পঞ্চগড়ের বোদার একটি বাজার থেকে চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় বিরল প্রজাতির সাপ রেড কোরাল কুকরি। এর পেটের দিকে অনেকটা অংশ কেটে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছিল। সেই অবস্থায় এটিকে উদ্ধার করেন সেখানকার বন্য প্রাণী সংরক্ষক সহিদুল ইসলাম। তিনি জানিয়েছিলেন, এস্কাভেটর দিয়ে ইট ভাটার মাটির ঢিবি কাটার সময় বেরিয়ে আসে সাপটি; যন্ত্রের আঘাতে জখম হয়।
সাপটিকে পাঠানো হয় রাজশাহীর স্নেক রেসকিউ কনজারভেশন সেন্টারে। এই সাপকে সারিয়ে তোলার দায়িত্ব নেন সাপ বিশেষজ্ঞ বোরহান বিশ্বাস রমন। সাপ উদ্ধার ও সংরক্ষণের এই সংস্থাটি তারই গড়ে তোলা। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন রমন।
রমনের পরিচর্যায় ক্ষতবিক্ষত রেড কোরাল কুকরিটি এখন প্রায় সুস্থ, যেন নতুন জীবন পেয়েছে। এটিকে দেখতে নিউজবাংলার এই প্রতিবেদক যান রমনের আখড়ায়। রমন জানান, রেড কোরাল কুকরির বাংলা নাম তিনি রেখেছেন কমলাবতী। এর বৈজ্ঞানিক নাম Oligodon kheriensis।
কেমন আছে কমলাবতী
নিউজবাংলাকে রমন জানান, রেড কোরালের স্বভাব বুঝতে কম বেগ পেতে হয়নি। কী খায়, কীভাবে খায়, কোন পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে- এর সবকিছুই অজানা। এ কারণে কমলাবতীকে সুস্থ করতে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
আহত অবস্থায় উদ্ধারের পর প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয় সাপটিকে। ছবিটি পঞ্চগড়ের বন্য প্রাণী সংরক্ষক সহিদুল ইসলামের তোলা।
তিনি বলেন, ‘কমলাবতী এখন পুরোপুরি সুস্থ। এটি আমরা যেখান থেকে উদ্ধার করেছিলাম সেখানে একই প্রজাতির দুই থেকে তিনটি সাপ পাওয়া গেছে। তাই এটিকে সেখানেই ছেড়ে আসব। সেখানে এর বংশবিস্তারের সম্ভাবনা আছে।
‘এই সাপ নিয়ে এশিয়া প্যাসিফিকের গত জার্নালে একটি লেখা প্রকাশ করা হয়েছে। এই সাপ নিয়ে আরও গবেষণা করার আছে। বিশেষ করে বিষ নিয়ে গবেষণা করব। এগুলো পরবর্তীতে প্রকাশ করা হবে।’
রমন জানান, রেড কোরাল এখন ১০২তম সাপ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত। দেশে এটিকে তার দেয়া ‘কমলাবতী’ নামেই এখন অনেকে ডাকেন।
পঞ্চগড়ে যখন পাওয়া যায়, তখন এটিকে রেড কোরাল কুকরি বলে শনাক্ত করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এম মনিরুল হাসান খান। তিনি ছবি ও ভিডিওতে সাপটির মাথার গঠন, মুখের আকার এবং এর নড়াচড়ার ধরন দেখে এটিকে রেড কোরাল কুকরি বলে শনাক্ত করেন।
নিউজবাংলাকে মনিরুল বলেন, সারা বিশ্বে অল্প কিছু রেড কোরাল কুকরি আছে। সুনির্দিষ্ট সংখ্যা বলা সম্ভব না, তবে ২০ থেকে ২২টি দেখা গেছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে তিন থেকে চারটি।
তিনি বলেন, ‘সেটা নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়ার (উত্তর-পূর্ব ভারত) মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, ধারণা করা হচ্ছিল যে এটা বোধ হয় নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়াতেই আছে। বাংলাদেশে পাওয়া যাওয়ার পর এটা বোঝা গেল যে, বাংলাদেশের নর্থ বেঙ্গল সীমানাতেও এটা আছে।
‘বাংলাদেশে প্রথম একটি, তারপর আরও ৩-৪টি পাওয়া গেছে। ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়- এই দুটি জেলার মধ্যেই পাওয়া গেছে।’
রোমনের সাপ সংরক্ষণ কেন্দ্রে চিকিৎসা দেয়া হয় আহত কমলাবতীকে
মনিরুল জানান রেড কোরাল কুকরি বিরল ও নিভৃতচারী সাপ। কমলা রঙা সাপটি মাটির নিচেই বেশিরভাগ সময় কাটায়। এ কারণেই হয়তো এটি তেমন দেখা যায় না। হয়তো মাটির নিচেই এটি খাবার খুঁজে বেড়ায়।
তিনি আরও জানান, রেড কোরাল কুকরি বিষধর সাপ নয়।
যেভাবে সেরে ওঠে কমলাবতী
রমন জানান, রাজশাহীতে আনার পরপরই কমলাবতীর চিকিৎসা শুরু হয়। এর পাশাপাশি নানা রকম খাবার দিয়ে দেখা হয় সেটি কী পছন্দ করছে।
