বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বড় দিদি

  • খায়রুল আলম রাজু   
  • ২৮ আগস্ট, ২০২২ ১১:৩৮

আজ গ্রীষ্মের দুপুর। খুব গরম পড়েছে। বড় দিদি নিচু গলায় বলল, ‘তাড়াতাড়ি আয় রঞ্জু, সন্ধ্যার আগে আগে পৌঁছাতে হবে। জলদি আয়।’

বড় কদমগাছটার ডালপালা পুড়ে গেছে। রঞ্জুদের আধপোড়া ঘর। আগুনে পুড়ে মাটির দেয়াল ভেঙে চুরমার। ঘরের জিনিসপাতি জ্বলে ছাই। পুড়ে গেছে রঞ্জুর প্রিয় শিউলি ফুলের গাছটি। আগুনের আঁচে নুইয়ে পড়েছে উঠোনের তুলসীগাছটাও। আগুনে পুড়ে গেছে পাড়ার সব ঘর। সেনপাড়ার আলি, রায়পাড়ার দীপু, মীর্জাপাড়ার রীতাদের বাড়িও পুড়ে ছাই। রঞ্জু ওপরে তাকিয়ে দেখল, তাদের আমগাছটার সব বোল ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে।

সারারাত না ঘুমিয়ে জেগে ছিল রঞ্জু। গতকাল সন্ধ্যায় মিলিটারিরা আগুন লাগিয়েছিল। জীবন বাঁচাতে বড়দিকে নিয়ে গ্রামের সবার সঙ্গে তারা জঙ্গলে রাত কাটিয়েছে। শহরের দিক দিয়ে এলে সবার শেষে রঞ্জুদের গ্রাম। গ্রামের পরে সবুজ জঙ্গল। তারপরে ঢেউতোলা ছোট্ট নদী। মধুমতী। নদী পেরোলে বিশাল মাঠ। সেই মাঠের শেষে কাঁটাতারের বেড়া। এটা বাংলাদেশ আর ভারতের সীমান্ত।

রঞ্জু। রঞ্জু। এই রঞ্জু...

আমগাছ থেকে চোখ নামিয়ে বড়দির দিকে তাকাল। বড়দির আজ মন খারাপ। মুখে হাসি নেই। কান্নাভেজা চোখ। অথচ বাবা আর ছোটদি মড়ার সময় বড়দি ছিল পাথরের মতো শক্ত। গত বছর ডায়রিয়ায় রঞ্জুর ছোট দিদি আর বাবা মারা যান। সেনপাড়ার বড় কবিরাজের ওষুধ সেই রোগ সারাতে পারেনি। মাকেও কোনো দিন রঞ্জু দেখেনি। অবনির মা বলেছেন, রঞ্জুর জন্মের সময় নাকি তার মা মারা গেছেন। রঞ্জু তখন খুব ছোট। সেই থেকে বড়দিদিই রঞ্জুকে কোলেপিঠে করে বড় করেছেন। সর্দার বাড়িতে কাজ করে বড় দিদি যা পেত, তাতেই রঞ্জুদের দিন কোনো রকম চেলে যেত।

আজ গ্রীষ্মের দুপুর। খুব গরম পড়েছে। বড় দিদি নিচু গলায় বলল, ‘তাড়াতাড়ি আয় রঞ্জু, সন্ধ্যার আগে আগে পৌঁছাতে হবে। জলদি আয়।’

রঞ্জু তবুও বড় আমগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে রইল। এদিক-ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখছিল সে। হঠাৎ প্রশ্ন করল, ‘আমরা কই যাব রে দিদি—মামা বাড়ি?’

—না। আমরা দেশ ছেড়ে চলে যাব রে। অনেক দূরে।

—কেন দিদি? আমাদের ঘর পুড়ে গেছে বলে নতুন দেশে যাব, তাই না?

—না। দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সবাই দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। আমরাও যাব। নইলে মিলিটারিদের বন্দুকের গুলিতে মরতে হবে।

কথাটি শুনে রঞ্জুর মন কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল। আগে রঞ্জুর সারা দিন কাটত আলি, দীপু আর রীতার সঙ্গে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে। নদীতে দলবেঁধে সাঁতরে। পাখির বাসা খুঁজে। তারা ছিল রঞ্জুর বন্ধু। সবাই মীর্জাপাড়ার বড় স্কুলে পড়ত।

—দিদি, যুদ্ধ মানে কি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া, আগুনে ঘরপোড়া, না খেয়ে থাকা?

রঞ্জুর কথায় তার বড় দিদি চুপ করে রইল।

—বড়দি, যুদ্ধ মানে কী আমাদের একা যেতে হবে? আর কেউ যাবে না?’

