বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘করি চোখের ডাক্তারি, রচি সংগীত অচিনপুরী’

  •    
  • ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৪:৩৪

সমসাময়িক নানা ইস্যু ও সামাজিক অসংগতি নিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় চেনা সুরে গাওয়া তার গান ফেসবুকের মাধ্যমে এখন সিলেটে বেশ জনপ্রিয়। অচিনপুরী নিজেই গান লেখেন; সুরও করেন। গানে তেমন কোনো তালিম না নিলেও মরমী চেতনা তার মজ্জাগত।

কক্ষের আশপাশে ছড়িয়ে আছে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি। দেয়ালে ঝোলানো ওষুধ কোম্পানির ওয়ালম্যাট। সাদামাটা একটি চক্ষু চিকিৎসার চেম্বার। ভেতরে বসা ঝাকড়া চুলের মধ্যবয়স্ক এক লোক। পাশে কয়েকজন বসে বাদ্য বাজাচ্ছেন। গান গাইছেন মধ্যবয়সী ব্যক্তিটি।

এ রকম কয়েকটি গান ফেসবুকে এখন ভাইরাল। বিশেষত সিলেট অঞ্চলের শ্রোতা-দর্শকদের কাছে গানগুলো বেশ আলোচিত।

ওই চেম্বারে বসে যিনি গান গেয়েছেন তিনি চিকিৎসক, চক্ষু বিশেষজ্ঞ। নিজের সম্পর্কে তার মন্তব্য, ‘আমি আসলে গানের লোক, গান ছাড়া তৃপ্তি পাই না।’

এ ‘গানের লোক’ হলেন চিকিৎসক জহিরুল ইসলাম। গানের ভনিতায় নিজেকে পরিচয় দেন ‘জহির অচিনপুরী’ হিসেবে। শ্রোতারা তাকে ‘অচিনপুরী’ নামেই সম্বোধন করেন।

ফেসবুক পেজে নিজের পরিচয়ে তিনি লিখেছেন, ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আমি, করি চোখের ডাক্তারি/গান আমার প্রাণের খোরাক, রচি সংগীত অচিনপুরী।’

সমসাময়িক নানা ইস্যু ও সামাজিক অসংগতি নিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় চেনা সুরে গাওয়া তার গান ফেসবুকের মাধ্যমে এখন সিলেটে বেশ জনপ্রিয়।

অচিনপুরী নিজেই গান লেখেন; সুরও করেন। গানের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা না নিলেও মরমী চেতনা তার মজ্জাগত।

মরমী সাধনার এক উজ্জ্বল চারণভূমি সুনামগঞ্জ। হাসন রাজা, রাধারমণ, দুর্বিন শাহ, শাহ আবদুল করিমের মতো মরমী সাধকরা ঋদ্ধ করে গেছেন বাংলা সংগীতকে।

জহির অচিনপুরীর জন্ম এ জেলারই ছাতকে। তার বাবা ময়না মিয়াও মরমী ধারার লোক; গানও লিখেন। সেই সূত্রে তার মধ্যেও বহমান মরমী ধারা।

রাজধানীর জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত জহির। এ ছাড়া ঢাকার রায়েরবাজারে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের জন্য চেম্বার আছে তার।

কাজের কারণে মূলত ঢাকাতেই থাকেন। প্রতি বৃহস্পতিবার চলে আসেন সিলেট। শনিবার পর্যন্ত তিন দিন নগরের লামাবাজারে ‘সালেহা আই কেয়ার সেন্টার’ নামে নিজের চেম্বারে বসেন।

শরতের এক তপ্ত দুপুরে লামাবাজারে চেম্বারে দেখা মেলে জহির অচিনপুরীর। বাদ্যযন্ত্র নিয়ে তার দলবলও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। তারা আবার ওই চেম্বারেই কাজ করেন।

চেম্বারটির ব্যবস্থাপক আব্দুল মনাফ বাজান পারকাশন, কর্মী সিজান বাজান হারমোনিয়াম। আর জুয়েল তাল তোলেন তবলায়।

চেম্বারের কাছে অচিনপুরীর স্টুডিও। যখন রোগী থাকে না তখন স্টুডিওতেই সময় কাটান তিনি। নিউজবাংলার এই প্রতিবেদককে দেখে চেম্বারেই গান শুরু করেন তিনি। এর ফাঁকে চলে গল্প।

অচিনপুরী বলেন, ‘ছোটবেলায় মজা করে গান করতাম। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে গাইতাম। গানের লোকদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। তবে কখনো সেইভাবে গান শিখিনি।’

ছাতকে স্কুলে পড়াকালীন শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন জহির। এরপর সংগীতশিল্পী কেতকী আচার্যের কাছে কিছুদিন স্বরলিপি শিখেছেন।

অচিনপুরী বলেন, ‘সে সময় বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী গৌরি চৌধুরীসহ কয়েকজন কেতকী আচার্যের কাছে গান শিখতেন। আমিও তাদের সঙ্গে যেতাম; তাদের সঙ্গে গলা মিলাতাম। তবে তখন আমার আগ্রহ ছিল অভিনয়ে। যদিও গান শুনতাম প্রচুর।’

ছোটবেলার এক অভিজ্ঞতার কথা জানান অচিনপুরী। তিনি বলেন, ‘দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুলে প্রথমবারের মতো একটি গানের প্রতিযোগিতায় নাম দেই। সেখানে তৃতীয় হই। তবে পড়াশোনার কারণে গানে মনোযোগ দিতে পারিনি। আর মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় কবিতার প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়ি।’