রমন বলেন, ‘শুরুতে আমাদের একটু কষ্টই হয়েছে। এখানকার পরিবেশ তার জন্য উপযোগী না। সে হিমালয়ের সাপ। মাটির নিচে থাকতে পছন্দ করে। এই সাপের খাবার নিয়ে বিশেষ কোনো তথ্য নেই। এই সাপ নিয়ে খুব কম গবেষণা হয়েছে। ফলে বেশ সমস্যায় পড়ি।
‘আমরা ধারণার উপরে কিছু খাবার দেই। আমরা তাকে জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলাম। শুরুতে টিকটিকি দেই। এরপর সে সেটি বমি করে দেয়। এরপর শুধু লেজ দেই, সেটিও ফেলে দেয়। এরপর চিন্তা করি মাটির নিচের সাপ, সেখানে কী কী থাকে। সেটা ভেবেই আমরা মাটির নিচ থেকে পিঁপড়ার ডিম এনে রস করে তাকে দেই। সেটি সে খায়। এরপর তাকে মুরগির ডিমের কুসুম খাওয়ানো হয়। দেখলাম এটিও খাচ্ছে। এভাবে আমরা তার খাবার চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছি।’
কমলাবতীর চিকিৎসার ওষুধ নিয়েও রমনকে পড়তে হয় সংকটে।
কমলাবতীকে নিয়ে গর্বিত রোমন
তিনি বলেন, ‘এটি কোল্ড ব্লাডের সাপ। তাই এখানে ওষুধ পেতেও সমস্যা হয়। আমাদের দেশে নেই। বিদেশ থেকে আসতে দেরি হবে। তত দিনে সাপ মরে পচে যেত। তাই কুমিরের ফার্ম থেকে তাদের এক্সটার্নাল ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করানো হয়।’
কমলাবতী ঘুমিয়েছে রমনের পাশেও
‘এই সাপ দেখে কোনো বিশেষজ্ঞই বিশ্বাস করছিলেন না এটি বেঁচে উঠবে। আমরা আশা ছাড়িনি। অনেক খারাপ অবস্থায় চলে গেছিল। আমরা তার সেবা করা ছেড়ে দেইনি, বরং বেশি করে সেবা দিয়েছি।’
কমলাবতীর পরিচর্যার দিনগুলো নিউজবাংলাকে এভাবেই বর্ণনা করেন রোমান। তিনি বলেন, ‘তার (সাপ) পরিবেশ নিয়ে একটু সমস্যা হয়। যেখান থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়, সেই এলাকার মতো করে একটি হাউজে পরিবেশ তৈরি করি। আমাদের সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় তাপমাত্রা কম করার সুযোগ নাই। তাই আমরা সেখানে বালু দিয়ে ও পানি দিয়ে এটি কমিয়ে রাখতাম।
‘আমি অন্তত পাঁচ দিন আমার নিজের বিছানায় রেখেছি ওকে। সেই কয়েক দিন আমার ঘুমও হয়নি। মূলত এটিকে আমরা অনেক যত্ন করে সুস্থ করে তুলতে সক্ষম হয়েছি।’
প্রায় মৃত অবস্থা থেকে বিরল প্রজাতির সাপটিকে সুস্থ করতে পেরে বেশ গর্বিত রমন।
তিনি বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বে এত বড় ক্ষত হয়ে যাওয়া সাপের রিকভারি নেই। বাংলাদেশে সাপের চিকিৎসার জন্য বিশেষ কিছু নেই। এখানে সাপের এক্স-রে করে ফুটো হয়েছে কি না সেটিও জানার সুযোগ নেই।
‘এতসব না থাকার পরও এটিকে বাঁচিয়ে তোলা গোটা বিশ্বের মধ্যে একটি ভালো কাজ হয়েছে। এটি নিয়ে আমাদের ভবিষ্যতে আরও কাজ হবে। এই অভিজ্ঞতা মাটির নিচের সাপ নিয়ে আমাদের কাজ করতে কাজে লাগবে। আমাদের এখন সাপের জন্য একটি ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট দরকার।’
বিষ সংগ্রহ ও গবেষণা
এই সাপের দাঁত একটু ভেতরে থাকে বলে জানান রমন। এ কারণে এগুলো থেকে বিষ বের করা কঠিন। বিষ আছে কি না তাও নিশ্চিত নন।
রমন বলেন, ‘আমরা সাপের একটু ভেনম বের করার চেষ্টা করব। তখন এটি নিয়ে গবেষণা হবে। এটির পরিচর্যায় বন বিভাগ আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। এখন এটার প্রজনন বিষয়ে বন বিভাগের সহয়তা পেলে আর একটি কমলাবতী নিয়ে প্রজনন করা যেতে পারে। সেটা বিশ্বের প্রথম এবং নতুন গবেষণা হবে।’
রাজশাহী বন্য প্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ‘এটি একটি ভালো কাজ হয়েছে। মূলত সঠিক পরিচর্যার কারণেই কমলাবতীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়েছে। এখন এটি পুরোপুরি সুস্থ। এর যত্নের জন্য রমন আমাদের কাছে যেসব সহযোগিতা চেয়েছিলেন সেগুলো দেয়ার চেষ্টা করেছি।
‘এটিকে যেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল সেখানেই আমরা যেকোনো দিন ছেড়ে আসব। রোমন এটির যত্ন নিতে গিয়ে যেসব সমস্যার মধ্যে পড়েছিলেন আগামী দিনে সেগুলো সমাধান করার চেষ্টা করব।’
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সাভারের ইমতিয়াজ উল ইসলাম।