বিশ্বজুড়ে গত ১০ বছরের মতো ২০২১ সালেও ব্যাপকভাবে খর্ব হচ্ছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের স্বাধীনতা। এ বছর সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে মিয়ানমার, বেলারুশ ও উগান্ডায়।
বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা ‘পার্টলি ফ্রি’ বা ‘আংশিক স্বাধীন’। আগের দুই বছরের চেয়ে দেশে এবার ইন্টারনেটে নিয়ন্ত্রণ আরোপের ক্ষেত্র বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক অলাভজনক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ফ্রিডম হাউসের প্রকাশ করা ‘ফ্রিডম অন দ্য নেট’ শিরোনামের প্রতিবেদনে এ তথ্য এসেছে। প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয় মঙ্গলবার।
কী আছে প্রতিবেদনে
প্রতিবেদনের সারাংশে ছয়টি বিষয় তুলে ধরেছে ফ্রিডম হাউস। এতে বলা হয়, টানা ১১ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের স্বাধীনতা কমছে। এ বছর সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে মিয়ানমার, বেলারুশ ও উগান্ডায়। মিয়ানমারের স্কোর কমেছে ১৪ পয়েন্ট, যা ‘ফ্রিডম অব দ্য নেট’ প্রকল্প চালু হওয়ার পর একক কোনো দেশের সর্বনিম্ন অবনমন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যবহারকারীদের স্বাধীনতা নিয়ে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকার। গত এক বছরে অন্তত ৪৮টি দেশ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কনটেন্ট, ডেটা বিষয়ে নতুন আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন মত প্রকাশ রুদ্ধ করে দেয়া ও ব্যক্তিগত ডেটায় প্রবেশ বাড়ানো।
এতে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে সম্প্রতি অনলাইনে স্বাধীন মতপ্রকাশ নজিরবিহীন চাপে আছে। অহিংস রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় বক্তব্যের জন্য দেশে দেশে ব্যবহারকারীদের গ্রেপ্তারের মাত্রা বেড়েছে। অন্তত ২০টি দেশ ইন্টারনেটে প্রবেশ সাময়িকভাবে বন্ধ করেছে, ২১টি দেশে বন্ধ হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। অন্তত ৪৫টি দেশের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বেসরকারি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে স্পাইওয়্যার বা ডেটা সংগ্রহের প্রযুক্তি কেনার অভিযোগ উঠেছে।
বৈশ্বিক পরিস্থিতি
‘ফ্রিডম অব দ্য নেট’ (এফওটিএন) প্রতিবেদনে টানা সপ্তম বছরের মতো ইন্টারনেট স্বাধীনতা দেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বাজে দেশ বিবেচিত হয়েছে চীন। দেশটি ইন্টারনেট ব্যবহারের স্বাধীনতায় ৯ ধরনের হস্তক্ষেপ করেছে। তাদের স্কোর ১০। প্রতিবেদনে চীনকে ‘নট ফ্রি’ (স্বাধীন নয়) ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে।
ইন্টারনেটে সবচেয়ে কম স্বাধীনতার দিক থেকে চীনের পরের অবস্থান ইরানের। দেশটির স্কোর ১৬। তারা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ওপর আট ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। ইরানকেও রাখা হয়েছে ‘নট ফ্রি’ ক্যাটাগরিতে।
অনলাইনে স্বাধীনতায় নিচের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে আছে সামরিক অভ্যুত্থান হওয়া দেশ মিয়ানমার। ৯টি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা দেশটির স্কোর ১৭। দেশটি আছে ‘নট ফ্রি’ ক্যাটাগরিতে।
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য সবচেয়ে স্বাধীন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে ইউরোপের ছোট্ট দেশ আইসল্যান্ড, যার স্কোর ৯৬। ‘ফ্রি’ বা মুক্ত ক্যাটাগরির দেশটি কোনোভাবেই ব্যবহারকারীদের বাধার মুখে ফেলছে না।
