বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বছরের ব্যবধানে কুয়াকাটায় ৩ গুণ মৃত ডলফিন

  •    
  • ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০৮:১৬

কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটি জানায়, এ বছর মোট ২১টি মৃত ডলফিন কুয়াকাটা সৈকতে ভেসে এসেছে। ২০২০ সালে কুয়াকাটাসংলগ্ন উপকূলে ভেসে এসেছিল আটটি মৃত ডলফিন। সেগুলো মাটিচাপা দেয়া হলেও মৃত্যুর প্রকৃত কারণ এখনও উদ্ঘাটন করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

কুয়াকাটা সৈকতে চলতি বছরের ৯ মাসে ভেসে এসেছে ২১টি মৃত ডলফিন। গত বছরের তুলনায় এ সংখ্যা প্রায় তিন গুণ।

সামুদ্রিক পরিবেশের জন্যও উপকারী প্রাণীটির এমন মৃত্যু উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা।

কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটির সদস্য আবুল হোসেন রাজু জানান, বৃহস্পতিবার সকালে জোয়ারের পানিতে কুয়াকাটার গঙ্গামতি চরের তেত্রিশকানিসংলগ্ন সৈকতে একটি মৃত ডলফিন ভেসে আসে। প্রায় পাঁচ ফুট দৈর্ঘ্যের ডলফিনটির শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। স্থানীয় জেলেরা ডলফিনটি দেখে খবর দিলে কমিটির সদস্যরা গিয়ে ডলফিনটি মাটিচাপা দেন।

এ কমিটির আরেক সদস্য কে এম বাচ্চু জানান, গত ৯ সেপ্টেম্বর সকালে সৈকতের জিরো পয়েন্টসংলগ্ন সানসেট পয়েন্টে একটি মৃত ডলফিন ভেসে আসে। আগের দিন সকালে সৈকতের গঙ্গামতি এলাকায় ছয় ফুট দৈর্ঘে্যর আরেকটি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়। একই দিন দুপুরে জিরো পয়েন্টের পশ্চিম পাশে মেলে আরেকটি মৃত ডলফিন।

তিনি আরও জানান, কমিটির সদস্যদের সহায়তায় ডলফিনগুলোকে উদ্ধার করে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে এ বছর মোট ২১টি মৃত ডলফিন কুয়াকাটা সৈকতে ভেসে এলো।

এর আগে শুধু আগস্টে সৈকতে ভেসে আসে ১০টি মৃত ডলফিন। আর ২০২০ সালে কুয়াকাটাসংলগ্ন উপকূলে ভেসে এসেছিল আটটি মৃত ডলফিন। যেগুলো মাটিচাপা দেয়া হলেও মারা যাবার প্রকৃত কারণ এখনও উদ্ঘাটন করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

গত বছর মৃত ডলফিন ভেসে আসা নিয়ে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি পাঁচটি কারণ জানিয়েছিল। তার ভিত্তিতে কিছু সুপারিশও করেছিল। তবে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

এ ছাড়া ডলফিনের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে বিস্তারিত পরীক্ষাও করা হয়নি। বরং ভেসে আসা ডলফিন থেকে নমুনা না নিয়েই তা মাটিচাপা দেয়া হয়। অবশ্য গত ৯ সেপ্টেম্বর ভেসে আসা ডলফিনের নমুনা নিয়ে পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে।

ডলফিনের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান না করেই মাটিচাপা দেয়ার বিষয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন স্থানীয়রাও। তারা জানান, ডলফিনগুলোর ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর কারণ জেনে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এসব মৃত ডলফিনের অধিকাংশেরই লেজ থাকে জালে প্যাঁচানো। আবার কিছু কিছু ডলফিনের মুখে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। তবে কিছু ডলফিন সৈকতে আসে অর্ধগলিত অবস্থায়। সেগুলোর শরীরে কিছু বোঝার উপায় থাকে না।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক বলেন, ‘কী কারণে ডলফিন মারা যাচ্ছে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে এগুলো সংরক্ষণ করে মৃত্যুর কারণ বের করতে মৎস্য ও বন বিভাগকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

‘ইতোমধ্যে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশের সহায়তায় মৎস্য ও বন বিভাগ মৃত ডলফিনগুলো পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানতে পেরেছি।’

কলাপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, ‘ডলফিনের মৃত্যুর কারণ তদন্তে যে ধরনের মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি ও লোকবল থাকা দরকার, তা মৎস্য অধিদপ্তরের নেই। এ কারণে এগুলো সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। কোনো উপায় না থাকায় মৃত ডলফিনগুলো মাটিচাপা দিতে বলা হচ্ছে স্থানীয়দের।’