এইচএসসি শেষে জহির ভর্তি হন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে পড়ার সময় আবার গানের ঝোঁক পেয়ে বসে তাকে। সংগীত শিক্ষক বিপ্রদাস ভট্টাচার্য বাপ্পুর কাছে কিছুদিন গানও শেখেন। সেই সঙ্গে চলে কবিতা লেখালেখি।

বন্ধুদের আড্ডায় জনপ্রিয় গানের প্যারোডি করতেন তিনি। আর সবসময় শুনতেন মরমী সাধকদের গান।

জহির বলেন, ‘হাসন রাজার গান আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। তার জীবনদর্শনও আমাকে টানে। হাসন রাজা জমিদার হয়েও জমির মায়ায় জড়াননি। তিনি দুনিয়ার ভেতরে থেকেও অন্য দুনিয়ায় ছিলেন। এসব কারণে তাকে ভালো লাগে।’

২০০৫ সালের দিকে যখন গান গাওয়া শুরু করলেন, তখন হাসন রাজাকে ভালোবেসে নিজের নাম বদলে রাখেন ‘জহির কানাই’। তখন সবে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। সেখানকারই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করতেন।

জহির গান লেখা শুরু করেন ২০১০ সালে। এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘তখন আমার মাথায় দেশের বাইরে চলে যাওয়ার চিন্তা পেয়ে বসেছে। এর মধ্যে উচ্চতর প্রশিক্ষণে ভারতে যাই। সেখানে গিয়েই ভাবনা পাল্টে যায় আমার। ভারতে গিয়ে দেখি, অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বিদেশের বিলাসী জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করে নিজ দেশে থেকে মানুষের সেবা করছেন। আমিও তখন সিদ্ধান্ত নিই, দেশে থেকেই মানুষের চিকিৎসায় কাজ করব।’

তিনি বলেন, “এ রকম সময়ই আমার মাথায় হঠাৎ একটি গান আসে। মাকে নিয়ে গান, ‘আমি হব না দেশান্তরি, থাকিব থাকিব মায়ের চরণ ধরি।’ এরপর গানটি রেকর্ড করি। তখন আমার এক সহকর্মী আমার নাম দেন, ‘অচিনপুরী’। তার নামটি আমার পছন্দ হয়। নামের সঙ্গে অচিনপুরী জুড়ে দেই।”

২০১৩ সালে ইউটিউবে প্রথম অ্যাকাউন্ট খুলেন তিনি। নাম দেন ‘অচিনপুরী মিউজিক ভ্যালি’। এরপর ফেসবুকেও একই নামে পেজ খুলেন।

অচিনপুরী বলেন, “প্রথমে আমার ছাত্র, বন্ধু, সহকর্মীরাই কেবল আমার গান শুনত; বাইরের লোকজন তেমন শুনত না। তবে ২০১৬ সালে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় গাওয়া ‘মুই বালা নায়’ শিরোনামে একটি গান অনেক জনপ্রিয় হয়। এরপর ‘খাউজ্জানি’ নামে সিলেটের ভাষার আরেকটি গান করি। এটা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে; আমাকে পরিচিতি এনে দেয়।”

কথা বলতে বলতেই অচিনপুরী গেয়ে ওঠেন, ‘পরোর বালা দেখলে আমার গতরো উঠে খাউজ্জানি/ও বাবু বুঝছোনি, হায়রে মজার খাউজ্জানি।’

এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০ গান লেখার কথা জানিয়ে অচিনপুরী বলেন, ‘সবগুলো রেকর্ড করা হয়নি। সংরক্ষণের অভাবে কিছু হারিয়েও গেছে। আমি অগোছালো মানুষ। সব সামলে রাখতে পারি না।’

‘চিকিৎসক হওয়ায় ব্যস্ত জীবন। তবু গানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া কেন?’

জবাবে অচিনপুরী বলেন, ‘আমি নিজের আত্মিক উন্নয়ন ও আত্মতুষ্টির জন্যই গান করি। নিজেকে পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। গানে গানে মানুষের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে চাই। এ ছাড়া একটা মায়ার জগৎ গড়ার লক্ষ্যে গান করি, যেখানে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না; সম্প্রীতি থাকবে, বন্ধন থাকবে।’

মরমী গানকে আধুনিকভাবে উপস্থাপন করতে চান জহির। নতুন প্রজন্মের কাছে সেগুলো নতুনভাবে সামনে আনতে চান।

গান গাইতে গিয়ে কিছু মানুষের কটূ কথার শিকার হতে হয়েছে বলে জানান অচিনপুরী। তিনি বলেন, ‘মানুষ আমার গান শুনলে ভালো লাগে, আনন্দ হয়। আমি চাই আমার সৃষ্টিগুলো মানুষ দেখুক, শুনুক। মানুষ যখন আমার গান শুনে প্রশংসা করে, তখন খুশি হই। আবার গান করায় ধর্মীয় বিদ্বেষের শিকারও হতে হয়। অনেকে কটূ মন্তব্য করে।

‘এখন ফেসবুক বা ইউটিউবে আপ দেয়া গানের নিচের মন্তব্যগুলো আর পড়ি না। এগুলো পড়লে হতাশ হয়ে যাই। সব সৃজনশীল মানুষকে এই সমস্যায় পড়তেই হয়। ফলে এগুলো গায়ে মাখি না। আমি দেখি নিজের অবস্থানে-বিশ্বাসে ঠিক আছি কি না।’

জহির আরও বলেন, ‘আমার মধ্যে কৃত্রিমতা নাই। যা বিশ্বাস করি, যা ধারণ করি তাই কথা ও সুরে প্রকাশ করি।’

এ বিভাগের আরো খবর