—যাবে রে, যাবে। দেখিস না সকাল থেকে কত লোক নদী পেরিয়ে দক্ষিণের দিকে যাচ্ছে। সবাই ভারত যাবে।

—তারা কি আর আসবে না, দিদি?

—জানি না।

রঞ্জু উদগ্রীব হয়ে বলল, ‘বড়দি, আমাদের সঙ্গে কে কে যাবে?’

—সেনপাড়ার বড় বাবুরা, রায়ের পাড়ার পূজা দিদিরা, মীর্জাপাড়ার কালি ঠাকুরসহ হরি কাকা বাদে সবাই যাবে।

রঞ্জু চোখ বড় বড় করে বলল, ‘হরি কাকা কেন যাবেন না? উনি মন্দিরের পুরোহিত বলে উনার জন্য যুদ্ধ আসেনি—তাই না বড়দি?

বড় দিদি চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, ‘নারে বোকা। হরি কাকু দেশের মায়া ছেড়ে যাবেন না। মরতে হলে দেশের মাটিতেই তিনি মরবেন।’

রঞ্জু বন্ধুদের থেকে বিদায় নেবার সময়টুকুও পায়নি। আলিকে তার গল্পের বইটিও ফেরত দিতে পারেনি। বইটিও আগুনে পুড়ে গেছে।

সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা ভারত সীমান্তে পৌঁছে গেল। সারাপথ বড়দিকে কাঁদতে দেখে রঞ্জু বলল, ‘দিদি, যুদ্ধ শেষে আমরা ফিরে আসব। তুই কাঁদিস না।’

রঞ্জুরও খুব কান্না পেয়েছিল। একটু পর পর সে পেছন ফিরে দেখছিল। একটা সময় তাদের সবুজ গ্রামের শেষ বিন্দুটি মিলিয়ে গেল। রঞ্জুরা তখন ভারতের সীমানায়। বড় আমগাছটির কথা রঞ্জুর বারবার মনে পড়ছে। হরি কাকুকে রঞ্জু বলেছিল, এই বছর মন্দিরে সে চার হালি বড় বড় আম দান করবে। ভাবতেই রঞ্জুর খুব কান্না আসল।

বর্ষায় কদমগাছটার সুন্দর বলের মতো গোল ফুলগুলেআ আর সে দেখবে না। বড়দিকে বলে রঞ্জুর আবার গ্রামে ফিরে চেতে মন চাইছিল। দিদিও হয়তো গ্রামের জন্যই কাঁদছে।

সকালে সত্যি সত্যি একদল মুক্তিসেনার সঙ্গে নিজেদের গ্রামে ফিরে রঞ্জুরা। মধুমতী নদীর ওপারের সুরতি জঙ্গলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তারা থাকবে। রঞ্জু সারা দিন ঘুরে ঘুরে মিলিটারিদের নানা তথ্য সংগ্রহ করে। আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল-ডাল যা পায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিয়ে আসে। বড় দিদি করেন রান্নার কাজ।

আজ আকাশে ভরা জোছনা। রঞ্জু বড়দির পাশে শুয়ে ভাবে, ৯ মাস পর বড়দির আঠারো বছর হবে। হরি কাকা মরার দুই দিন আগে রঞ্জুকে বলেছেন, দেশ স্বাধীন হলে তার বড়দির বিয়ে হবে। তখন রঞ্জুর সব বন্ধুরা ফিরে আসবে। কাউকে আর জঙ্গলে থাকতে হবে না। সবার ভিটায় নতুন ঘর উঠবে। মুক্ত স্বাধীন পাখির মতো সবাই ঘুরবে। স্বাধীনতার এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে রঞ্জু বড়দির কোলে ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে রঞ্জু পুঁইশাকের গুঁটি চিপে লাল রং বের করল। রং দিয়ে সে দেশের পতাকা বানাবে। একটি কচি সবুজ কলাপাতার মাঝখানে গোলাকার বৃত্ত আঁকল। বৃত্তটিতে লাল রং মাখিয়ে দিল। বাহ! কী সুন্দর পতাকা—দেশের পতাকা। লাল-সবুজের পতাকা। সেই পতাকা বাঁশে বেঁধে নদীর পাড়ে পুতে আসে রঞ্জু। মনে মনে ভাবে, ‘দেশ স্বাধীন হলে কলাপাতার পতাকা হাতে এদিক-ওদিক, পাড়ায় পাড়ায় সে দৌড়াবে। আর গলা ছেড়ে চিৎকার করে বলবে ‘জয় বাংলা’।

এ বিভাগের আরো খবর