বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতি রয়েছে নদীমাতৃক দেশ হিসেবে। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এ দেশের বেশির ভাগ শহর-বন্দর।
সরকারি হিসাবে দেশে নদীর সংখ্যা ৩১০টি। এ ছাড়া রয়েছে অসংখ্য হাওর-বাঁওড়-বিল। আছে সুবিশাল সমুদ্রতট।
এসব কারণে জলভিত্তিক পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তা কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের জলাশয়কেন্দ্রিক ভূ-প্রকৃতির নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, যা অনন্য। বিশ্বের কোথাও এর তুলনা পাওয়া যাবে না।
সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে রয়েছে ৪২৩টি হাওর। সুনামগঞ্জে আছে ১৩৩টি, কিশোরগঞ্জে ১২২টি, নেত্রকোণায় ৮০টি, সিলেটে ৪৩টি, হবিগঞ্জে ৩৮টি, মৌলভীবাজারে ৪টি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আছে তিনটি হাওর। বিপুল এ সম্ভাবনার খুব অল্পই কাজে লাগানো হয়েছে।
সম্প্রতি হাওরকেন্দ্রিক পর্যটন দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু একটি পর্যটন কেন্দ্রে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা, তা এখনও গড়ে ওঠেনি। যতটুকু আছে, তাও মানসম্মত নয়।
পর্যটনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিকল্পিতভাবে এর সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো গেলে তা দেশের পর্যটনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় ট্যুর অপারেটরদের সংগঠন প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের (পাটা) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাসচিব তৌফিক রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন হাওরে যা চলছে, সেটা কোনোক্রমে গ্রহণযোগ্য না। যে বোটগুলো রয়েছে, সেগুলো খুব একটা ভালো না। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছেলেপেলেরা যায়, তাদের জন্য হয়তো ঠিক আছে, কিন্তু কোনো পর্যটকই পরিবার নিয়ে এখানে থাকতে পারবে না। বিদেশি পর্যটকরা তো পারবেই না।
‘তারপর এখানে কোনো অ্যাক্টিভিটি নাই। বোটে করে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই। বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে হলে এখানে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এখানে হাজংপাড়া আছে, গারোপাড়া আছে, খাসিয়াপাড়া আছে। তাদের সাথে নিয়ে হোম স্টে করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কালচারাল অ্যাক্টিভিটি আছে। সেখানে মন্দির আছে, গির্জা আছে, মসজিদ আছে, মানে একটি রিলিজিয়াস হারমনি আছে। এটাকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
‘যাদুকাটা নদের এপাশে একদিকে পাহাড়, একদিকে নদী। কিন্তু এখানে কোনো অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। যেহেতু কিছু এখনও গড়ে ওঠেনি, তাই পরিকল্পনা করে এখানে কিছু একটা করা সম্ভব। সম্ভাবনা আছে, কিন্তু পর্যটনের দিক দিয়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা অনেক নাজুক অবস্থায় রয়েছে।’
দেশি ট্যুর অপারেটরদের সংগঠন টোয়াব বলছে, হাওর বা জলকেন্দ্রিক পর্যটন তখনই জনপ্রিয় হবে, যখন এখানে পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হবে।
টোয়াব সভাপতি রাফেউজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যদি টাঙ্গুয়ার হাওরের কথা বলি, এর একদিকে পাহাড়, অন্য দিকে জলাভূমি, যেটি স্বচ্ছ। এটা শীতকালে একরকম, বর্ষায় একরকম, আর গ্রীষ্মে আরেক রকম। কিন্তু পর্যটকদের জন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা এখানে এখনও গড়ে ওঠেনি। যেমন: থাকার কোনো সুবিধা এখানে নেই। দুই-একটি অবকাঠামো থাকলেও সেগুলো মানসম্মত না।
‘আর রেস্টুরেন্টেও তেমন সুযোগ-সুবিধা নেই। যে কয়েকটি আছে, সেগুলো ঘরোয়া পর্যটনের জন্যই মানসম্মত নয়; বিদেশিদের জন্য তো নয়ই। কমিউনিকেশনটাও আরও সহজ হতে হবে। সুনামগঞ্জ থেকে ট্রলারে বা মোটরবাইকে এখানে যাওয়া এটা সাধারণত যথেষ্ট না। এসব ক্ষেত্রে গণপরিবহন থাকতে হয়। তাহলেই জনপ্রিয় হয়।’
এ ধরনের পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে তুলে ধরতে ব্র্যান্ডিং ও সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তিনি।
টোয়াব সভাপতি বলেন, ‘আমরা যদি চলনবিলের কথা বলি, আমরা কিন্তু মার্কেটে সাড়া জাগাতে পারিনি। আমরা হাকালুকির কথা বলি, ঘরোয়া বা আন্তর্জাতিক কোনো ক্ষেত্রেই কিন্তু এগুলোকে পণ্য হিসেবে তৈরি করতে পারিনি। এটার জন্য সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।
‘ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রচার চালালেও সরকারের সমর্থন না থাকলে এটি আগাতে পারবে না। সরকারকেই ব্র্যান্ডিংয়ে এগিয়ে আসতে হবে।’
সরকার বলছে, দেশের পর্যটন খাতের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে। সব ঠিক থাকলে আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই তা চূড়ান্ত হবে। এ মহাপরিকল্পনায় পর্যটনসংশ্লিষ্ট সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
পর্যটনসচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পর্যটনের উন্নয়নে যে মহাপরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে, তার মধ্যে সবকিছু থাকবে। আমরা সব জেলাকে এই মহাপরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসছি। হাওর বা জলকেন্দ্রিক পর্যটনও এর মধ্যে থাকবে।’