদের খাদ্যের জোগানদাতা।
নিউজবাংলাকে ফরিদা বলেন, ‘আপন বলতে কেউ নেই। এই কুকুর-বিড়াল সঙ্গে নিয়েই দিন কেটে যাচ্ছে। দিনের বেশির ভাগ সময় বিভিন্ন হোটেলে কাজ করি। সন্ধ্যায় টাকা নিয়ে চলে যাই বাজার করতে। বাজার করে বাসায় রান্না করি। আবার রাতে বের হয়ে কুকুরগুলোকে খাওয়াই। কিছু টাকা রাখি বাড়ি ভাড়া দিতে হয়।
‘এই পশুদের পেট ভরলেই মন ভরে আমার।’
ফরিদা বেওয়ার সঙ্গে হোটেলে কাজ করেন মো. শাহিন। নিউজবাংলাকে ফরিদার একটি ঘটনা জানান তিনি।
‘কয়েক মাস আগে প্রতিদিনের মতো একদিন রান্না করে খাবার নিয়ে রাতে বের হয়েছিলেন ফরিদা। বাস টার্মিনালে দলবেঁধে থাকা কুকুরগুলোকে খাওয়াচ্ছিলেন তিনি। তখন সাতটা কুকুরের মধ্যে উপস্থিত ছিল ছয়টা। পরের দিন আবার গেলেন খাবার নিয়ে, কিন্তু সেই একটি কুকুর আবারও অনুপস্থিত। সেটিকে খুঁজতে থাকেন ফরিদা।
‘আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে জানতে পারলেন যে, চলন্ত ট্রাকের নিচে পড়ে সেটি মারা গেছে। তখন তিনি সেখানেই কান্নাকাটি করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন। থানা পর্যন্ত গিয়েছিলেন সেই ট্রাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে।’
ফরিদা যেসব হোটেলে কাজ করেন, এর একটি মালিক মো. আশরাফের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার।
তিনি বলেন, ‘বহু বছর থেকে তিনি আমার হোটেলে কাজ করেন। সবজি কাটা, ডাল বাটাসহ অন্যান্য কাজ করে দেন। প্রতিদিন তাকে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দেয়া হয়। প্রতিদিনই তিনি সেই টাকা দিয়ে রাতে মাছ, তরকারি, চাল কিনে বাসায় রান্না করে রাতে বেরিয়ে যান পথকুকুরগুলোকে খাওয়াতে।
‘তিনি কোনো টাকা জমা রাখেন না। সব এই পথকুকুর খাওয়াতেই ব্যয় করে দেন। ওনার ঝুপড়িতেও চার থেকে পাঁচটি বিড়াল সব সময় থাকে। তার নিজের কোনো বাড়ি নেই। কোনো বয়স্ক বা বিধবা ভাতা পান না তিনি। এই মজুরির টাকা দিয়েই তিনি এই বিড়াল-কুকুরগুলোকে আগলে রেখেছেন।’
বণ্য প্রাণী, পাখি ও পরিবেশের সুরক্ষায় কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেতুবন্ধন যুব উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ফরিদা বেওয়ার কাজটি আমাদের সকলের জন্য অনুকরণীয়। আমরা আমাদের সংগঠন থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী সাধ্যমতো পাশে থাকার চেষ্টা করব।’