মুক্ত ইন্টারনেটের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে ইউরোপের আরেক দেশ এস্তোনিয়া, যার স্কোর ৯৪। ফ্রি ক্যাটাগরির এ দেশটিও ব্যবহারকারীদের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেনি।
অনলাইন ব্যবহারকারীদের স্বাধীনতার দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে আছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কোস্টারিকা। মুক্ত ক্যাটাগরির দেশটির স্কোর ৮৭।
বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র আছে ফ্রি ক্যাটাগরিতে। দেশটির স্কোর ৭৫। তবে টানা পঞ্চম বছরের মতো স্কোর কমেছে যুক্তরাষ্ট্রের। ভুয়া, বিভ্রান্তিকর ও কারসাজি করা তথ্যে সয়লাব হয়েছে অনলাইন। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
আরেক বৈশ্বিক পরাশক্তি যুক্তরাজ্যের অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ভালো। ফ্রি ক্যাটাগরির দেশটির স্কোর ৭৮। আয়তনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়া ৩০ স্কোর নিয়ে আছে ‘নট ফ্রি’ ক্যাটাগরিতে। দেশটি সাতটি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ভিয়েতনামের স্কোর ২২। নট ফ্রি ক্যাটাগরির দেশটি পাঁচটি ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে।
ছয়টি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব আছে ‘নট ফ্রি’ ক্যাটাগরিতে। দেশটির স্কোর ২৪।
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ওপর সাতটি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা মধ্যপ্রাচ্যের আরেক প্রভাবশালী দেশ তুরস্ক আছে ‘নট ফ্রি’ ক্যাটাগরিতে। দেশটির স্কোর ৩৪।
আফ্রিকার দেশ উগান্ডা আছে ‘আংশিক মুক্ত’ ক্যাটাগরিতে। সাতটি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা দেশটির স্কোর ৪৯।
বাংলাদেশের অবস্থান
৭০টি দেশের তালিকায় ‘পার্টলি ফ্রি’ বা আংশিক মুক্ত ক্যাটাগরিতে আছে বাংলাদেশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪০ স্কোর পাওয়া বাংলাদেশ ৯টির মধ্যে সাতটি ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে কর্তৃপক্ষ।
এগুলো হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা যোগাযোগের প্ল্যাটফর্ম ব্লক করা; রাজনৈতিক, সামাজিক বা ধর্মীয় কনটেন্ট ব্লক করা; ইচ্ছাকৃতভাবে আইসিটি নেটওয়ার্কের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত করা; অনলাইন আলোচনায় সরকারপন্থি ভাষ্যকারদের প্রভাব; রাজনৈতিক বা সামাজিক কনটেন্টের জন্য ব্লগার বা আইসিটি ব্যবহারকারীদের গ্রেপ্তার, কারারুদ্ধ কিংবা দীর্ঘ সময় কারাবন্দি রাখা; ব্লগার কিংবা আইসিটি ব্যবহারকারীদের শারীরিক হামলার শিকার হওয়া কিংবা নিহত হওয়া (এর মধ্যে কারা হেফাজতে মৃত্যুও রয়েছে) এবং সরকারের সমালোচনাকারী কিংবা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ওপর কৌশলগত হামলা।
এ বছর বাংলাদেশ সাতটি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। ২০১৯ ও ২০২০ সালে দক্ষিণ নিয়ন্ত্রণ ছিল ছয়টি ক্ষেত্রে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর কী অবস্থা
তালিকায় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ রয়েছে। অন্য তিন দেশ হলো, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। প্রতিবেদনে ৫১ স্কোর নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে শ্রীলঙ্কা। চারটি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা দেশটিতে ব্যবহারকারীরা ‘আংশিক স্বাধীন’।
এর পরের অবস্থানে থাকা ভারতের স্কোর ৪৯। আটটি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা দেশটিতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা ‘আংশিক স্বাধীন’।
আর সাতটি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা পাকিস্তানকে রাখা হয়েছে ‘নট ফ্রি’ ক্যাটাগরিতে। দেশটির স্কোর ২৫।