তদন্ত প্রতিবেদনের বাস্তবায়ন নেই

গত বছর মৃত ডলফিন ভেসে আসার ঘটনায় জেলা প্রশাসন একটি তদন্ত দল করেছিল। সেই তদন্ত দলে ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।

সরেজমিন তদন্ত শেষে এই দলের দেয়া প্রতিবেদনে পাঁচটি কারণ বলা হয়। সেগুলো হলো, মাছ ধরার জাহাজগুলোর বেহুন্দি জালে আটকা পড়া, জাহাজের পাখার আঘাত পাওয়া, রাক্ষুসে সামুদ্রিক প্রাণীর আক্রমণ, সামুদ্রিক দূষণ এবং প্রাকৃতিক কারণ।

এই পাঁচটি কারণের মধ্যে সামুদ্রিক দূষণের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়, পানির ভৌত ও রাসায়নিক মান ভালো ও গ্রহণযোগ্য মাত্রায় রয়েছে। এ কারণে ডলফিনগুলো পানি দূষিত বা বিষক্রিয়ায় মারা যায়নি।

বাকি চারটি কারণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উঠে এসেছে বেহুন্দি জালে আটকা পড়া এবং জাহাজের পাখায় আঘাত পাওয়া। গভীর সাগরে মাছ শিকারে পেতে রাখা বড় জালে এসব ডলফিন আটকে পড়ে মারা যেতে পারে অথবা সাগরে বড় বড় জাহাজের পাখনায় ধাক্কা খেয়েও মারা যেতে পারে।

কমিটির সুপারিশে এসব মৃত ডলফিনের ময়নাতদন্তের কথা উল্লেখ থাকলেও আজ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্লাহ জানান, ময়নাতদন্ত বন বিভাগ আর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের করার কথা। জেলা মৎস্য অফিসের পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। আমরা তাদের বলেছি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের খুঁজে বের করা উচিত কেন এগুলো এভাবে মারা যাচ্ছে। তারপর ব্যবস্থা নিতে হবে।’

বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, ডলফিন মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনও অজানা। মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনে মৃত ডলফিনের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়া গেলে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে।

খেপুপাড়া মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে কেউ ফোন ধরেননি।

ডলফিন নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত

মৎস্য অধিদপ্তর বরিশালের সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের উপপরিচালক কামরুল ইসলাম জানান, ভেসে আসা এসব ডলফিন বঙ্গোপসাগরের অগভীর অঞ্চলে থাকে। ২০-২৫ মিনিট পরপর এরা অক্সিজেন নিতে পানির ওপরে আসে। তখনও এরা মূলত দুর্ঘটনার শিকার হয়।

তিনি আরও জানান, বঙ্গোপসাগরে দুই প্রজাতির ডলফিন পাওয়া যায়। একটি হলো বটল নোজ (বোতলের মতো মুখ) এবং আরেকটি হলো হাম্পব্যাক ডলফিন (পিঠের দিকটা সামান্য ভাঁজ ও কুঁজো)। কুয়াকাটা সৈকতে ভেসে আসা মৃত ডলফিনগুলো হলো হাম্পব্যাক ডলফিন।

ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের অগভীর অঞ্চলে এই প্রজাতির ডলফিন বেশি দেখা যায়। এর পিঠের অংশ সামান্য উঁচু, তাই একে কুঁজো ডলফিন বলা হয়। এর সামনের চোয়াল বেশ লম্বা এবং ৩০-৩৪টি দাঁতযুক্ত।

ইকোফিশ-২ প্রকল্পের সহকারী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি জানান, মৃত ডলফিনের অন্ত্রের একটি অংশ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে এবং অপর একটি অংশ বন অধিদপ্তরের পরীক্ষাগারে পাঠানো হচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডলফিনটির মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।

তিনি বলেন, ‘ডলফিনসহ এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় স্থানীয় জেলেদের ব্যাপক হারে সচেতন করাতে হবে। কারণ সাগরে মাছ শিকারের সময় জেলেরা এসব ডলফিনকে না বুঝে এবং ভয় ও আতঙ্কে আঘাত করতে পারেন। পাশাপাশি সাগরকে দূষণমুক্ত রাখতে হবে।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সাজেদুল হক বলেন, ‘ডলফিন পরিবেশের জন্য অনেক উপকারী। এভাবে ডলফিনের মৃত্যু হতে থাকলে পরিবেশের ওপর এর খারাপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

এ বিভাগের আরো খবর