দেখে মনে হতে পারে একটা ড্রেন; আবর্জনার ভাগাড়ও মনে হতে পারে। এমনই দশা সিলেট নগরের বুক চিড়ে বয়ে চলা সুরমা নদীর। যেন নগরীর সব কদর্যতা ধারণ করে আছে সুরমা।
তার উপর নদীর দুই তীর দখল করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য স্থাপনা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেবেই, সিলেটে সুরমার দুই তীর দখল করে রেখেছেন ১১১ দখলদার। তারা গড়ে তুলেছেন দুই শতাধিক স্থাপনা। তবে পরিবেশকর্মীদের হিসাবে দখলদারের সংখ্যা আরও বেশি।
অব্যাহত দখল ও দূষণে হুমকির মুখে দেশের দীর্ঘতম এই নদী।
বিশ্বের সব দেশের মতো পালিত হচ্ছে বিশ্ব নদী দিবস। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার পালিত হয় এই দিবস। এবার দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ‘মানুষের জন্য নদী’।
নদী দিবসে যেন সুরমা তার দুঃখ মেলে ধরেছে। শুষ্ক মৌসুমে এমনিতেই শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয় সুরমা। হেঁটেই পার হওয়া যায় নদীর এপার থেকে ওপার। পলি জমে গজিয়ে ওঠে চর। এর মধ্যে তীর দখল ও নদীতে বর্জ্যের কারণে এখন মৃতপ্রায় সুরমা। বর্ষায় তীর উপচে পানি ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের জনপদে। দেখা দেয় বন্যা।
সিলেট নগরের কুশীঘাট থেকে টুকেরবাজার প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়েই সুরমাকে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে। এই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে একেবারে বিবর্ণ হয়ে গেছে সুরমা। নদীর পানিতে ভাসছে অসংখ্য আবর্জনার স্তুপ।
নগরীর কাজীর বাজার মাছের আড়তে গিয়ে দেখা যায় ককশিট ও মাছের খাঁচা ভাসছে নদীতে। বাজারের সব আবর্জনা সরাসরি ফেলে দেয়া হয় নদীতে।
কাজীরবাজারের মাছের আড়তের শৌচাগারের পাইপ সরাসরি নামানো হয়েছে নদীতে। সরেজমিন দেখা গেছে, নদীতে গিয়ে পড়ছে শৌচাগারের ময়লা। এছাড়া পাশের বস্তির টয়লেটের ময়লার পাইপও নদীতে সরসরি লিংক করা সুরমায়।
একইভাবে সিলেটের পাইকারী বাজার কালীঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে পেঁয়াজ-রসুনের খোসা ভেসে যাচ্ছে নদীতে। কালীঘাটের সব আবর্জনা সরাসরি নদীতে ফেলা হয় বলে জানালেন ওই এলাকার পরিচ্ছন্নতাকর্মী আবুল হোসেন।
তিনি জানান, সিটি করপোরেশনের গাড়ি এসে যে আবর্জনা নিয়ে যায় তার চেয়ে পাঁচগুণ আবর্জনা ফেলা হয় নদীতে। নদীর পানি দিন দিন দুষিত হয়ে পড়ছে। ওই পানি হাতে লাগলে চুলকায়।
নগরীর মাছিমপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গৃহস্থালির যাবতীয় ময়লা ফেলা হচ্ছে নদীতে। আবার পাশেই দলবেঁধে নদীতে গোসল করছেন এলাকার লোকজন।
নগরীতে বর্জ্য ব্যবস্থা গড়ে না ওঠা ও পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় এমনটি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আবার নগরবাসীর সচেতনতার অভাবকেও দায়ী করেছেন তারা।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক এমরান হোসেন বলেন, ‘নদীর এ চিত্র আমাকেও পীড়া দেয়। আমাদের অফিসটাও নদীর পাশেই। সিলেট সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি আছে। তারা চাইলে নদীর পানি দূষণ রোধ ও আবর্জনা ফেললে ব্যবস্থা নিতে পারত, কিন্তু তারা সেটি করছে না। তারা যদি ব্যবস্থা নেয় তাদেরকে আমাদের পক্ষ থেকেও সহযোগিতা করা যাবে।’
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন হচ্ছে না। সবার আগে অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। সচেতন হতে হবে। সচেতন হলেই আমাদের নদী রক্ষা করা সম্ভব।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটি তাদের দায়িত্ব। তারা এ ব্যপারে ব্যবস্থা নিতে পারে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক শাহ শাহেদা জানান, ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে নদী, খাল, পুকুর ভরাট ও দূষণ করা যাবে না, এমনকি শ্রেণি পরিবর্তণ করা যাবে না বলে উল্লেখ রয়েছে। একইভাবে ২০১৩ সালের পানি অধিকার আইনেও পানি নিষ্কাশনে বাধা দেয়া যাবে না বা দূষণ করা যাবে না বলে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া ২০০০ সালের জলাধার আইনেও নদীর শ্রেনী পরিবর্তন করা যাবে না বলে উল্লেখ রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সিলেট সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকা থেকে ময়লা-আবর্জনা ফেলে নদীর পানি দূষণসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। এসব তথ্য সংগ্রহ হলেই বেলার পক্ষ থেকে আইনী পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
বন্ধ উচ্ছেদ অভিযান
২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সুরমা নদীর দখলদারের চিহ্নিত করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এর মধ্যে সিলেট নগরে সুরমা নদীর ১১১ দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়। তারা নদীর ৩ হাজার ৬০০ মিটার জায়গা দখর করে রেখেছেন বলে জানা যায়।
পাউবোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদীর তীর দখল করে নির্মাণ করা অবৈধ স্থাপনায় আছে চাউলের আড়ত, মাইকের দোকান, কাপড়-জুতার দোকান, সেলুন, ফার্নিচার, সোনার দোকান, ফাস্টফুডের দোকান ও মাংসের দোকান। তবে প্রকৃত চিত্র এর চেয়ে আরও ভয়াবহ বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
তালিকা করার পর ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর সারা দেশে একযোগে নদী তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান শুরু হয়। সিলেট নগরসহ কয়েকটি উপজেলায় চলে এই অভিযান। তবে একমাস পরেই এই উচ্ছেদ অভিযান মাঝপথে থেমে যায়।
উচ্ছেদ অভিযান থেমে যাওয়ার পর দখলমুক্ত হওয়া অনেক জায়গায় আবারও অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠছে।
এ ব্যাপারে পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, ‘প্রকৃত দখলদারের সংখ্যা তালিকার চেয়েও বেশি সন্দেহ নেই। উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হয়নি। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। অভিযান সব সময় চলবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিছু কিছু জায়গায় পুনরায় দখল হচ্ছে। বিষয়টি আমাদের নোটিসে আছে। যে কোনো সময় সেগুলো আবার উচ্ছেদ করা হবে।’
মৃতপ্রায় বেহাল সুরমার বিষয়ে নদী সুরক্ষার আন্তর্জাতিক অ্যালায়েন্সের সদস্য সুরমা রিভার ওয়াটার কিপার আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘অব্যাহত দখল ও দূষণে এই নদী এখন অস্তিত্ব সঙ্কটে। নদীর দূষণ ও দখল ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’